সোহেল রানা
‘স্যার, আমার মা বছরখানেক আগে আপনার কাছে বাইপাস সার্জারি করিয়েছেন। দু-তিন দিন ধরে তার বুকে প্রচণ্ড ব্যথা আর শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। খুব খারাপ অবস্থা। মা তো গ্রামের বাড়িতে থাকেন, আমি ঢাকায়। এখন আমি কী করব?’ উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে মায়ের শারীরিক অবস্থার কথা এভাবেই মোবাইল ফোনে ডা. মো. লোকমান হোসেনকে জানাচ্ছিলেন শাহিন আলম নামের এক ব্যক্তি। তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপত্র পাঠালেন এই চিকিৎসক। সেইসঙ্গে দিলেন প্রয়োজনীয় নির্দেশনা। ডা. লোকমান রাজধানীর ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের সিনিয়র কনসালট্যান্ট ও সার্জন। তার টেলিমেডিসিন সেবা মিলছে এখন বিশ্বজুড়ে।
একটি ফোনকলেই চিকিৎসকের এমন মানবিক সেবা পেয়ে মুহূর্তেই স্বস্তি ফিরে পান শাহিন। তিনি বলেন, করোনার এই সময়ে মাকে নিয়ে এমনিতেই দুশ্চিন্তায় ছিলাম। এরই মধ্যে হঠাৎ তিনি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ায় খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। কোথায় তাকে নেব, কার কাছে যাব, তা ভেবেই দিশেহারা হচ্ছিলাম। যেহেতু ডা. লোকমান মায়ের সার্জারি করেছিলেন, তাই প্রথমেই তাকে ফোন করি, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাড়া দেন, ওষুধ লিখে দেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে যানবাহন বন্ধ থাকায় টেলিমেডিসন সার্ভিসটা না থাকলে বড় বিপদ হতো।
করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে একেবারে সম্মুখ সারিতে আছেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা। তবে অন্যদের বাঁচাতে গিয়ে তাদের মধ্যে অনেকেই এরই মধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন; হারাচ্ছেন প্রাণও। অবশ্য উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চিকিৎসা না পাওয়ার অভিযোগও উঠছে। তবে অনেক চিকিৎসক নিজ উদ্যোগেই সংকটের শুরু থেকে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। দিনরাত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। তাদেরই একজন ডা. লোকমান হোসেন। তিনি পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে রোগীদের সেবা দিচ্ছেন ফেসবুক ও মোবাইল ফোনে।
ডা. লোকমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি আর যান চলাচল বন্ধ থাকায় হাসপাতালে খুবই কম রোগী আসছেন। ফলে অনলাইন ও মোবাইল ফোনে রোগীদের বেশি সময় দিচ্ছি। কোনো রোগী সমস্যা অনুভব করলে বা অসুস্থ হলে স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ইসিজি, রক্ত পরীক্ষা, এক্সরেসহ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি। পরে সেসব দেখেশুনে ওষুধসহ পরামর্শ দিচ্ছি।
তিনি বলেন, টেলিমেডিসিন সেবা চালুর পর থেকে খুব সাড়া পাচ্ছি। সারাদেশের মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকেও যোগাযোগ করে সেবা নিচ্ছেন রোগীরা। প্রবাসী অনেক বাংলাদেশি আমাকে বলেছেন, করোনাকালে টেলিমেডিসিন সেবাই মূল অবলম্বন হয়ে উঠলেও সংশ্নিষ্ট দেশের ভাষা খুব একটা না বুঝায় এই সেবাটি তারা সেভাবে নিতে পারছেন না। সে কারণেই তারা বাংলাদেশের চিকিৎসকদের সেবার প্রতি ঝুঁকেছেন।
ডা. লোকমান আরও বলেন, দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে ইন্টারনেট নেই, সেখান থেকে কেউ ফোন করলে তাকে পার্শ্ববর্তী ফার্মেসিতে যেতে বলি, ফার্মেসির কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে রোগীকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও পরামর্শ দিই।
তিনি বলেন, এই সময়ে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে থাকাদের মধ্যে হৃদরোগী অন্যতম। কারণ করোনার আক্রমণ ফুসফুস দিয়ে শুরু হয়। আর ফুসফুসের পাশেই হৃদযন্ত্রের অবস্থান। এ ছাড়া কিডনি, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপসহ জটিল রোগে যারা ভুগছেন, তাদের জন্যও এই সময়টা খারাপ।
করোনা থেকে বাঁচতে সচেতনতার পরামর্শ দিয়ে ডা. লোকমান বলেন, যেকোনো প্রয়োজনে পরিবারের একজনই সবসময় সুরক্ষা মেনে বাইরে যাবেন। কাজ সেরে দ্রুত বাসায় ঢুকেই কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করে ফেলবেন। দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর বিষয়টিকে প্রাধান্য দিতে হবে। শাকসবজিসহ পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। যাদের হৃদযন্ত্রের পাম্পিং পাওয়ার কম তাদের পানিসহ অন্যান্য খাবার খেতে হবে ধাপে ধাপে। একবারে বেশি খাবার খেলে হৃদযন্ত্র লোড নিতে পারে না।
টেলিমেডিসিন সেবা দেওয়ার অনুভূতি জানতে চাইলে মানবদরদি এই চিকিৎসক বলেন, প্রথমত মানুষের জন্য কিছু করতে পারছি সেটা ভেবেই ভালো লাগে। আর যখন মানুষ কৃতজ্ঞতা জানায়, খুশি হয়, স্বস্তি পায়; তখন সেই ভালো লাগার আসলে কোনো সীমা থাকে না, এই ভালো লাগা কাউকে বোঝানো যাবে না।সৌজন্যে-সমকাল
Discussion about this post