বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
এ পৃথিবীর বুকে পিতা-মাতার সম্মান ও মর্যাদা নিঃসন্দেহে শীর্ষস্থানীয়। মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্ববাসীর একমাত্র উপাস্য ও অভিভাবক। আর পিতা-মাতা হ’ল শুধু তার সন্তানদের ইহকালীন জীবনের সাময়িক অভিভাবক। সুতরাং সন্তানদের কাজ হ’ল, মহান স্রষ্টা ও পালনকর্তা আল্লাহ তা‘আলার যাবতীয় হুকুমের সাথে পিতা-মাতার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করা ও তাদের মান্য করা। সন্তান জন্মের পর বাল্য, শৈশব বা কৈশোর পর্যন্ত পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানেই থাকে এবং সম্পূর্ণ অনুগত থাকে। অতঃপর যৌবনে ও সংসার জীবনের কোন কোন ক্ষেত্রে পিতা-মাতার সঙ্গে তার সন্তানদের মতভিন্নতা দেখা দিতে পারে, এটা স্বাভাবিক। সেজন্য মহাজ্ঞানী আল্লাহ তা‘আলা পিতা-মাতার সঙ্গে তার সন্তানদের বাল্য জীবনের ভালবাসার ন্যায়ই সারা জীবন তা মযবূত ও বহাল রাখার আদেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ বলেন: ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের আদেশ দিয়েছি। তার জননী তাকে কষ্টসহকারে গর্ভে ধারণ করেছে এবং কষ্ট সহকারে প্রসব করেছে। তাকে গর্ভে ধারণ করতে ও তার দুধ ছাড়াতে লেগেছে ত্রিশ মাস। অবশেষে সে যখন শক্তি-সামর্থ্যের বয়সে ও চল্লিশ বছরে পৌঁছেছে, তখন বলতে লাগল, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে সামর্থ্য দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি দান করেছ আমাকে ও আমার পিতা-মাতাকে এবং যাতে আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকাজ করি। আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ কর, আমি তোমারই অভিমুখী হ’লাম এবং আমি আজ্ঞাবহদের অন্যতম’ [আহক্বাফ ১৫]
অন্যত্র মহান আল্লাহ এরশাদ করেন: ‘আপনার রব নির্দেশ দিলেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারও ইবাদত করো না এবং পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর। তাদের মধ্যে কেউ অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদেরকে ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিও না, আর তাদের সাথে শিষ্টাচারপূর্ণ কথা বল। অনুকম্পায় তাদের প্রতি বিনয়াবনত থেকো এবং বল, হে পালনকর্তা! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন। তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মনে যা আছে তা ভাল করেই জানেন। যদি তোমরা সৎ হও, তিনি মনোযোগীদের প্রতি ক্ষমাশীল’ [বনী ইসরাঈল ২৩- ২৫]
এ বিষয়ে আল্লাহ আরও বলেন: ‘আর আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছি। তার মাতা তাকে কষ্টের পর কষ্ট স্বীকার করে গর্ভে ধারণ করেছে। তার দুধ ছাড়ানো হয় দু’বছরে। নির্দেশ দিয়েছি যে, আমার প্রতি ও তোমার পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ হও। অবশেষে আমারই নিকট ফিরে আসতে হবে’ [লোক্বমান ১৪]
পবিত্র কুরআনের বাণীগুলোকে পরম শ্রদ্ধা ও বিনয়াবনত অন্তঃকরণে মূল্যায়ন করতে হবে। এখানে কোন দ্বিমত বা ভিন্নমত পোষণ করা হ’তে বিরত থাকতে হবে। আয়াতগুলোতে সাধারণভাবে মানুষকে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের প্রতি অবিচল থাকা ও সাথে সাথে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার, তাদের সেবা-যত্ন ও আনুগত্যের নির্দেশও দান করা হয়েছে। অবশ্য আয়াতের প্রারম্ভেই পিতা-মাতা উভয়ের সাথে সদ্ব্যবহারের আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই মাতার কষ্টের কথা উল্লেখ করার তাৎপর্য এই যে, মাতার পরিশ্রম ও কষ্ট অপরিহার্য ও যরূরী। গর্ভ ধারণের সময় কষ্ট, প্রসব বেদনার কষ্ট সর্বাবস্থায় ও সব সন্তানের ক্ষেত্রে মাতাকেই সহ্য করতে হয়। পিতার জন্য লালন-পালনের কষ্ট সহ্য করা সর্ববস্থায় যরূরী হয় না।
পবিত্র কুরআনে অনেক জায়গায় আলোচ্য বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। একইভাবে এখানেও আল্লাহর তাওহীদের প্রতি দাওয়াতের সাথে সাথে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটা পিতা-মাতার জন্য অসামান্য সম্মান ও মর্যাদা। অতঃপর সমস্ত আত্মীয়-স্বজন, আপনজন ও সম্পর্কযুক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বাগ্রে পিতা-মাতার হক সম্পর্কিত আলোচনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: ‘উপাসনা কর আল্লাহর, শরীক করো না তাঁর সাথে অপর কাউকে, পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকটাত্মীয়, ইয়াতীম-মিসকীন, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী সংগী-সাথী, মুসাফির এবং দাস-দাসীর প্রতিও। নিশ্চয়ই আল্লাহ পসন্দ করেন না দাম্ভিক-অহংকারীকে’ [নিসা ৩৬]
অন্যত্র তিনি বলেন: ‘আল্লাহ তোমাদেরকে তোমাদের মায়ের গর্ভ থেকে বের করেছেন। তোমরা কিছুই জানতে না। তিনি তোমাদেরকে কর্ণ, চক্ষু ও অন্তর দিয়েছেন, যাতে তোমরা অনুগ্রহ স্বীকার কর’ [নাহল ৭৮]
কুরআনুল কারীমে পিতা-মাতার হক সমূহকে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদত ও আনুগত্যের সাথে যুক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। যাতে বান্দা তার জীবদ্দশায় সার্বিক সতর্কতা বজায় রেখে অকৃত্রিমভাবে পিতা-মাতার ন্যায়সঙ্গত অধিকার পূর্ণ করতে সক্ষম হয়। অবশ্য বান্দার নিকট আল্লাহর হক অত্যন্ত ব্যাপক। কিন্তু সন্তানের নিকট পিতা-মাতার হক সীমাবদ্ধ। যেমন পিতা তার পুত্রকে শরী‘আত বিরোধী কোন কাজের আদেশ করলে, পুত্র তা প্রত্যাখ্যান করলেও কোন দোষ হবে না। যেমন আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় কালামে বলেছেন: ‘পিতা-মাতা যদি তোমাকে আমার সাথে এমন বিষয়কে শরীক স্থির করতে পীড়াপীড়ি করে, যার জ্ঞান তোমার নেই। তবে তুমি তাদের কথা মানবে না এবং দুনিয়াতে তাদের সাথে সদ্ভাবে সহঅবস্থান করবে। যে আমার অভিমুখী হয়, তার পথ অনুসরণ করবে। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই দিকে এবং তোমরা যা করতে, আমি সে বিষয়ে তোমাদেরকে অবগত করব’ [লোকমান ১৫]
অন্যত্র মহান আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন: ‘আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার নির্দেশ দিয়েছি। যদি তারা তোমাকে আমার সাথে এমন কিছু শরীক করার জন্য পীড়াপীড়ি করে, যার সম্পর্কে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তবে তাদের আনুগত্য করো না। আমারই দিকে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। অতঃপর আমি তোমাদেরকে বলে দিব যা কিছু তোমরা করতে’ [আনকাবূত ৮]
মানব জাতিকে এক আল্লাহর ইবাদত ও আনুগত্য করার জন্যই সৃষ্টি করা হয়েছে। অতঃপর শ্রেষ্ঠত্বের এই মর্যাদা রক্ষায় তাকে প্রচুর জ্ঞান-বুদ্ধি দান করা হয়েছে। কিন্তু মানবজাতির শত্রু ইবলীস ইবাদতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ফলে সন্তানকে সতর্ক করা হয়েছে, যাতে শয়তানের অনুগত কোন মুশরিক পিতা-মাতা পিতৃত্বের দাবী নিয়ে নিজ সন্তানদের শিরক স্থাপনে বাধ্য করতে না পারে। কারণ শিরক হ’ল অমার্জনীয় পাপ। এখানে মহান আল্লাহর পক্ষ হ’তে অধিকার প্রাপ্ত পিতা-মাতা ও সন্তান উভয়কেই শিরকমুক্ত থেকে ইসলামের প্রতি সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিগ্রহণের কঠোর নির্দেশ রয়েছে।
Discussion about this post