অনলাইন ডেস্ক
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনা ভাইরাসের ব্যাপারে দিন দিন যতোই জানা যাচ্ছে, রহস্য আর উদ্বেগ ততোই ঘনীভূত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা একের পর এক এ ভাইরাসের অদ্ভুত সব বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানছেন। জানছেন বিচত্র সব উপায়ে এটি ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে। এর মাঝে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, সবার অগোচরে নীরব বাহকের মাধ্যমে ব্যাপক পরিসরে ভাইরাসটির ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা। হতে পারে এ কারণেই একে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ছে।
করোনা আক্রান্ত অনেকেরই কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন উপসর্গ প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে বিপজ্জনক হলেন তারা, যারা আক্রান্ত, কিন্তু কোনো উপসর্গ প্রকাশ পাচ্ছে না। আক্রান্ত নিজেও জানছেন না যে, তিনি এ ভাইরাস বহন করছেন। উপসর্গ প্রকাশ পাওয়া ব্যক্তিদের সহজেই আলাদা করে সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। কিন্তু, উপসর্গহীনদের চিহ্নিত করে আলাদা করা ভয়াবহ কঠিন।
রোববার (৩১ মে) আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির এক প্রতিবেদনে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
বিজ্ঞানী ও গবেষকরা বলছেন, কতো সংখ্যক মানুষ নীরবে করোনা ভাইরাস বয়ে বেড়াচ্ছেন তা বের করা খুব দরকার। তারাই বৃহৎ অংশে করোনা মহামারি ছড়িয়ে পড়ার পেছনে দায়ী কিনা সেটাও বুঝে ওঠা জরুরি।
নীরব বাহকের মাধ্যমে করোনা ছড়িয়ে পড়ার নমুনা হিসেবে চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি সিঙ্গাপুরের ‘দ্য লাইফ’ নামের গির্জার বহুল আলোচিত জমায়েতের প্রসঙ্গ তুলে ধরা হয়। বিশ্বব্যাপী করোনা ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ওই জমায়েত ভূমিকা রাখতে পারে, কল্পনাতেও কেউ ভাবেনি। কিন্তু, নীরব বাহকের মাধ্যমে তেমনটাই ঘটেছিল।
দিনটি ছিল রোববার। জমায়েতে সেদিন সকালেই সিঙ্গাপুরে পৌঁছানো ৫৬ বছর বয়সী এক চীনা দম্পতিও ছিলেন। তারা আপাত সুস্থই ছিলেন, দেখে মনে হওয়ার কোনো কারণই নেই যে, তারা করোনা বহন করছিলেন। তখন পর্যন্ত ক্রমাগত কাশিকেই করোনার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ধারণা করা হচ্ছিল, এটি কাশির মাধ্যমেই ছড়ায়। ভাবা হচ্ছিল, কারো উপসর্গ নেই মানে তার মাধ্যমে ভাইরাস ছড়ানোরও আশঙ্কা নেই।
গির্জার সেদিনের জমায়েত শেষে ওই দম্পতি যথারীতি স্থান ত্যাগ করেন। কিন্তু এরপরই বিভ্রান্তিকরভাবে পরিস্থিতি খারাপের দিকে মোড় নিতে থাকে। ২২ জানুয়ারি স্ত্রীর অসুস্থতা দেখা দেয়। দুই দিন পর অসুস্থ হন স্বামীটিও। চীনে করোনা সংক্রমণের হটস্পট উহান শহর থেকেই তারা সিঙ্গাপুরে যান, ফলে তাদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারটি অপ্রত্যাশিত নয়।
কিন্তু ওই সপ্তাহেই স্পষ্ট কারণ ছাড়াই স্থানীয় ৩ জনের মধ্যে করোনা শনাক্ত করা হয়। এই ৩ জনই ছিলেন সিঙ্গাপুরের প্রথম শনাক্ত। কোথা থেকে স্থানীয়দের মধ্যে এ ভাইরাস এলো তার ব্যাখ্যা খুঁজতে গিয়ে প্রশাসন হতবুদ্ধি হয়ে যায়। পরে এই রহস্যের বিস্তারিত জানতে তদন্ত চালানো হয়। আর বেরিয়ে আসে অজানা আর উদ্বেগজনক তথ্য।
এ ঘটনার ব্যাপারে সিঙ্গাপুরের ছোঁয়াচে রোগ সংক্রমণ বিভাগের প্রধান ডক্টর ভেরনোন লি বলেন, আমরা একেবারেই উদ্ভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিলাম। দেখা গেলো, পারস্পরিক পরিচয় বা যোগাযোগ নেই, উপসর্গ না থাকায় এমন লোকেরা একে অন্যকে আক্রান্ত করছেন। তখন পর্যন্ত এভাবে করোনা ছড়ানোর ব্যাপারটি ভাবা হতো না। ফলে, আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
কীভাবে এ ঘটনা ঘটছে জানতে ডক্টর লিসহ বেশ কয়েক বিজ্ঞানী, রোগবিস্তার পদ্ধতি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বিস্তারিত ম্যাপ ধরে আক্রান্তদের কে, কখন, কোথায় ছিলেন সেগুলো বের করা হয়। এই পদ্ধতিকেই বলা হচ্ছে ‘কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং’। এ ব্যাপারে সিঙ্গাপুরের সক্ষমতা এরই মাঝে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে।
কন্ট্যাক্ট ট্রেসিংয়ের মাধ্যমে কয়েক দিনের মধ্যেই তদন্তকারীরা দ্য লাইফ গির্জার অন্তত ১৯১ সদস্যের সঙ্গে কথা বলেন, যাদের মধ্যে ১৪২ জনই ১৯ জানুয়ারি গির্জার ওই জমায়েতে অংশ নিয়েছিলেন। তারা দ্রুতই বুঝে খুঁজে পেলেন, সিঙ্গাপুরে স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত ৩ জনের মধ্যে এক দম্পতি ওইদিন গির্জায় গিয়েছিলেন এবং কথাবার্তা, অভিবাদনবা অন্য কোনোভাবে তারা নীরবে করোনা বহনকারী ওই চীনা দম্পতির সংস্পর্শে গিয়েছিলেন।
তবে এর চেয়েও বিভ্রান্তিকর ছিল প্রথম ব্যাচে সিঙ্গাপুরে স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত তৃতীয় ব্যক্তির মধ্যে সংক্রমণের ব্যাপারটি। করোনা আক্রান্ত ওই নারী ১৯ জানুয়ারির জমায়েতে গির্জায় উপস্থিত ছিলেন না। তিনি অন্য আক্রান্তদের সংস্পর্শেও যাননি। তদন্তে দেখা যায়, ওই নারী পরেরদিন একই গির্জায় আরেকটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছিলেন। তাহলে তিনি কীভাবে আক্রান্ত হলেন?
এর অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে ভাবাও যায়নি, এমন এক ঘটনা বেরিয়ে আসে। রহস্যের কূলকিনারা করতে গির্জার সিসিটিভি ফুটেজ ১৯ জানুয়ারির জমায়েতের খুঁটিনাটি দেখা হয়। আর তাতে যা দেখা যায়, তাতে তদন্তকারীদের চক্ষু ছানাবড়া হওয়ার মতো দশা হয়। আগের দিন উহানের ওই দম্পতি যে আসনে বসেছিলেন, পরেরদিন সিঙ্গাপুরের স্থানীয় ওই নারীও একই চেয়ারে বসেন। সেখান থেকেই তার মধ্যে সংক্রমিত হয় করোনা ভাইরাস।
কোনো উপসর্গ বা অসুস্থতা বোধ করা ছাড়াই এভাবেই ওই চীনা দম্পতির মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ ঘটে। হয়তোবা তাদের হাতে ভাইরাস ছিল, আর তারা ওই গির্জার আসন ছুঁয়েছেন। কিংবা তাদের নিঃশ্বাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে ভাইরাস ওই জায়গাটিতে পড়েছিল।
সংক্রমণ কীভাবে অগোচরেই ঘটতে পারে তার এক বিশেষ নজির হিসেবে দেখা হচ্ছে এ ঘটনাকে। যদিও উপসর্গ প্রকাশের আগেই স্পর্শ, নিঃশ্বাস বা ঠিক কোন উপায়ে ওই চীনা দম্পতি বা কারো মাধ্যমে ভাইরাস ছড়াতে পারে তার ব্যাখ্যা এখনও স্পষ্ট নয়।
ডক্টর লি বলেন, সারা বিশ্বেই করোনার ক্ষেত্রে মূলত উপসর্গ লক্ষ্য করার ব্যাপারে বলা হচ্ছে। কিন্তু, উপসর্গ ছাড়াও, নিজের অজান্তেই অনেকেই এটি ছড়াচ্ছেন, এমন আশঙ্কা রয়েছে।
সিঙ্গাপুরের এই তদন্তে আরও একটি ব্যাপার লক্ষ্যণীয়, উপসর্গ প্রকাশের আগের ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা সংক্রমণ ছড়ানোর ক্ষেত্রে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এমনও হতে পারে, এ সময়েই কেউ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। ফলে এই সময়ের ভেতরে আক্রান্ত ব্যক্তি যার সংস্পর্শে গেছেন তাদেরও আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
কাশির মাধ্যমে করোনা ছড়ায়, এটি বহুল আলোচিত। সে ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশের আগেই, কীভাবে করোনা ছড়াতে পারে তা এখনও স্পষ্ট নয়।
একটি মত এমন যে, নিঃশ্বাস বা কথাবার্তার মাধ্যমে এটি ঘটতে পারে। ভাইরাস বহনকারীর কাছাকাছি বা একই জায়গায়, বিশেষ করে ঘরে অবস্থানকারী ব্যক্তি এর মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারেন। আরেকটি মাধ্যম হতে পারে, স্পর্শ। ভাইরাসটি বহনকারীর হাতের মাধ্যমে বিভিন্ন বস্তু বা তলে ছড়ায় এবং সেখানে হাত দেওয়া কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারেন।
এর বাইরে আরও রহস্য ও উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে এই যে, অনেকের মধ্যে কখনোই কোনো উপসর্গ প্রকাশ নাও পেতে পারে। করোনার ক্ষেত্রেও এমন অনেক নজির মিলেছে। তারাও নিজের অজান্তে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় এ ভাইরাস ছড়ানোর উৎস হতে পারেন। ৫ থেকে ৮০ শতাংশ আক্রান্তও লক্ষণহীন হতে পারেন বলে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যাচ্ছে।
Discussion about this post