গৃহস্থালির সব বর্জ্য দিয়েই ৩০ শতাংশ জ্বালানি ও শতভাগ জৈব সারের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব।এমনটাই দাবি করা হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের দুই শিক্ষার্থীর গবেষণায়। ওই দুই শিক্ষার্থী হলেন, এইচএম রঞ্জু ও পীযুষ দত্ত। তাদের গবেষণার কাজকে সার্বিক তদারকি করেছেন একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তসলিম-উর-রশিদ, প্রভাষক সাজিদুল ইসলাম ও বাংলাদেশ অ্যাডভান্স রোবটিক রিসার্স সেন্টারের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জিমি মজুমদার। তারা ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত গবেষণার কাজটি করেন।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে দেশে দৈনিক উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৪৯৩ মেট্রিকটন। ২০১৪ সালে এসে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৬৮৮ মেট্রিকটন। ২০২৫ সালে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৭ হাজার মেট্রিকটনে। এ হিসাবে বর্তমানে প্রতিদিন দেশে উৎপাদিত বর্জ্যের পরিমাণ ৩২ হাজার ১৬৫ মেট্রিকটন। এ বিশাল পরিমাণ বর্জ্যকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা না করলে পরিবেশ বিপর্যয় হতে পারে। এ থেকে মুক্তি দিতেই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে একটি প্ল্যান্ট উদ্ভাবন করা হয়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতি ১০০ মেট্রিকটন বর্জ্য থেকে ৯.২১ মেট্রিকটন জ্বালানি তেল, ২.১২ মেট্রিকটন গ্যাস, ০.৫০ মেট্রিকটনঅ্যাক্টিভেটেড কার্বন, ০.৯৩ মেট্রিকটন হাইড্রোক্লোরিক এসিড, ২০.৬৫ মেট্রিকটন ড্রাই আইস, ২১.৫৫ মেট্রিকটন বায়ো ইথানল ও ১১.২ মেট্রিকটন জৈব সার উৎপাদন সম্ভব। প্রযুক্তিটি পরিবেশ বান্ধবভাবে তৈরি করা হয়েছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে বর্জ্য শোধনের পুরো কাজটি স্বংয়ক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হবে। এতে কোনও ধরনের উচ্ছিষ্ট থাকবে না। এ থেকে উৎপাদিত জ্বালানি ও গ্যাস দিয়েই প্ল্যান্টটিও পরিচালনা করা যাবে।
সাত পদার্থের মধ্যে পেট্রোলিয়াম গ্যাস এলপিজি গ্যাস হিসেব বাসা বাড়ির রান্নার কাজে ব্যবহার করা হবে। এছাড়া একে সিএনজি গ্যাসেও রূপান্তর করা যাবে।
ড্রাই আইস: এটি খাবার সংরক্ষণের জন্য ব্যবহার করা হয়। আগুন নিবারণের কাজেও এটা পদার্থ ব্যবহার করা যাবে।
বায়ো ইথানল: এটি উন্নতমানের পরিবেশবান্ধব একটি জ্বালানি। অনেক ব্যয়বহুল হওয়ায় সাধারণ এটা ব্যবহার করা হয় না। এক্টিভেটেড কার্বন:পানি ফিল্টারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হয়। হাইড্রোক্লোরিক এসিড: এটা একজাতীয় এসিড। যা বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রি বা কলকারখানায় ব্যহার করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন গবেষণার কাজেও এই এসিড ব্যবহার করা হচ্ছে।
এছাড়া জৈব ও ইউরিয়া সারও তৈরি করা সম্ভব হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে ২০১৮ সালের উৎপাদিত বর্জ্য দিয়ে ২৩ লাখ ১৪ হাজার ৭৬৫.৫৩ মেট্রিকটন জ্বালানি তেল উৎপাদন করা যাবে। যা দেশের আমদানি চাহিদার ৩০ শতাংশ। এছাড়া এসব বর্জ্য থেকে বছরে ১৩ লাখ ১৪ হাজার ৯০৮.৯১ মেট্রিকটন জৈব সার উৎপাদন করা সম্ভব।
গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি করে এই প্ল্যান্ট তৈরি করা গেলে দেশের সব স্থান থেকে গৃহস্থালির বর্জ্য সহজেই সংগ্রহ করা সহজ হবে। ১০০ টন বর্জ্য শোধন ক্ষমতা সম্পন্ন একটি প্ল্যান্ট তৈরি করতে ২৫ কোটি টাকা খরচ হবে। রাজধানীর গড়ে প্রতিদিনের সাড়ে ৪ হাজার মেট্রিকটন বর্জ্য প্রক্রিয়াজাত করতে এমন দু’টি প্ল্যান্টই যথেষ্ট। এতে ব্যয় হবে এক হাজার ২৫০ কোটি টাকা। একটি প্ল্যান্ট থেকে উৎপাদিত দ্রব্যগুলো বিক্রি করে আট মাসের মধ্যে ব্যয় পুষিয়ে নেওয়া যাবে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, তারা পরীক্ষামূলকভাবে একটি বর্জ্য শোধনের প্ল্যান্ট তৈরি করেছেন। তাতে খরচ হয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার টাকা। এবিসি কনস্ট্রকশন কেমিক্যাল কোম্পানি নামে একটি একটি প্রতিষ্ঠান এ টাকা দিয়েছেন। গত জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ওই প্ল্যান্টে পরীক্ষামূলকভাবে বর্জ্য শোধন করেছেন তারা। পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফলাফল পাওয়া গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফলিত রসায়ন ও কেমিকৌশল বিভাগের প্রভাষক সাজিদুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শুরু থেকেই আমি এবং আমাদের আরেকজন শিক্ষক তসলিম-উর-রশিদ এই গবেষণায় সার্বিক সহযোগিতা করে আসছি। গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, প্রচলিত প্রযুক্তির সমন্বয় করে অত্যাধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থেকে মূল্যবান কেমিক্যাল পাওয়া সম্ভব। পরীক্ষা থেকে পাওয়া পণ্যগুলো আমাদের ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছি। এতে সন্তোষজনক ফলাফল এসেছে। আমি মনে করি তাদের এ প্রযুক্তি বৃহৎ পরিসরে বাস্তবায়ন সম্ভব।’
নতুন উদ্ভাবনী সম্পর্কে জানতে চাইলে গবেষক এইচ এম রঞ্জু ও পীযুষ দত্ত বলেন, ‘বর্জ্য শুধু আমাদের দেশের নয়, সারাবিশ্বের বড় একটা সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা দুই বন্ধু গবেষণার উদ্যোগ নেই এবং বর্জ্য শোধনের নতুন প্ল্যান্ট উদ্ভাবন করি। এটি পরিবেশ বান্ধব। এছাড়া এ থেকে সাত ধরনের পদার্থ পাওয়া যাচ্ছে। যা আমাদের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখবে।’
তারা বলেন, এ প্ল্যান্টের মাধ্যমে গৃহস্থালি বর্জ্যের মধ্যে ই-বর্জ্য থাকলে তা সরিয়ে ফেলা হবে। গবেষণা করতে গিয়ে তারা দেখেছেন এর মাধ্যমে শুধু পরিবেশকে দূষণ মুক্ত নয় বরং অর্থনিতিকেও চাঙা করা সম্ভব । যদি সরকার বা উদ্যোক্তরা তাদের সহযোগিতা করে তাহলে তারা এটি বাস্তবায়ন করে দেশের উন্নয়নে অংশ নিতে পারবে। তাছাড়া সিটি করপোরেশনও পরীক্ষামূলকভাবে এমন একটি প্ল্যান্ট চালু করে দেখতে পারে।
সৌজন্যে-বাংলা ট্রিবিউন
Discussion about this post