মিছিল খন্দকার
২০১১ সালের বর্ষায় এক রাতে স্ত্রীকে নিয়ে লঞ্চে করে ভোলায় বেড়াতে যাচ্ছিলেন ইন্টেরিয়র ডিজাইনার ও ব্যবসায়ী মো. আবদুল্লাহ ফারুক। মাঝনদীতে হঠাৎ করে লঞ্চ ঝড়ের কবলে পড়ে। জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যায় কয়েকশ যাত্রী। ঘণ্টাখানেক ঝড়ে টালমাটাল অবস্থার পর শান্ত হয় নদী। সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যান ফারুক দম্পতিসহ লঞ্চের সব যাত্রী।
ওই রাতে লঞ্চে ঘুরে ফারুক লক্ষ্য করেন যে, লঞ্চটিতে পর্যাপ্ত সংখ্যক জীবন রক্ষাকারী বয়া নেই। আর নৌযান দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বয়াগুলো তাৎক্ষণিকভাবে খুলে ব্যবহার করাও সহজ নয় যাত্রীদের জন্য। তাছাড়া এসব বয়া বৃদ্ধ, শিশুসহ অসুস্থ মানুষের জীবন বাঁচানোর উপযোগী নয়।
এরপর তিনি ভাবতে থাকেন- বয়ার বিকল্প কী হতে পারে যা ঝড়ের লঞ্চ ডুবে গেলেও বৃদ্ধ, শিশুসহ সব বয়সী যাত্রীদের জীবন রক্ষায় সহজে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এক পর্যায়ে তার মাথায় একটি কাঠামোর আইডিয়া আসে। পরবর্তীতে যেটার নাম দেন তিনি লাইভ সেভিং ক্যাপসুল। এমন একটি কাঠামোর বিষয়ে তিনি ভাবেন, যেটি লঞ্চযাত্রীরা বসার আসন হিসেবে ব্যবহার করতে পারবেন, আবার ঝড়ে লঞ্চ ডুবে গেলে সেটি ভেসে উঠবে।
আইডিয়াটা নিয়ে তিনি ভাবতে থাকেন। এরপর ঢাকায় ফিরে লাইফ সেভিং ক্যাপসুলের স্কেচ করেন এবং অফিসের আয়তাকার প্লাস্টিকের কনটেইনার দিয়ে প্রথমে প্রাথমিকভাবে এটি তৈরি করেন। একসঙ্গে চারটি কনটেইনার বেঁধে বানান একটি ক্যাপসুল। সেটি নিয়ে তিনি যান রাজধানীর ক্রিসেন্ট লেকে। সেখানে বিভিন্নভাবে পরীক্ষা-নীরিক্ষা চালান।
লাইভ সেভিং ক্যাপসুলকে কিভাবে আরও উপযোগী করা যায় এরপর সে বিষয়ে ভাবতে থাকেন তিনি। ওই ক্যাপসুলের নকশায় আনেন বেশ কিছু পরিবর্তন। এক্ষেত্রে তাকে সহযোগিতা করেন ক্যাড ডিজাইনার প্রকৌশলী সাইফুদ্দিন আহমেদ নামের তার এক বন্ধু। এরপর নতুন করে প্লাস্টিকের বোর্ড দিয়ে লাইফ সেভিং ক্যাপসুল তৈরি করেন তিনি। সেটি নিয়ে যান মুন্সীগঞ্জে ধলেশ্বরী নদীতে। সেখানে প্রায় ২ নটিক্যাল মাইল সফলভাবে পাড়ি দেন এই ক্যাপসুল নিয়ে।
এরপর নকশা চূড়ান্ত করে বাংলাদেশ সরকারের প্যাটেন্টস, ডিজাইনস অ্যান্ড ট্রেডমার্কস অথরিটির কাছে এটির প্যাটেন্টের জন্য আবেদন করেন। প্যাটেন্টের অনুমোদন মিললে এটি নিখুঁতভাবে যাচাইয়ে দ্বারস্থ হন বুয়েটের ডিপার্টমেন্ট অব নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের। সেখান থেকেও পান স্বীকৃতি সনদ।
এ বিষয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সমকাল অফিসে কথা হয় মো. আবদুল্লাহ ফারুকের। তিনি বলেন, এই লাইফ সেভিং ক্যাপসুল একই সঙ্গে নৌযানগুলোতে বসার আসন হিসেবেও ব্যবহার করা যাবে। আবার ঝড়ের নৌযান ডুবে গেলে সহজেই এগুলো ভেলার মতো ভেসে থাকবে। এক্ষেত্রে একেকটি ক্যাপসুলে ১৫ থেকে ১৬ জন আশ্রয় নিতে পারবেন। বৃদ্ধ, শিশুসহ অসুস্থ ব্যক্তিকেও এটির ওপর শুইয়ে রাখা যাবে।
এ লাইফ সেভিং ক্যাপসুলের কারিগরি দিক নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এর একটি ক্যাপসুলের উচ্চতা হবে ১৩ ফুট, প্রস্থে ১৮ ফুট এবং দৈর্ঘ্যে ৫৭ ফুট। প্লাস্টিকের বোর্ড দিয়ে একটি ক্যাপসুল তৈরিতে করতে খরচ হবে সাকুল্যে ৮ হাজার টাকা। ক্যাপসুলগুলো নৌযানগুলোতে আঙটা দিয়ে লাগানো থাকবে। ঝড়ের সময় সহজেই একটি বাটন টিপে এগুলো আলগা করে নেওয়া যাবে। বিপদের সময় ব্যবহারের জন্য এর টুল বক্সে থাকবে রশি, বাঁশি ও রিক্সিউ ফ্ল্যাগ। নৌযানে এ ক্যাপসুল এমন পরিকল্পিতভাবে বসানো থাকবে যাতে যাত্রীরা এটিকে বসার আসন হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এজন্য এটির উপরে থাকবে সিটকভার। এর ভেতরের ডিজাইন ও গঠন এমনভাবে করা হয়েছে, ক্যাপসুল কখনও লিক হলে বা আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও এটি ডুবে যাবে না। এটি সহজে বহন ও ব্যবহারযোগ্য।
এ লাইফ সেভিং ক্যাপসুলের কতোটা কার্যকর হতে পারে এ বিষয়ে কথা হয় বুয়েটের ডিপার্টমেন্ট অব নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মাসুদ করিমের সঙ্গে। তিনি সমকালকে বলেন, আমাদের দেশে যেটা হয় যে, নৌযানগুলোতে বয়াগুলো এমনভাবে আটকানো থাকে যে দুর্ঘটনার সময় সেগুলো খুলে সাথে নেওয়ার মতো অবস্থা থাকে না। এক্ষেত্রে এই লাইভ সেভিং ক্যাপসুল খুব কার্যকর ও অভিনব হতে পারে। এটি নৌযানগুলোতে ব্যবহার করা হলে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে জীবন রক্ষায় কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এছাড়া এটিকে যাত্রীরা বসার সিট হিসেবেও ব্যবহার করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, আবদুল্লাহ ফারুক এ লাইফ সেভিং ক্যাপসুলের স্বীকৃতি সনদের জন্য আমাদের কাছে এই প্রজেক্টটি উপস্থাপন করেছিলেন। আমরা সব দেখে তাকে অল্প কিছু বিষয়ে সংশোধনী দিয়েছি। এখন যদি এটি যথাযথভাবে তৈরি করে সামগ্রিকভাবে দেশের নৌযানগুলোতে ব্যবহারের পদক্ষেপ নেওয়া যায়, সেটা নৌ দুর্ঘটনায় প্রাণহানি রোধে ভালো ভূমিকা রাখতে পারে।
আবদুল্লাহ ফারুক চান বাংলাদেশের সব নৌযানে যাতে এই লাইফ সেভিং ক্যাপসুল রাখা হয়। তাহলে লঞ্চ ডুবিতে যে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটে তা ঠেকানো যাবে বলেও মনে করেন তিনি। ফারুক বলেন, আমি চাই এখন যেমন লঞ্চগুলোতে বয়া থাকে, এর পরিবর্তে যাতে এই ক্যাপসুলগুলো রাখা হয়। এক্ষেত্রে এর নির্মাণ খরচ একটি বাধা। তাছাড়া নৌযানগুলোতে এটির ব্যবহার নিশ্চিত করতে নৌপরিবহন আইনের কিছুটা পরিবর্তন আনতে হবে। আমি এটির একটি পূর্ণাঙ্গ প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করে রেখেছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চাইলে নৌযানগুলোতে এটির ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব। তাই তার কাছে আমার অনুরোধ, নৌযানগুলোতে এটির ব্যবহার নিশ্চিত করতে তিনি যেন যথাযথ পদক্ষেপ নেন।
Discussion about this post