মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নেওয়া করোনাভাইরাসের কার্যকর কোনো চিকিৎসা এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। চিকিৎসকরা প্রতিকার হিসেবে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করছেন তার একটি ‘প্লাজমা থেরাপি’। এই পদ্ধতিতে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পর তার রক্ত বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে দেওয়া হয়। চিকিৎসকদের দাবি ‘প্লাজমা থেরাপি’তে ভালো ফল পাচ্ছেন তাঁরা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে রক্তদান ও তা গ্রহণের অবকাশ ইসলামে আছে কি? ‘প্লাজমা থেরাপি’র ধর্মীয় নানা দিক তুলে ধরেছেন মারকাযুদ দাওয়াহ আল ইসলামিয়া, ঢাকা-এর পরিচালক মুফতি আবুল হাসান মুহাম্মাদ আব্দুল্লাহ
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের ওপর প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হচ্ছে। মুসলিম ও অমুসলিম সব দেশেই এর প্রয়োগ হচ্ছে এবং মুসলিম ও অমুসলিম সবাই তাতে অংশ নিচ্ছেন। সুতরাং এই চিকিৎসা পদ্ধতির ধর্মীয় বিধি-বিধান জানা আবশ্যক। দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞ ডাক্তারদের বিভিন্ন বক্তব্য এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রতিবেদন ও জার্নালগুলো পড়ে যতটুকু জানতে পেরেছি, এটা পুরোপুরি নতুন কোনো পদ্ধতি নয়, আগেও এর প্রয়োগ হয়েছে। বড় বড় ভাইরাসজনিত রোগ ইবোলা, সার্সসহ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ভাইরাসে বহু মানুষ আক্রান্ত হওয়ার পর এই প্লাজমা থেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে অতীতে। এই পদ্ধতি প্রয়োগে অনেক সময় রোগীরা উপকৃত হয়েছেন এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় এই থেরাপির প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
প্লাজমা থেরাপি সংক্রান্ত ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধান জানতে হলে এই পদ্ধতি সম্পর্কেও ধারণা রাখা প্রয়োজন। প্লাজমা থেরাপি বলা হয়, কোনো ব্যক্তি ভাইরাসজনিত রোগ থেকে আল্লাহ তাআলার দয়ায় যখন সুস্থ হয়ে ওঠে, তখন সেই ব্যক্তির দেহে ওই রোগের একটি প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হয়। চিকিৎসাবিদ্যায় এই প্রতিরোধ শক্তিকে বলা হয় অ্যান্টিবডি। সুস্থ হয়ে ওঠা ব্যক্তির শরীর থেকে রক্তের বিশেষ পদার্থ বা অংশ এই রোগে আক্রান্ত অন্য ব্যক্তির মধ্যে প্রবেশ করালে চিকিৎসকদের অভিজ্ঞতা হলো, এতে অন্য রোগীর শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। সুস্থ হওয়া ব্যক্তির অ্যান্টিবডি রোগাক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রতিরোধ শক্তি তৈরি করে। এতে রোগীর সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এই পদ্ধতিকে চিকিৎসকরা প্লাজমা থেরাপি বলেন।
কিছু শর্তের সঙ্গে এই প্লাজমা থেরাপি ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ। এখানে কয়েকটি বিষয় বিবেচ্য এবং সঙ্গে কিছু শর্তও আছে। এই জাতীয় অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিতে যেসব শর্ত ও বিবেচনার কথা বলা হয়ে থাকে সেগুলো এখানেও প্রযোজ্য। প্রথম প্রশ্ন হলো, সাধারণভাবে প্লাজমা দেওয়া-নেওয়া জায়েজ কি না? উত্তর হলো, হ্যাঁ, এটি বৈধ। প্লাজমা দান ও গ্রহণ করা রক্ত দেওয়া-নেওয়ার মতোই একটি বিষয়। ইসলামী আইনজ্ঞরা রক্ত দান করা এবং গ্রহণ করাকে অনেক আগেই বৈধ বলে মত দিয়েছেন। তবে রক্ত যেমন বিক্রি করা অবৈধ, তেমনি প্লাজমা বিক্রি করাও অবৈধ। অসুস্থ কোনো ব্যক্তি অপারগ হলে তার জন্য রক্ত বা প্লাজমা কেনা বৈধ হতে পারে, কিন্তু বিক্রি করার বৈধতা নেই। তাই সাধারণভাবে প্লাজমা দান করা যাবে, গ্রহণ করা যাবে, বিক্রি করা যাবে না।
দ্বিতীয়ত, প্লাজমা দান করার ক্ষেত্রে অভিজ্ঞ ও বিশ্বস্ত ডাক্তারের যথাযথ দিকনির্দেশনা ও অনুমোদন লাগবে। প্লাজমা অনেকটা রক্তের মতো, বরং রক্তদানের চেয়েও প্লাজমার ক্ষেত্রে আরো সূক্ষ্ম ব্যাপার রয়েছে। এ জন্য অভিজ্ঞ ও যোগ্য চিকিৎসক যার জন্য যার প্লাজমা উপযোগী মনে করবেন প্লাজমা দাতা তাকে প্লাজমা দান করবেন। দাতা ও গ্রহীতার যথেচ্ছ সিদ্ধান্ত এবং প্লাজমার অপব্যবহার অথবা অপচয় করার মতো কোনো কাজ করা যাবে না। যোগ্য চিকিৎসকের মতের প্রাধান্যই এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
প্লাজমা দান ও গ্রহণের ক্ষেত্রে দাতা-গ্রহীতার মধ্যে পুরুষ-মহিলা, মাহরাম-গায়রে মাহরাম, আত্মীয়-অনাত্মীয় এবং পরিচিত-অপরিচিতের কোনো বিভাজন ও পার্থক্য নেই। এমনকি ধর্মেরও কোনো পার্থক্য নেই। মুসলিম ও অমুসলিম সবাই পরস্পরকে প্লাজমা দান করতে পারবে এবং পরস্পরের প্লাজমা গ্রহণও করতে পারবে। যোগ্য চিকিৎসক যদি মনে করেন দাতার প্লাজমা গ্রহীতা গ্রহণ করতে পারবে এবং এই বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দেন তাহলে এ ক্ষেত্রে অন্য কোনো প্রশ্ন থাকবে না।
প্লাজমা দান করা বৈধ হলেও বিক্রি করা অবৈধ কেন? বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। মানুষের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আল্লাহ তাআলার বিশেষ দান। চাইলেই কোনো মানুষ সে অঙ্গ বিক্রি করতে পারে না; রক্ত যেমন বিক্রি করতে পারে না। রক্ত যেমন দান করা জায়েজ, প্লাজমাও দান করা জায়েজ, যদি এতে দাতার শরীরের বিশেষ কোনো ক্ষতি না হয়। আমরা যতটুকু জেনেছি, প্লাজমা দান করায় সুস্থ ব্যক্তির শরীরে কোনো ক্ষতি হয় না। চিকিৎসক তাঁকে দান করার উপযোগী মনে করলে তিনি প্লাজমা দান করবেন। ইসলামী শরিয়তের মূলনীতি এটাই বলে, এই দানের বদৌলতে দাতা আল্লাহ তাআলার কাছে সাওয়াবের অধিকারী হবেন। দান করা সাওয়াবের কারণ হবে, বিক্রি করা বা বিনিময় গ্রহণ করা বৈধ হবে না। তবে হ্যাঁ, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ধনাঢ্য বা সাধারণ সচ্ছল ব্যক্তি যদি প্লাজমা দাতাকে কোনো উপহার বা হাদিয়া দিয়ে থাকে সেটা ভিন্ন কথা। কোনো শর্ত, কোনো প্রত্যাশা কিংবা কোনো বিনিময়ের ব্যাপার যদি না থাকে তাহলে প্লাজমা গ্রহীতার পক্ষ থেকে দেওয়া এই উপঢৌকন বা হাদিয়া নিজের পক্ষ থেকে দেওয়া স্বতঃস্ফূর্ত উপহারের মতো গণ্য হবে। এটা জায়েজ। এই জাতীয় উপহার বিনিময়ের আওতায় পড়বে না, বরং সৌজন্যমূলক উপহার বা উপঢৌকনের আওতায় পড়বে।
এই প্লাজমা থেরাপি যদি করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় স্বীকৃত ও কার্যকর হিসেবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে তাহলে আমরা আহ্বান জানাব, যেসব মুসলমান ভাই-বোন করোনা আক্রান্ত হওয়ার পর আল্লাহ তাআলার দয়ায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং তাঁদের শরীর প্লাজমা দানের উপযোগী, তাঁরা যেন অন্য অসুস্থ ভাই-বোনদের আরোগ্যের ক্ষেত্রে প্লাজমা দিয়ে সহযোগিতা করেন। নিজের ‘উপহার’ নিয়ে তাঁদের পাশে দাঁড়ান। আল্লাহ তাআলা অবশ্যই প্লাজমা দাতা ভাই-বোনদের উত্তম বিনিময় দান করবেন।
Discussion about this post