শিক্ষার আলো ডেস্ক
দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেই বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জাতীয় মাছ ইলিশের প্রাচুর্যতা কমে যাওয়ায় সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ইলিশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। পাথফাইন্ডার রিসার্চ অ্যান্ড কনসালটেন্সি সেন্টারের সহযোগিতায় তিন তরুণ গবেষকের এক গবেষণায় বাংলাদেশে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন, মৎস্য সংরক্ষণ ও জেলেদের জীবিকা উন্নয়নের জন্য ক্ষতিপূরণ, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো উঠে এসেছে।
সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের পিএইচডি গবেষক ও পাথফাইন্ডার রিসার্চ অ্যান্ড কনসালটেন্সি সেন্টারের ডিরেক্টর আতিকুর রহমান সানী গবেষণাটি তত্ত্বাবধান করছেন। আর এ গবেষণা পরিচালনা করছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সায়েন্টিফিক অফিসার মাহমুদুল হাসান মিথুন ও পাথফাইন্ডার রিসার্চ অ্যান্ড কনসালটেন্সি সেন্টারের রিসার্চ অফিসার শরীফ আহমেদ সাজ্জাদ।
অভিনবত্ব ও চমৎকার তাৎপর্যের কারণে গবেষণাটি কানাডার বিখ্যাত টিবিটিআই গ্লোবাল পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত ‘স্মল ইন স্কেল, বিগ ইন কন্ট্রিবিউশন: অ্যাডভান্সিং নলেজ অব স্মল স্কেল ফিশারিজ ইন বাংলাদেশ’ বইয়ে প্রকাশিত হয়। বইটি সম্পাদনা করেন টিবিটিআই-বাংলাদেশের প্রধান অধ্যাপক ড. মো. মাহমুদুল ইসলাম।
গবেষণাপত্র সূত্রে জানা যায়, ১৯৮০-র আগে দেশের ১০০টিরও বেশি নদীতে ইলিশের প্রাচুর্যের কারণে সমাজের দরিদ্রতম গোষ্ঠীতেও ইলিশ সাশ্রয়ী ছিল। কিন্তু ২০০১ থেকে ২০০৩-এর মধ্যে ইলিশের প্রাপ্যতা ২৪ লাখ মেট্রিক টন থেকে হ্রাস পেয়ে ২ লাখ মেট্রিক টন হয়। ইলিশ কমে যাওয়ার কারণগুলো বোঝার জন্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং সম্পদ ব্যবস্থাপনার জন্য ২০০৩ সালে সরকার একটি ইলিশ ফিশারিজ ম্যানেজমেন্ট অ্যাকশন প্ল্যান (এইচএফএমএপি) গ্রহণ করে, যাতে টেকসইভাবে ইলিশের উৎপাদনের মাত্রা সর্বাধিক করা যায় এবং জেলেদের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতি হয়।
মাহমুদুল হাসান মিথুন জানান, এই প্রকল্পের অধীন সরকার পদ্মা, মেঘনা, তেঁতুলিয়া, আন্ধারমানিক নদী এবং সংশ্লিষ্ট শাখা নদীগুলোতে ৪৩২ কিলোমিটারেরও বেশি দৈর্ঘ্যজুড়ে ছয়টি ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করেছে এবং বিভিন্ন মাছ ধরার নিষিদ্ধ মৌসুম কার্যকর করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে অভয়াশ্রমে ইলিশ মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা এবং জাটকা ধরার নিষেধাজ্ঞা, বঙ্গোপসাগরে সামুদ্রিক মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা এবং কাপ্তাই হ্রদে মিঠা পানির মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা।
এ বিষয়ে শরীফ আহমেদ সাজ্জাদ জানান, ইলিশের অভয়াশ্রমে নিষেধাজ্ঞার সময় সরকার প্রতি পরিবারকে চার মাসের জন্য ৪০ কেজি করে চাল দিয়ে থাকে। এই ক্ষতিপূরণ শুধু ইলিশ জেলেদের জন্য দেয়া হয়। যদিও অন্যান্য জেলেও ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ, নিষেধাজ্ঞার সময় অভয়াশ্রমে অন্যান্য প্রজাতির মাছ ধরাও ব্যাহত হয়। তাই অসন্তোষের কারণে, অ-ইলিশ জেলেরাও তাদের সামাজিক-রাজনৈতিক সংযোগের মাধ্যমে নিজেদের ইলিশ জেলে হিসেবে নিবন্ধিত করে চাল পাওয়ার চেষ্টা করেন।
সার্বিক বিষয় নিয়ে আতিকুর রহমান সানী জানান, সরকার ইলিশ সংরক্ষণের জন্য সরাসরি সহায়তা প্রদান করে আসছে, যা অতীতে বিভিন্ন গবেষণায় বিভিন্ন শব্দের মাধ্যমে উঠে এসেছে। যেমন: বিকল্প আয়বর্ধন কর্মসূচি (এআইজিএ), ইনসেনটিভ, ক্ষতিপূরণ স্কিম (কম্পেনসেশন স্কিম), ব্যান পিরিয়ড অ্যালাউন্স এবং পেমেন্ট ফর ইকোসিস্টেম সার্ভিসেস (পিইএস) ইত্যাদি। ইলিশ সংরক্ষণের জন্য সহযোগিতাগুলো পর্যালোচনা করে (চাল বিতরণ, পশু পালন এবং ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপের প্রশিক্ষণ, বিকল্প আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রম, নগদ অর্থ, সুদমুক্ত ঋণ ও সেলাই মেশিন বিতরণ ইত্যাদি) আমাদের গবেষণায় এটি প্রতীয়মান হয় যে বাংলাদেশে ইলিশ সংরক্ষণের জন্য যে সহায়তা দেয়া হয়, তা হলো ক্ষতিপূরণ পরিকল্পনা। একটি উন্নত ক্ষতিপূরণ স্কিম ও টেকসই অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থাপনার জন্য জীবিকা উন্নয়ন এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ উভয়কেই সমান গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি আরও জানান, বাংলাদেশ ঘনঘন জলবায়ু বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়, যা মৎস্যজীবীদের আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। যদিও এই নিষেধাজ্ঞাগুলো পরিবেশগত বা মৎস্য উৎপাদনজনিত ফলাফল অর্জনে কার্যকর। এর ফলে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর নির্দিষ্ট সময়ে আয় কমে যাওয়া, দীর্ঘমেয়াদি ঋণগ্রস্ততা এবং কম পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ জেলেদের জীবিকার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কোনো ফলোআপ বা পোস্ট মনিটরিং না থাকায় জেলেরা বিকল্প আয় তৈরিতে প্রাপ্ত সহায়তা কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারছে না। ফলে সরকারের এই মহৎ উদ্যোগের আশানুরূপ ফলাফল পাওয়া কঠিন হচ্ছে। এ ছাড়া জাতীয় গড়ের তুলনায় জেলেদের সাক্ষরতার হার কম হওয়ায় অন্য দক্ষ পেশায় সহজে অংশগ্রহণ করতেও পারছে না। বছরের নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় অস্থায়ী কর্মসংস্থান পরিচালনা করাও তাদের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। এ জন্য কমিউনিটি চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সংশোধন করা উচিত। পাশাপাশি, জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা সহায়তা বিবেচনায় নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে পরিকল্পনা করা এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। সৌজন্যে-সময়টিভিনিউজ
Discussion about this post