মুফতি ইবরাহিম সুলতান
মানুষ মানুষের জন্য, সম্পদ জীবনের জন্য। সম্পদের সংকটে যদি জীবনপ্রবাহ থেমে যায় তখন সম্পদ উপার্জনের মৌলিক উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। রাজা-প্রজা, উজির-নাজির, ধনী-দরিদ্র—নির্বিশেষে সবাই আল্লাহর সৃষ্ট জীব মানুষ। মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়াবে, মুসলমান মুসলমানের কল্যাণে হাত বাড়াবে, বিপদে-আপদে সান্ত্বনার কোমল পরশ বুলাবে—এটাই মানবতা। এটাই ইসলামের শিক্ষা।
হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, ‘সব মুমিন এক দেহের মতো, যদি তার মাথায় ব্যথা হয় তখন তার সারা শরীরই ব্যথিত হয়। আর যদি তার চক্ষু অসুস্থ হয়, তখন তার সর্বাঙ্গ অসুস্থ হয়ে পড়ে। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস ১৮৪৩৪)
মানবতার এই আদর্শ ও শিক্ষাকে নবীজি (সা.) বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। প্রায় ১৫০০ বছর আগে এক ঐতিহাসিক মানবিক ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি, ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই। সে তার ওপর জুলুম করবে না এবং তাকে জালিমের হাতে সোপর্দ করবে না। যে কেউ তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার বিপদসমূহ দূর করবেন।’ (বুখারি, হাদিস ২৪৪২)
মসজিদের মিম্বরে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান নবীজির
একবারের ঘটনা, রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবাদের নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা করছিলেন। এ সময় মুজার গোত্রের কিছু লোক খালি পায়ে, বস্ত্রহীন, গলায় চামড়ার আবা পরিহিত এবং নিজেদের তরবারি ঝুলন্ত অবস্থায় নবীজির কাছে এলেন। ক্ষুধা, যন্ত্রণা আর অভাব-অনটনে তাদের করুণ অবস্থা দেখে নবীজির মুখমণ্ডল বিষণ্ন হয়ে গেল। দ্রুত মজলিস ত্যাগ করে তিনি ভেতরে প্রবেশ করে বেরিয়ে এলেন। প্রিয় সাহাবি বেলাল (রা.)-কে আজান দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। নামাজ শেষ করে উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশে খুতবা প্রদান করলেন। খুতবার শুরুতে কোরআন মাজিদের একটি আয়াত পাঠ করলেন। ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালককে ভয় করো, যিনি তোমাদেরকে একটি মাত্র ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং তার থেকে সঙ্গিনী সৃষ্টি করেছেন, যিনি তাদের দুজন থেকে বহু নর-নারী (পৃথিবীতে) বিস্তার করেছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা তোমাদের রক্ষণাবেক্ষণকারী। (সুরা : নিসা, আয়াত : ১)
অতঃপর তিনি সুরা হাশরের শেষের দিকের এই আয়াতটি পাঠ করলেন : ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং প্রত্যেকেই ভেবে দেখো, ভবিষ্যতের জন্য তোমরা কী সঞ্চয় করেছ। তোমরা যা করো, সে বিষয়ে আল্লাহ সম্যক অবগত। (সুরা : হাশর, আয়াত : ১৮)
নবীজির দরদমাখা কোরআনের এই আয়াতগুলো শুনে কেউ কেউ তাদের সঞ্চিত দিরহাম, কাপড়, এক সা আটা, কেউ বা এক সা খেজুর দান করলেন। সব শেষ নবীজি বললেন, অন্তত এক টুকরা খেজুর হলেও নিয়ে আসো।
বর্ণনাকারী মুনজির ইবনে জারির (রা.) বলেন, নবীজির এ কথা শোনার পর আনসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি একটি বিরাট থলি নিয়ে এলেন। থলির ভারে তার হাত অবশ হয়ে যাচ্ছিল। তিনি আরো বলেন, সারিবদ্ধভাবে একের পর এক দান করতে থাকল। এমনকি খাদ্য ও কাপড়ের দুটি স্তূপ হয়ে গেল। এ অবস্থা দেখে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারা মোবারক খাঁটি সোনার ন্যায় উজ্জ্বল হয়ে হাসতে লাগল। প্রিয় নবীজির প্রতি তাদের ভালোবাসা দেখে উপস্থিত সাহাবিদের উদ্দেশ করে তিনি বললেন, যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোনো উত্তম প্রথা বা কাজের প্রচলন করে, সে তার কাজের সওয়াব পাবে এবং তার পরে যারা তার এই কাজ দেখে তা করবে এর বিনিময়েও সমপরিমাণ সওয়াব পাবে। তবে এতে কোনো অংশে তাদের সওয়াব কমানো হবে না। আর যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে ইসলামপরিপন্থী কোনো খারাপ প্রথা বা কাজের প্রচলন করবে, তাকে তার এ কাজের বোঝা (গুনাহ এবং শাস্তি) ভোগ করতে হবে। তারপর যারা তাকে অনুসরণ করে এ কাজ করবে, তাদের সমপরিমাণ বোঝাও তাকে বইতে হবে। তবে এতে তাদের অপরাধ ও শাস্তি কোনো অংশেই কমবে না। (মুসলিম, হাদিস ১০১৭)
অভাবীদের পাশে নবীর পরিবার
আম্মাজান আয়েশা (রা.) বলেন, একদিন এক ভিখারিণী দুটি শিশুকন্যা নিয়ে আমার কাছে এসে কিছু চাইল। এ সময় আমার কাছে একটি খেজুর ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। আমি একটি খেজুর তাকে দিলাম। সে নিজে না খেয়ে খেজুরটি দুই ভাগ করে তার দুই কন্যাকে দিল। এরপর ভিখারিণী বেরিয়ে চলে গেল। এই মুহূর্তে নবীজি আমাদের কাছে এলে আমরা তাঁর কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলি। নবীজি তা শুনে বললেন, যাকে এরূপ কন্যাসন্তানের ব্যাপারে কোনো পরীক্ষা করা হয়, তবে সে কন্যাসন্তান তার জন্য জাহান্নামের আগুন থেকে পর্দা হয়ে দাঁড়াবে। (বুখারি, হাদিস ১৩৩৪)
নবীজির আহ্বানে অভাবীদের পাশে সাহাবাদের প্রতিযোগিতামূলক সাড়া
সংকটকালে বিপন্ন-অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং তাদের দান-সদকা করা—এটা মুমিন বান্দার আর্থিক ইবাদাত। এ কাজে পিছিয়ে ছিলেন না সাহাবায়ে কেরামরাও। দান-সদকা ও কল্যাণের এ কাজে তাঁরা প্রতিযোগিতা করতেন।
ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) বলেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) আমাদেরকে দান করার নির্দেশ দেন। ঘটনাক্রমে সেদিন আমার কাছে বেশ কিছু সম্পদ ছিল। আমি মনে মনে ভাবলাম, আজ আমি আবু বকর (রা.)-এর চেয়ে দানে অগ্রগামী হব। যদিও কোনো দিন আমি দানে তাঁর থেকে অগ্রগামী হতে পারিনি। তাই আমি আমার সম্পদের অর্ধেক নবীজির দরবারে নিয়ে এলাম। নবীজি তা দেখে জিজ্ঞেস করলেন, হে ওমর! তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছ? আমি বললাম, এর সমপরিমাণ সম্পদ। এদিকে হজরত আবু বকর (রা.) তাঁর সব সম্পদই নিয়ে এলেন। নবীজি তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আবু বকর! তুমি তোমার পরিবার-পরিজনের জন্য কী রেখে এসেছ। তিনি উত্তরে বললেন, আমি তাদের জন্য আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলকে রেখে এসেছি। এ ঘটনা দেখে ওমর (রা.) হজরত আবু বকর (রা.)-কে বললেন, ভবিষ্যতে কোনো দিন কোনো ব্যাপারে অধিক ফজিলতের অধিকারী হওয়ার জন্য আমি আপনার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করব না। (আবু দাউদ, হাদিস ১৬৭৮)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সুমহান মানবিক চেতনা ধারণ করে সংকটকালীন এ পরিস্থিতিতে বিত্তবানদের- অসহায় ও অভাবী মানুষের পাশে দাঁড়ানো এখন সময়ের দাবি। তা ছাড়া ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ বিধান ‘সদকাতুল ফিতর’ আদায়ের উত্তম সময়ও এটা।
আসুন! সংকটময় এই মুহূর্তে আমরা মানবতার সেবায় এগিয়ে আসি। অসহায়দের প্রতি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দিই।
Discussion about this post