আবদুর রাশেদ রানা
বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রতিযোগিতায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার সেরা তারা।
আদিবাসী সুন্দরী : রাউফুন নাহার রিতু
গ্রামটি গাইবান্ধার সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর। গ্রামেই বেড়ে ওঠা মেয়ে। ছবি আঁকার প্রতি ভালোবাসা ভাইয়ের হাতে। ফখরুল হাসান বছর ১৩ বড়। অবসরে আঁকতো বসে; দেখে দেখে আগ্রহ জন্মাল। ছবি কীভাবে আঁকতে হয় হাতে ধরে শিখিয়ে দিল। ভালো হয়েছে বলে খুব প্রেরণা জোগাত। খুব ভালো আঁকে–আজ জানি, যেহেতু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ছাপচিত্র বিভাগে পড়ি।
ছোট থেকেই সে ‘মাস্টার ভাই’; আঁকার গুরু। এখনো তাই। মা-বাবা ও ভাইয়ের উৎসাহে আঁকার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ছোটবেলাতেই। তারাই শিশু মেয়েটিকে শিল্পকলা একাডেমি, গাইবান্ধায় ভর্তি করালেন। অনেকগুলো পুরস্কার, সম্মাননা তখনকার আছে। পড়ালেখা করেছি আহমেদ উদ্দিন শাহ শিশু নিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানেই মহাবিদ্যালয়ের জীবন। টানা ১৪ বছর পড়েছি– প্লে থেকে কলেজ। তাতে আনিস স্যারের কাছে অনেক উৎসাহ, ছবি আঁকার পাঠ নিয়েছি। ফলে সক্ষমতা বেড়েছে। এখনো চারুকলায় পড়া; ছবি, শিল্পকর্ম আঁকাকে বাংলাদেশে ভ্রূ কুঁচকে দেখা হয়; গ্রামে থেকেও সেসব সমস্যা পোহাতে হয়নি মা-বাবার প্রতিনিয়ত উৎসাহে। ফলে শিল্পী হওয়ার দিকে এগিয়েছি। এরপর তো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে, এখানে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে এলাম।
এখন ছাপচিত্র চতুর্থ বর্ষে পড়ি; অনার্স প্রায় শেষ। পুরনো ঢাকার এই পরিবেশ ভীষণ প্রিয়। অনেকগুলো প্রাচীন স্থাপনা– আহসান মঞ্জিল থেকে বড় কাটরা, তারা মসজিদ; বুড়ো নদী বুড়িগঙ্গা থেকে প্রাচীন আমলের ঘোড়ার গাড়ির পুরনো গন্ধ; হিন্দু-মুসলমানের সম্প্রীতির জীবন; সবই শিল্পী ও শিল্পের জন্য অপরিহার্য। জীবনে যদি কিছু হতে পারি–তাহলে এ পরিবেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনেক বলব–নিঃসন্দেহে। বাধাগুলো পেরিয়ে যাচ্ছি– উদ্দীপনা ও শিক্ষকদের সাহায্য, ভালোবাসায়। ছাপচিত্রের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগের প্রিয় শিক্ষক ড. বজলুর রশীদ খান ও সহকারী অধ্যাপক রেজাউল সাদাত জীবনের আদর্শ। তারাই হাতে ধরে আলাদা মাধ্যম ছাপচিত্র শিখিয়ে, তাতে ভালো করার পথ দেখাচ্ছেন। আর ‘মাস্টার ভাই’।
কাঠের ওপর শিল্পীর খোদাই-রং ও ছাপ দেওয়া খুবই পরিশ্রমের, ধৈর্যের কাজও বটে। শিল্পী হতে হলে গুণগুলো থাকতেই হয়। আরও থাকতে হয়– পড়ালেখা, মানুষের সঙ্গে মেলামেশা, আত্মীকরণ, পর্যবেক্ষণ, সাধনা ও সৃজনশীলতা। সবগুলোই ধীরে ধীরে রপ্ত করছি চেষ্টায়।
সাবজেক্ট খুঁজে বের করতে হচ্ছে নানাভাবে। এবারের দ্বিতীয় বার্ষিক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ও পুরস্কার বিতরণী-২০১৯-এ লাভ করেছি ছাপচিত্রে ‘শ্রেষ্ঠ পুরস্কার (গ্র্যান্ড অ্যাওয়ার্ড)’। সেটি এই। আদিবাসীদের জীবন সংগ্রাম বিষয় হয়; কিন্তু কোনো মানুষের সৌন্দর্য কী হয়?
ট্রাইবাল বিউটি বা আদিবাসী সৌন্দর্যতে তাই এনেছি–যুবতীর সৌন্দর্য হয়েছে ছাপচিত্রের বিষয়। তবে কোনোদিন কোনো এমন মেয়েকে দেখিনি, পুরোটাই কল্পনা। বাস্তবের প্রয়োজন আছে কী?
খুব ভালো ছাত্রী হয়েও–২০১১-’১২ শিক্ষাবর্ষে মানবিক থেকে ৪.৬৯; দুই বছর পর এইচএসসিতে ৪.৭১ জিপিএ নিয়ে পাস করেছি, এই অর্জনগুলো সেই মেধার পরিচয় দেয়, পরের স্বীকৃতিও। অনেকেই জানেন, ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পকর্ম প্রদর্শনী–২০১৮’ তে ‘বেস্ট ক্যাটাগরি অ্যাওয়ার্ড’ উড কাট মাধ্যমে ‘ফাদার অব দি নেশন’ মিনিয়েচার ওয়ার্কের জন্য; মিনিয়েচার শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ‘মিনিস্কোপ’ সে বছরই হয়েছে। তাতে অংশ নিয়ে পুরস্কার ও তার পরের বছর ‘বঙ্গবন্ধু শিল্পকর্ম প্রদর্শনী-২০১৯-এ উড কাটেই জেনারেশন টু জেনারেশন নামে বঙ্গবন্ধুর ওপর আরেকটি শিল্পকর্ম গ্র্যান্ড প্রাইজ এনে দিয়েছে। এবারের প্রদর্শনীতে ‘ওল্ড ঢাকা সিটি-১’ নামে পুরনো ঢাকার ধোলাইখালের জীবন নিয়ে আরেকটি ড্রাই পয়েন্টের কাজ প্রশংসা পেয়েছে।
নারী–১ : জেসমিন সুমী
বাকিদের মতো গ্রামের, বগুড়ার সদর উপজেলার সেলিমপুর। সব সেখানেই। বিদ্যাশিক্ষা ইয়াকুবিয়া বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে, ২০১০ সালের জিপিএ ফাইভ নিয়ে এসএসসি পাস করা নামি ছাত্রী; ২০১২ সালে জেলার আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে ৪.২০ জিপিএ নিয়ে এইচএসসি। তবে আসল ভালোবাসা আমার ছবি আঁকা ও সেই শিক্ষায়। গড়েছি মা-বাবার হাত ধরে, জেলা শিল্পকলা একাডেমি, বগুড়ায় ভর্তি হয়ে। পুতুল ম্যাডাম নামে আমাদের অংকনের শিক্ষিকা, খুব ভালোবাসতেন। আঁকা শেখাতেন মনোযোগে। অবসরে নিয়ে যেতেন ছাত্র-ছাত্রীদের বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও। ছবি দেখাতেন, সেগুলোর পেছনের গল্প, কীভাবে, কী মাধ্যমে আঁকা হয়েছে শিখিয়েছেন। সেই শিক্ষা সারা জীবন কাজে লাগছে। তার এই প্রচেষ্টা ও গড়ে দেওয়ায় সবসময় অন্যদের চেয়ে ভালো এঁকেছি, অর্জন বেশি হচ্ছে। সৃজনশীলতার বীজ বুনেছেন তিনি–তাই বা নিজের খেয়ালে এখনো ছোটবেলার মতো মাটিতে প্রতিকৃতি বানাই। মেয়েদের মুখ ‘প্রিয়’ বিষয়। সেই থেকে সুন্দরের পূজারী। সেগুলো অনেকের প্রিয় হয়েছে; আমার স্বশিক্ষা লাভ ঘটছে। শিল্পকলায় ভর্তি হয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়। তখনো জানতাম না–বড় হয়ে শিল্পী হব। আমিও চিকিৎসক কী প্রকৌশলী হতে চেয়েছি। আঁকতে, আঁকতে; মুখ বানাতে, বানাতে নবম থেকে ঠিক করলাম পড়ব চারুকলাতে। পরে জানলাম, চারুকলা হলো আঁকা, ভাস্কর্য শিক্ষার উচ্চতর শিক্ষা কেন্দ্র। এরপর ঠিকানা হলো জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগে। অনেক শিখেছি। আরও জানব ভবিষ্যতে। বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ইমাম হোসেন সুমন আমার গুরু। সবসময় আমার প্রেরণা, নানা বিষয়ে খুব ভালো জানেন। সর্বভাবে সাহায্য করেন প্রতিটি ছাত্র, ছাত্রীকে। তার শিল্পকর্মগুলো একেবারেই আলাদা, ভিন্নস্বরের। ভাস্কর্য যে মানুষের কণ্ঠ, ভাবনার প্রকাশ–তার কাছে শেখা; তার হাত ধরেই জানা। এবারের আয়োজনে ‘উইম্যান–১’ বা ‘নারী-১’ ভাস্কর্য আমাকে সেরা পুরস্কার এনে দিয়েছে। নাচে নারী নিজের ডানা মেলেছেন। অনেক যতেœ, বহুদিনে গড়তে হয় ভাস্কর্য। আগে নাম দিয়েছিলাম ‘এক্সপ্রেশন-১’ বা ‘অভিব্যক্তি-১’। পরে ‘নারী-১’; আরও পূর্ণাঙ্গ; সম্পূর্ণ করেছি। গত বছর খুশি করেছে– চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার দুটি প্রদর্শনীতে আমার ‘ইন্সপিরেশনাল আর্ট’ বা ‘উদ্দীপনামূলক শিল্পকর্ম’ অংশ নিয়ে।
যোগাযোগের বিবর্তন : শ্রীকান্ত রায় সুবীর
আমাদের পুরস্কারগুলো দেওয়া হয়েছে-২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর, মঙ্গলবার। তাতে ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিংস বিভাগের ‘শ্রেষ্ঠ পুরস্কার’ পেয়েছি। পুরো বছরের মনোযোগের, লেখাপড়ার স্বীকৃতি হয়েছে। ছবি আঁকার ভালোবাসা গড়েছেন বাবা। আমার মতো ছবি আঁকার হাতে-কলমে, পাঠের বিদ্যা পাননি। সুখেন্দু বিকাশ রায় গ্রামের মানুষ। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার দামপাড়া গ্রামের মানুষ। বাবার জীবন সেখানেই যাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম আগের নিয়মে। তার জ্যাঠা সঞ্জয় কুমার রায়ের কাছে তবলা শিখেছেন; আঁকাও। সেসব ভালোবাসা বয়ে চলেছেন আজীবন। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের তবলা শিক্ষক ও বিখ্যাত বাদক। বাড়িতে আমাদের সবসময় গানবাজনা, তবলা, হারমোনিয়াম কথা বলছে। সেই ভালোবাসা আমিও বয়ে চলেছি। বাবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছবি আঁকা ও তবলা বাদনে সমান পারদর্শী শিক্ষকতার মতো। হাতে ধরে আঁকা শিখিয়েছেন। এখনো প্রথম পরামর্শক। বিদ্যালয়ের কোনো অংকন প্রতিযোগিতাতেই পুরস্কার বাদে ফিরিনি। ২০০২, ২০০৩ ও ২০০৪ সালে পরপর তিন বছর শিল্পকলা একাডেমির সারা দেশের মধ্যে সেরা পুরস্কার লাভ করেছি স্কুলে পড়তেই। উৎসাহ বলতে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদিন ও বিখ্যাত এস এম সুলতান। তাদের আঁকা ছবির রেপ্লিকা নানাভাবে দেখে জেনেছি–সমাজের প্রতিচ্ছবি ও স্বপ্ন তাদের জীবনে মিশে আছে। ছবি সেই প্রমাণ। ধীরে, ধীরে সেভাবে; তাদের জীবন জেনে আমারও ভালোবাসার হলো শুরু। নিজে নানা কিছু করতে ভালো লাগে; এটা, সেটা বানাই। ফলে মাধ্যমিকের পরই চারুকলায় পড়তে বেরিয়ে গেলাম। ঢাকায় এসে নারায়ণগঞ্জ চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছি। দুই বছর মেয়াদের উচ্চ মাধ্যমিক শ্রণির প্রি-বিএফএ পড়া শুরু করলাম। এরপর ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ২০১৩-’১৪ সেশনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের ছাত্র হলাম। পরে অনুষদ ও আলাদা বিভাগগুলো হয়েছে। এখন কেউ বিশ্বাসই করবেন না– কোনো খালি ক্লাসরুমই পাইনি আমরা। ক্যাম্পাসের কাঁঠালগাছের নিচে খোলা আকাশের তলে ক্লাস করেছি। পরে সেটি ‘কাঁঠালতলা’ই হয়ে গিয়েছে নামে। ৪০ জন ছাত্র, ছাত্রীর এভাবে পাঠের শুরু। পরের দুটি ব্যাচও সেভাবেই ভর্তি হয়ে ক্লাস করেছেন। প্রথম ব্যাচ হিসেবে অনেক কিছুর স্বামী আমরা-শিক্ষকদের প্রেরণাও অনেক বেশিই পেয়েছি। এখনো সেই সাহায্য আছে। তবে আমার আইডল আলপ্তগীন তুষার। তিনি না থাকলে কীভাবে অনুপ্রাণিত হতাম? আমাদের বিভাগের নামকরা অধ্যাপক। এবার পেয়েছি চার বছরের অনার্সের শেষ ও বছরের সেরা প্রতিযোগিতা– ‘দ্বিতীয় বার্ষিক শিল্পকর্ম ও পুরস্কার বিতরণী’তে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। নাম দিয়েছি ‘ইভালুয়েশন অব কমিউনিকেশন’ বা ‘যোগাযোগের বিবর্তন’। ‘চিঠি’ আমার আশ্রয়। ছিল এককালে একমাত্র মনোভাব ও যোগাযোগ মাধ্যম। অনেক রকমের স্বামী। তবে এখন প্রায় হারিয়ে। আগেরবারও বিভাগের হয়ে সেরা পুরস্কারটি জয় করেছি। অংশ শিল্পকলা একাডমির জাতীয় শিল্পকর্ম প্রদর্শনীতে ‘আরাম’ নামের ভাস্কর্য নিয়ে। খুব প্রশংসা পেয়েছি। দুবার বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে জাতীয় শোক দিবসের আয়োজনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র’র প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতায় সম্মানিত হয়েছি–সম্মাননা পুরস্কার লাভ করে।
Discussion about this post