শিক্ষার আলো ডেস্ক
‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার সোনার বাংলায়, ধর্ষকদের ঠাই নাই’, ‘তুমি কে আমি কে, আছিয়া আছিয়া’—মধ্যরাতে এমন স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। শনিবার দিবাগত রাত ২টা থেকে রাজু ভাস্কর্যে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের এই বিক্ষোভ চলে টানা দুই ঘণ্টা। পরে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করার আল্টিমেটাম দিয়ে হলে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
এর আগে শনিবার দিবাগত রাত ১২টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রীরা বিক্ষোভ-মিছিল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। তাঁদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ হলের শিক্ষার্থীরাও যোগ দেন। এরপর হল পাড়া থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল বের হয়। একপর্যায়ে শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন।
মাগুরায় ৮ বছরের শিশুর ধর্ষকদের সর্বোচ্চ শাস্তিসহ, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনায় দ্রুত শাস্তি কার্যকরের দাবি শিক্ষার্থীদের।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে হেনস্তার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের একজন কর্মচারীকে পুলিশ গ্রেপ্তারের পর তৌহিদী জনতা নাম দিয়ে একদল ব্যক্তি থানার সামনে অবস্থান নিয়ে হট্টগোল করে। পরে বৃহস্পতিবার ওই ব্যক্তি আদালতে জামিন পান।
এ ঘটনার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি দাবি করে বিবৃতি দিয়েছেন। এর মধ্যেই মাগুরায় একটি শিশু নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা ব্যাপকভাবে আলোচনায় এসেছে। ওই শিশুর অবস্থা ‘ক্রিটিক্যাল’ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বিক্ষোভে স্লোগানের পাশাপাশি পদত্যাগ দাবি করা হয় অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর। শিক্ষার্থীরা তাঁর পদত্যাগের দাবিতে ‘এক দুই তিন চার, জাহাঙ্গীর গদি ছাড়’, ‘স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ চাই’, ‘জাহাঙ্গীর করে কী, খাই দাই ঘুমায় নাকি’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
এ সময় ধর্ষণবিরোধী দ্রুত ট্রাইবুনাল গঠন ও ধর্ষকদের প্রকাশ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের দুটি দাবিও জানানো হয়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার নারীদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। পুলিশ-সেনাবাহিনীসহ কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না। মাগুরায় আট বছরের শিশুকে ধর্ষণের মতো অমানবিক ও নৃশংস ঘটনার পরও এখনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ধর্ষককে আদালতে উপস্থাপন করেনি। বাধ্য হয়ে আমরা মধ্যরাতে রাস্তায় নেমে এসেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও একই দাবিতে মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ,রাজশাহী , জগন্নাথ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) শিক্ষার্থীরা। রাজধানীতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি ও বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরাও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন।
রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ধর্ষকদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন করে মুখে লাল কাপড় বেঁধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের নারী শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
ধর্ষণের বিরুদ্ধে মানববন্ধন করেছেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বুয়েট একতাবদ্ধ উল্লেখ করে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডসহ ছয়টি দাবি উত্থাপন করেছেন তারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্টে এবং শেখ হাসিনা হলের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিলটি শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব হলের সাধারণ শিক্ষার্থীরা যোগ দেন। তারা ধর্ষণের অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানান।
রোববার (৯ মার্চ) দুপুর দুইটার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক শহিদ মিনারের পাদদেশে একটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে।
একই সময় চারুকলা বিভাগ, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহিদ মিনারে এসে তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কর্মসূচিতে অংশ নেয়।
পরে সমাবেশ শেষে শহিদ মিনারের পাদদেশ সংলগ্ন সড়কে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন তারা।
সারা দেশে ধর্ষণ ও নিপীড়নের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের দাবিতে মশাল মিছিল করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। রোববার সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্ত চত্বর থেকে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। বিক্ষোভ মিছিলটি ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয়ে পুরান ঢাকার তাঁতীবাজার মোড়ে হয়ে ক্যাম্পাসে ফিরে আসে।
রোববার দুপুর ১২টার দিকে রাজধানীর নতুনবাজার এলাকায় কুড়িল-বাড্ডা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন নর্থ সাউথ, ব্র্যাক, ইউআইটিএস, ডিআইইউসহ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শতাধিক শিক্ষার্থী ।প্রায় দেড় ঘণ্টা বিক্ষোভের পর ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়ে ফিরে যান শিক্ষার্থীরা।
ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে মশাল মিছিল ও বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) শিক্ষার্থীরা। রাত সাড়ে নটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গোল চত্বর থেকে মশাল মিছিল শুরু হয়। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এসময় ধর্ষনের বিরুদ্ধে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন। পরে, প্রধান ফটকে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশে বক্তারা চলমান নারী নির্যাতন পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও সন্ধ্যার পর মশাল মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীরা। মিছিলটি ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে। এসময় শিক্ষার্থীরা বলেন, শুধু ধর্ষণ নয় সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়েছে। ধর্ষণে জড়িতদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিতের ওপর জোর দেন তারা।
এসব সমাবেশ থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মাগুরায় শিশু ধর্ষণে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে। নারীদের নিরাপত্তায় ব্যর্থতার দায়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। ঢাবিতে নারী শিক্ষার্থীদের নিয়ে ‘ধর্ষণবিরোধী মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
এতে নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণসহ অব্যাহত নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর অপসারণ এবং দ্রুত ট্রাইব্যুনালে সব ধর্ষণকাণ্ডের বিচারসহ ৯ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। অন্য দাবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেÑ সারা দেশে অব্যাহত ধর্ষণ, নারী নিপীড়ন, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ, অবিলম্বে পাহাড়-সমতলসহ সারা দেশে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ ও নিপীড়নের সব ঘটনার বিচার নিশ্চিত এবং প্রয়োজনে ধর্ষণের ঘটনার বিচারের জন্য আলাদা ট্রাইব্যুনাল গঠন ও ভুক্তভোগী ও সাক্ষীকে সব ধরনের সুরক্ষা প্রদানের জন্য ২০১১ সালে পর্যালোচিত সাক্ষী সুরক্ষা আইন পুনরায় পর্যালোচনা ও প্রয়োগ করা।
Discussion about this post