আন্তর্জাতিক ডেস্ক
লিবিয়ায় পাচারকারীদের গুলিতে হতাহতরা সেখানে যান আরও প্রায় তিন মাস আগে। দেশে পাচারকারীদের দালালরা তাদের স্বপ্ন দেখিয়েছিল ইউরোপের দেশ ইতালি নিয়ে যাওয়ার। সেই স্বপ্নের পথে বিপদসংকুল যাত্রায় শেষ পর্যন্ত তাদের জীবন দিতে হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন এক ভিডিও বার্তায় সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, গুলিতে ২৬ জন নিহত এবং ১১ জন আহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে ছয়জন সম্পূর্ণ সুস্থ আছেন, পাঁচ জনের অবস্থা গুরুতর। ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত হতাহতদের জন্য লিবিয়া সরকারের কাছে ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে বলেও মন্ত্রী জানান। তাদেরকে মিজদাহ থেকে ত্রিপলীর কেন্দ্রীয় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়েছে। আর নিহত ২৬ জনের মরদেহের বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আর্ন্তজাতিক অভিবাসন সংস্থার সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
লিবিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের কাউন্সেলর (শ্রম) আশরাফুল ইসলাম সমকালকে জানান, হতাহতদের নাম-পরিচয় সুনির্দিষ্ট করার বাজ চলছে। নিহতদের মরদেহ মূল ঘটনাস্থল মিজদাহ শহরের হাসপাতালের মর্গে আছে। মিজদাহ শহরে এখনও যুদ্ধাবস্থা রয়েছে, ছোট ছোট মিলিশিয়া গ্রুপ অত্যন্ত সক্রিয়। মিলিশিয়া গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণেই পাচারকারীরা এখানে অত্যন্ত শক্তিশালী। পাচারকারীরা এখন পাচারের জন্য নিরাপদ রুট হিসেবে বিপদসঙ্কুল মরুময় এই পথ ব্যবহার করছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিডিও বার্তায় যা বললেন: শুক্রবার এক ভিডিও বার্তায় লিবিয়ার ঘটনা বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। লিবিয়ার ওই ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশিদের বরাত দিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আরও প্রায় তিন মাস আগে পাচারকারী দল এই বাংলাদেশি নাগরিকদের ইতালি নিয়ে যাওয়ার জন্য লিবিয়ায় নিয়ে যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, ইতালিতে পাঠানোর জন্য লিবিয়ার উপকূল থেকে তাদের সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া। এই ৩৮ জন বাংলাদেশি নাগরিকের প্রত্যেকের কাছ থেকে পাচারকারী দল আট থেকে দশ হাজার মার্কিন ডলার করে নিয়েছিল। লিবিয়ায় নেওয়ার পর ত্রিপলি থেকে প্রায় ১৮০ কিলোমিটার দূরে মিজদাহ শহরে নিয়ে পাচারকারী দল বাংলাদেশিদেরসহ কয়েকজন আফ্রিকান নাগরিককে জিম্মি করে আরও টাকা চাচ্ছিল এবং অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছিল। নির্যাতনের শিকার মানুষগুলো পাচারকারীদের আর কোনো টাকা দিতে অস্বীকার করে। এক পর্যায়ে ঝগড়ার সময়ে একজন আফ্রিকান লোক তাদের প্রধান পাচারকারীকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে। ওই পাচারকারী মারা যাওয়ার পর পরই তার পরিবার ও দলের অন্যরা এলোপাতাড়ি গুলি চালানো শুরু করে। ফলে ঘটনাস্থলেই ২৬ জন বাংলাদেশি নিহত হন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এ ঘটনার খবর পাওয়ার পর পরই ত্রিপলীতে বাংলাদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তারা সেখানকার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ঘটনা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেন। গুলিতে আহত ১১ জনকে দ্রুত ত্রিপলীন কেন্দ্রীয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়। আহতদের শরীরে বিভিন্ন জায়গা থেকে বুলেট বের করা হয়। আহতদের মধ্যে ছয়জন সুস্থ আছেন। বাকী পাঁচজনের অবস্থা গুরুতর। তিনজনের অস্ত্রোপচার করতে হয়েছে। তাদের অবস্থা বেশী খারাপ। আর মরদেহগুলো মিজদাহ শহরে একটি হাসপাতালের মর্গে আছে এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থাকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ত্রিপলীর বাংলাদেশ মিশন লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে ঘটনাটির সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ইতোমধ্যে জানিয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার এবং দোষী ব্যক্তিদের তথ্য দেওয়ারও দাবি জানানো হয়েছে। লিবিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতার ও শাস্তি দেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। তবে মিজদাহ শহরটি এক সপ্তাহ আগে ত্রিপোলি সরকার দখল করেছে। আগে এটি হাফতারপন্থীদের দখলে ছিল। এখন কার্যত সেখানে কোনো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। সেখানে এখনও মিলিশিয়াদের রাজত্ব। ফলে অপরাধীদের ধরে এনে কখন শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে সেটি নিশ্চিত করে বলা কঠিন।
দেশের ভেতরে পাচারকারীরা এখনও সক্রিয় আছে জানিয়ে ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, এর আগে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবির পরে ১৬ জন বেঁচে যাওয়া বাংলাদেশি আমাদের জানিয়েছিল বাংলাদেশের পাচারকারী কারা, কোন ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে গিয়েছিল। আমরা কিছু গ্রেফতারও করেছিলাম। এবারও যারা বেঁচে আছেন তাদের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে দেশে পাচারকারী যারা আছে তাদের ধরা হবে। তিনি সাধারণ মানুষকে পাচারকারীদের খপ্পরে পা না দেওয়ার অনুরোধ জানান।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী নিহত ২৪ জন হচ্ছেন গোপালগঞ্জের সুজন ও কামরুল, মাদারীপুরের জাকির হোসেন, সৈয়দুল, জুয়েল ও ফিরুজ, রাজৈরের বিদ্যানন্দীর জুয়েল ও মানিক, টেকেরহাটের আসাদুল, আয়নাল মোল্লা ও মনির, ইশবপুরের সজীব ও শাহীন, দুধখালীর শামীম, ঢাকার আরফান, টাঙ্গাইলের মহেশপুরের বিনোদপুরের নারায়ণপুরের লাল চান্দ, কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রাজন, শাকিল, সাকিব ও সোহাগ, রসুলপুরের আকাশ ও মো. আলী, হোসেনপুরের রহিম এবং যশোরের রাকিবুল।
আহত ১১ জন হচ্ছেন- মাদারীপুর সদরের তীর বাগদি গ্রামের ফিরোজ বেপারী (হাঁটুতে গুলিবিদ্ধ), ফরিদপুরের ভাঙ্গার দুলকান্দি গ্রামের মো. সাজিদ ( পেটে গুলিবিদ্ধ), কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শম্ভপুর গ্রামের মো. জানু মিয়া (পেটে গুলিবিদ্ধ), ভৈরবের জগন্নাথপুর গ্রামের মো. সজল মিয়া (দুই হাতে মারাত্মকভাবে জখম), গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের বামনডাঙ্গা বাড়ির ওমর শেখ (হাতে মারাত্মকভাবে জখম ও দুই পায়ে গুলিবিদ্ধ), টাঙ্গাইলের মহেশপুরের বিনোদপুরের নারায়ণপুরের মো. তরিকুল ইসলাম (২২), চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার বেলগাছির খেজুরতলার মো. বকুল হোসাইন (৩০), মাদারীপুরের রাজৈরের কদমবাড়ির মো. আলী (২২), কিশোরগঞ্জের ভৈরবের সখিপুরের মওটুলীর সোহাগ আহমেদ (২০), মাদারীপুরের রাজৈরের ইশবপুরের মো. সম্রাট খালাসী (২৯) এবং চুয়াডাঙ্গার বাপ্পী (মস্তিষ্কে গুলিবিদ্ধ, গুরুতর অবস্থা)। আহতরা সবাই ত্রিপোলি মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
Discussion about this post