প্রযুক্তি ডেস্ক
সাইবার এক্সপার্টদের মতে নাম্বার ছড়ানোর কাজটি বেশির ভাগ সময় গ্রাহকের ভুলেই হয়ে থাকে। এখন দেশে প্রায় ৬ কোটি স্মার্টফোন ব্যবহারকারী আছে। যাদের বেশিরভাগই অ্যান্ড্রয়েড ইউজার। অপারেটিং সিস্টেম সচল করতে মেইল এড্রেস বাধ্যতামূলক। আর মেইল এড্রেসের জন্য মোবাইল নাম্বার বাধ্যতামূলক। ফলাফল, মেইল এড্রেস এবং মোবাইল নাম্বার দুটোই প্রয়োজন স্মার্টফোনের অপারেটিং সিস্টেমকে সচল করতে। স্মার্টফোনে প্লে-স্টোর অ্যাকটিভ চালু করার সময় টার্মস এন্ড কন্ডিশনে গুগল কিন্তু আগেই আপনার নাম্বার বিভিন্ন জায়গায় ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে নেয়।
যে ভুলটি অনেকেই করেন, সেটা পড়েন না। সরাসরি অ্যাপ্রুভ করে দেন। এতে করে গুগল আপনার নাম্বার, ছবি, ভিডিও এবং মেইল আইডিকে ব্যক্তিগত হিসেবে না নিয়ে পাবলিক হিসেবে নিয়ে নেয়। এটি পরে ওপেন ডেটা বা উন্মুক্ত তথ্য হিসেবে যেকোনো প্রতিষ্ঠান সংগ্রহ করে নিতে পারে।
নিজের মোবাইল নাম্বার ছড়িয়ে পড়ার আরেকটি মাধ্যম হলো অনলাইন সেবা। আপনি যখন কোনো ই-কমার্স সাইট থেকে পণ্য কিনছেন, ফুড অ্যাপে খাবার অর্ডার দিচ্ছেন, রাইড শেয়ারে যানবাহন ডাকছেন, পার্সেল পাঠাচ্ছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফ্রি-অনলাইন কোর্সের চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে রেজিস্ট্রেশন করছেন, অজস্র গেমিং অ্যাপ, সফটওয়্যার নামাচ্ছেন সেগুলোও আপনার ব্যক্তিগত নাম্বারটিকে ছড়িয়ে দিচ্ছে বিভিন্ন মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান আর সুযোগ সন্ধানী কল সেন্টারের হাতে। ফলাফল, উত্তর থেকে দক্ষিণ মেরুতে ছড়িয়ে যাচ্ছে আপনার নাম্বার।
করণীয় কী?
সরকারের ডিজিটাল লিটারেসি কর্তৃপক্ষ মূলত তিনটি ধাপে এর সমাধানের পথ বলেছে। প্রথমত সাবধানতা, দ্বিতীয়ত অনুসন্ধান, এবং তৃতীয়ত আইনি পদক্ষেপ। শুরুতে সাবধানতার জায়গাতে আসি।
ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার ক্ষেত্রে সতর্কতা
বিভিন্ন প্রয়োজনে অনলাইন মাধ্যমে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার ক্ষেত্রে সচেতন না থাকলে বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হয়। সেজন্য ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার ক্ষেত্রে কী কী সতর্কতা ব্যবস্থা নেয়া উচিত সে সম্পর্কে সকলেরই জানা উচিত।
১) সামাজিক মাধ্যমে অ্যাকাউন্টের তথ্য
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেমন ফেসবুক, টুইটার, লিংকড-ইন এগুলোতে অ্যাকাউন্ট করার সময় কিছু ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয়। এসব তথ্য দিয়ে প্রোফাইল সম্পূর্ণ করা লাগে।
– এসব তথ্যে প্রাইভেসি সেটিংস পরিবর্তন করে ব্যক্তিগত তথ্য শুধুমাত্র যার অ্যাকাউন্ট তার জন্য দৃশ্যমান করে রাখতে চাইলে only me অপশনটি নির্বাচন করতে হবে।
– যারা বন্ধু তালিকায় আছে তাদের কাছে দৃশ্যমান রাখতে চাইলে friends, সবার জন্য দৃশ্যমান রাখতে চাইলে Public করবেন।
-এবং কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে দৃশ্যমান রাখতে চাইলে Specific Friends, গোপন রাখতে চাইলে Friends Except, শুধু কাছের বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে চাইলে Close friends এবং একসাথে কয়েকজন থেকে গোপন/দৃশ্যমান রাখতে চাইলে Custom অপশনে গিয়ে সেসব ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট নির্বাচন করে দিতে পারবেন।
– ব্যক্তিগত তথ্যের মধ্যে যেগুলো খুব বেশি জরুরি তথ্য যেমন ফোন নাম্বার, ই-মেইল এড্রেস, বিস্তারিত ঠিকানা, ব্যাংক অ্যাকাউন্টের তথ্য এসবের প্রাইভেসি সেটিংস ‘Only me’ রাখা উচিত।
আরও পড়ুনঃ শব্দ শুনেই ঝটপট ভিডিও তৈরি করে দেবে ‘সোরা’ !
২) সামাজিক মাধ্যমে শেয়ার করা কন্টেন্ট
সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয়ে মতামত, ছবি, লেখা, জীবনযাপন, ভ্রমণ সম্পর্কিত তথ্য শেয়ার করার ক্ষেত্রে প্রাইভেসি সেটিংস কন্টেন্ট ভেদে ঠিক করে দিবেন। খুব বেশি ব্যক্তিগত তথ্য হলে Only me বা Friends দিতে পারেন। আবার আরেকটি প্রাইভেসির সুযোগ আছে তা হলো অ্যাকাউন্ট লক করে রাখা। অ্যাকাউন্ট লক করা থাকলে বন্ধু তালিকায় নেই এমন কেউ আপনার অ্যাকাউন্টের নাম এবং প্রোফাইল ছবি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবে না।
৩) বিভিন্ন অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটে থাকা ব্যক্তিগত তথ্য
কোন অ্যাপ ইন্সটল করলে বা কোন ওয়েবসাইটে অ্যাকাউন্ট করার ক্ষেত্রে কিছু ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হয়। যেমন নাম, ফোন নাম্বার, অ্যাকাউন্ট নাম্বার, পাসওয়ার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার, পাসপোর্ট নাম্বার, ডেবিট-ক্রেডিট কার্ডের তথ্য ইত্যাদি দিতে হতে পারে। এসব ওয়েবসাইট বা অ্যাপের প্রয়োজনের বাইরে কোন তথ্য চাইলে সেসব দেয়া থেকে বিরত থাকুন। বা প্রয়োজনে এগুলো বাদ দিয়ে একই কাজ করা যায় এমন অন্য কোন অ্যাপ বা ওয়েবসাইট ব্যবহার করুন।
পাশাপাশি কিছু ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে এবং অ্যাপ ডাউনলোড করলে এসব জায়গায় আপনার ডিভাইসের কিছু অংশ যেমন গ্যালারি, ফোনবুক, মেসেজ, ক্যামেরা, লোকেশন ইত্যাদিতে প্রবেশের অনুমতি দিতে হয়। এসব জায়গায় অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় অংশের অনুমতি দিন। এবং এইগুলো শুধুমাত্র অ্যাপ ব্যবহারের সময়ের জন্য অনুমোদন করুন।
আবার অনেক ওয়েবসাইট গ্রাহকের অনলাইন সক্রিয়তা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে যেমন cookies, search history, password, email ইত্যাদি। এই তথ্যগুলো সংগ্রহ করা ওয়েব ব্রাউজিং এর ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয়। কিন্তু এসব তথ্য সংগ্রহের অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে যাচাই করে তারপর অনুমতি দেয়া উচিত।
৪) অপরিচিত কোন ওয়েবসাইট বা অ্যাপে তথ্য দেয়া
কোন ওয়েবসাইট যদি মনে হয় যে আসল না বা সন্দেহজনক কিছু পান তাহলে সেসব ওয়েবসাইট তথ্য দেয়া থেকে বিরত থাকুন। যেকোনো জায়গায় ব্যক্তিগত তথ্য দেওয়ার ক্ষেত্রে নিশ্চিত না হয়ে দিবেন না। নাহলে ফিশিং অথবা হ্যাকিং এর শিকার হতে পারেন।
আইনি পদক্ষেপ
নিজের ব্যক্তিগত নাম্বারটি ছড়িয়ে পড়া এবং বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যমে হয়রানি হওয়াটা সাইবার ক্রাইমের মধ্যে পড়ে। সে হিসেবে আপনি যদি মনে করেন আপনার ব্যক্তিগত নাম্বারটি ছড়িয়ে পড়েছে । তাহলে প্রথম সুযোগেই জিডি করে রাখা ভালো। এখন জিডি অনলাইনেই করা যায়।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বলছে অভিযোগ জানানোর জন্য নিম্নোক্ত উপায়ে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে: প্রাথমিকভাবে অভিযোগ জানানো যেতে পারে নিকটস্থ থানায়।
নারীরা Police Cyber Support for Women PCSW নামে ফেসবুক পেইজে মেসেজ দিয়ে অভিযোগ জানাতে পারেনা। অথবা cybersupport.women@police.gov.bd তেও ই-মেইল করতে পারেন।
এছাড়া নারী-পুরুষ সবার জন্য cyberhelp@dmp.gov.bd ইমেইলে অভিযোগ জানানোর সুযোগ আছে। এর বাইরে পুলিশ সদর দপ্তরের ০১৩২০০০০৮৮৮ নাম্বারে ফোন করে অভিযোগ জানানো যাবে। হটলাইন নাম্বার ৯৯৯ -এ ফোন করেও অভিযোগ করা যাবে।
সরাসরি কথা বলার প্রয়োজনবোধ করলে দরজা খোলা ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ডিভিশনের Cyber Crime Unit অফিসে। ঠিকানা: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, ৩৬, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী স্মরণী, রমনা, ঢাকা। আর সরাসরি কথা বলতে দায়িত্বরত কর্মকর্তার সাথে এই নাম্বারে –০১৭৬৯৬৯১৫২২ যোগাযোগ করা যাবে।
সাইবার অপরাধের শিকার হলে যত দ্রুত সম্ভব অভিযোগ জানানো উচিত। অভিযোগ করার ক্ষেত্রে আপনার অভিযোগের স্বপক্ষে কিছু প্রমাণাদি প্রয়োজন। যেমন এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আলামতের স্ক্রিনশট, লিংক, অডিও/ভিডিও ফাইল অথবা রিলেটেড ডকুমেন্টস। স্ক্রিনশট সংগ্রহের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যেন Address Bar এর URL টি দৃশ্যমান হয়। ই-মেইল এর মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে চাইলে এসব কন্টেন্ট যুক্ত করে আপলোড করা যাবে।
আপনি প্রয়োজনে Cyber Crime Unit –এর অফিসারদের থেকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। যা আপনার আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সহায়ক হতে পারে।
Discussion about this post