মো. জাকির হোসেন
যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা অঙ্গরাষ্ট্রের পুলিশ প্রকাশ্য রাস্তায় জর্জ ফ্লয়েড নামে রেস্তোরাঁয় নিরাপত্তাকর্মী এক কৃষ্ণাঙ্গের গলা হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছে। মৃত্যু যন্ত্রণায় ফ্লয়েড বারবার বলছে, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না।’ তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসছে। মৃত্যুর আগে পানি চেয়ে অনুরোধ জানাচ্ছে পুলিশকে। পথচারীরাও অনুরোধ করছে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। পাশে আরও পুলিশ রয়েছে সে একজন মানুষকে বাঁচানোর কোনও চেষ্টাই করছে না। মৃত্যুযন্ত্রণায় কাতর ফ্লয়েডের অনুরোধ পুলিশ অফিসারের কানে যায়নি। মৃত্যুযন্ত্রণা তাকে এতটুকু টলাতে পারেনি। রীতিমতো হাঁটু দিয়ে মাটিতে পিষতে থাকে সে। ওই অবস্থায় কয়েক মিনিট ছটফট করতে করতে ফ্লয়েড নিস্তেজ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তারপরও পুলিশ অফিসার বেশ কিছুক্ষণ হাঁটু চেপে ধরে রেখেছিল। অনেকেই এই ভয়ংকর মৃত্যু দৃশ্যকে ক্যামেরাবন্দি করছে। সেদিকে তাকিয়েও দেখেছে ওই নৃশংস পুলিশ অফিসার। কিন্তু সে নির্বিকার হয়তো এ ভাবনা থেকে একজন কৃষ্ণাঙ্গ হত্যার জন্য শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসারের কী আর হবে? ফ্লয়েড হত্যা ‘হিমশৈলের চূড়া মাত্র’।
ফ্লয়েডের মতো এরিক গার্নারকেও নিউইয়র্কের শ্বেতাঙ্গ পুলিশ দম বন্ধ করে হত্যা করেছিল। খুচরা সিগারেট অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে এই সন্দেহে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ওই ঘটনার ফুটেজে দেখা যায় গার্নার বারবার কান্নাজড়ানো গলায় আকুতি করছেন, ‘আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছি না’, আর একজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ, ড্যানিয়েল পান্টালিওকে দেখা যায় তার হাত দিয়ে গার্নারের গলা টিপে ধরে আছে এমনভাবে যাতে সে দম নিতে না পারে। ডালাসের ফোর্থ ওয়ার্থে ২৮ বছর বয়সী আতাতিয়ানা জেফারসনকে তার নিজের শোবার ঘরে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ অফিসার অ্যারন ডিন। গত ১৩ মার্চ লুইভিলের কেন্টাকিতে ২৬ বছর বয়সী জরুরি চিকিৎসা বিষয়ক প্রকৌশলী ব্রেওনা টেইলারকে তার ফ্ল্যাটে ঢুকে পুলিশ অফিসাররা আটবার গুলি করে হত্যা করে। ম্যালকম এক্স গ্রাসরুটস মুভমেন্ট (এমএক্সজিএম) ও দ্য রিয়েল নিউজ নেটওয়ার্ক (টিআরএনএন)সহ বেশ কিছু সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী পুলিশ, নিরাপত্তারক্ষী ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে।
‘অপেরেশন গেট্টো স্টর্ম’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতি ২৮ ঘণ্টায় একজন কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ, নারী বা শিশু বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যার শিকার হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় ছত্রছায়ায় বর্ণবাদী হত্যা-নির্যাতন-বৈষম্য-অবিচার অতি সাধারণ নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। ক্লিনটন আমলে শ্রমমন্ত্রী ছিলেন রবার্ট রাইস। তিনি সম্প্রতি লিখেছেন, আজকের আমেরিকার যে আর্থসামাজিক ব্যবস্থা, তার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী ‘অ্যাপারথেইড’ ব্যবস্থার কোনও ফারাক নেই। এ দেশে দাসপ্রথার অবসান হয়েছে বটে, কিন্তু তার বদলে এক ভিন্ন দাসপ্রথা চালু হয়েছে। আমেরিকার শেকড় থেকে শিখরে বর্ণবাদ। রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পরতে পরতে সাদা-কালো বৈষম্য। সমাজ ব্যবস্থার গভীরভাবে প্রোথিত আছে বর্ণবাদ। সাদা-কালো বিদ্বেষ। বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজে গভীরভাবে প্রোথিত। এটা আমাদের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত। বর্ণবৈষম্য আমাদের সমাজের আদি প্রবাহ ও আমাদের ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়।’ আমেরিকার ইউসিএলএ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাগরিক অধিকার বিষয়ক একটি গ্রুপের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, আমেরিকার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আবারও বর্ণবাদ জোরদার হচ্ছে। আমেরিকার আবাসন বিভাগেও আবার ফিরে এসেছে বর্ণবাদ। ফলে কৃষ্ণাঙ্গরা শহরের অভিজাত অঞ্চলে বসবাস করতে পারছে না। তাই বড় শহর ছাড়া ছোট ছোট শহরে বহু-বর্ণভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ দেশের বিচারব্যবস্থায়ও বর্ণবাদের কালোছায়া পরিলক্ষিত হয়। শুধু কালো এই অপরাধে এ দেশের পুলিশ যেকোনও সময় যেকোনও স্থানে কাউকে আটকাতে পারে, প্রতিবাদ করলে জেলে ঢোকাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অঙ্গরাজ্যে ‘রেশিয়াল প্রোফাইলিং’ এখনও একটি বৈধ আইনি ব্যবস্থা। আমেরিকার কালো মানুষদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ১৩ শতাংশ, অথচ কারাগারে মোট বন্দির ৪০ শতাংশই হলো এ দেশের কালো মানুষ। নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটির ব্রেনন সেন্টার ফর জাস্টিস এর এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০-৩৪ বছর বয়সী এমন প্রতি নয়জন আফ্রিকান-আমেরিকানের একজন এখন জেলে। আরেকটি গবেষণা বলছে, প্রতি তিনজন আফ্রিকান-আমেরিকানের মধ্যে অন্তত একজনকে জীবনে একবার হলেও জেলে যেতে হয়। যে অপরাধে এরা জেলে, একই অপরাধে সাদা বা বাদামি রঙের মানুষেরা সহজেই ছাড়া পেয়ে যায়। আমেরিকায় কালোদের সামান্য অপরাধেই বড় সাজা পেতে দেখা যায়। সাদাদের ক্ষেত্রে বড় অপরাধেও তা হয় না।
সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস মহামারি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি রাষ্ট্রীয় বৈষম্য ও অবিচারের নগ্নরূপটি তুলে ধরেছে বিশ্বের কাছে। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত ‘The coronavirus is infecting and killing black Americans at an alarmingly high rate’ শিরোনামের প্রতিবেদনে Reis Thebault, Andrew Ba Tran and Vanessa Williams প্রমাণসহ তুলে ধরেছেন, যুক্তরাষ্ট্রে অন্য জনগোষ্ঠীর তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গ জনগণের মধ্যে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। উদাহরণস্বরূপ, উইসকনসিন অঙ্গরাষ্ট্রের Milwaukee County-র ২৬ শতাংশ মানুষ কালো, কিন্তু এ কাউন্টিতে করোনায় মোট মৃত্যুর ৭৩ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। লুইজিয়ানায় ৩২ শতাংশ কালো মানুষের বসবাস, অথচ করোনায় মোট মৃত্যুর ৭০ শতাংশ কৃষ্ণাঙ্গ। শিকাগোতে কৃষ্ণাঙ্গ জনগোষ্ঠী ৩২ শতাংশ, আর করোনায় মৃত্যু হার ৬৭ শতাংশ। শিকাগোতে শ্বেতাঙ্গদের তুলনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যুর হার ৬ গুণ বেশি। জর্জিয়ার Dougherty County-তে করোনায় কৃষ্ণাঙ্গদের মৃত্যু হার ৯০ শতাংশের বেশি। Albany City-র Commissioner Demetrius Young কৃষ্ণাঙ্গদের এ অস্বাভাবিক উচ্চ মৃত্যুহারের প্রসঙ্গে যথার্থই বলেছেন, ‘Historically, when America catches a cold, black America catches pneumonia.’ অনেক বছর আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নিউ জার্সির নিউ হার্লেম-এর কৃষ্ণাঙ্গ বাসিন্দাদের ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখিয়েছেন যেখানে শ্বেতাঙ্গ আমেরিকানদের গড় আয়ু ৭৯ বছর সেখানে নিউ হার্লেম-এর বাসিন্দাদের গড় আয়ু ৪০ বছর, যা দরিদ্র রাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ুর চেয়েও কম। আমেরিকান হয়েও হার্লেম-এর বাসিন্দাদের গড় আয়ু উল্লেখযোগ্য রকম কম হওয়ার পেছনে অন্যদের মধ্যে যেসকল কারণ দায়ী বলে অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন তা হলো, অপর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধা, বর্ণবাদজনিত বৈষম্য ইত্যাদি। প্রশ্ন হলো, কেন কালো মানুষদের প্রতি এমন বৈষম্য, অবিচার? কারও গায়ের রং কালো বা সাদা এটাতে তো মানুষের কোনও হাত নেই। স্রষ্টা যেমন চেয়েছেন, তেমন হয়েছে। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ আছে যাদের গায়ের রং কালোও নয়, সাদাও নয়। এদের বাদামি বলা হয়। মানুষের শরীরের চামড়ার রঙের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্র-সমাজে যে বৈষম্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যবস্থা সেটাই বর্ণবাদ (রেসিজম) নামে পরিচিত। এর সূত্রপাত ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক দখল ও আধিপত্যের মধ্য দিয়ে। ‘ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই শ্রেষ্ঠ’ এই মতাদর্শ প্রচার ও অনুশীলন করা হয়েছে শত শত বছর ধরে। যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদী এই দৃষ্টিভঙ্গি এতটাই গভীরে শিকড় গেড়েছে যে, এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই সত্ত্বেও একবিংশ শতাব্দীতেও এর অবসান হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের অনেক শ্বেতকায়ই কালো মানুষদের তাদের পূর্ণ নাগরিক অধিকারের স্বীকৃতি দিতে এখনও প্রস্তুত নয়। ‘শ্বেতাঙ্গরা জন্মগতভাবেই শ্রেষ্ঠ’ এবং তারা যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিপুত্র এ মানসিকতার বলি হচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গ মানবতা। শ্বেতাঙ্গ এ মানসিকতা ভ্রান্ত, ঐতিহাসিক মিথ্যা, অযৌক্তিক, যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণার বিরোধী ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী।
মানুষ হয়ে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ অপর মানুষকে অবজ্ঞা করা, নিচু মনে করা সবচেয়ে নিকৃষ্ট মানসিকতা। এটি অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক। কোনও মানুষের গায়ের রং তার ইচ্ছানির্ভর নয়। আর শ্বেতাঙ্গ বা কৃষ্ণাঙ্গ কোনও দলই আমেরিকার ভূমিপুত্র নয়। উভয়েই অন্য মহাদেশ থেকে এসে এখানে বসতি স্থাপন করেছে। তবে তাদের আগমনের হেতু ভিন্ন।
শ্বেতাঙ্গদের পূর্বপুরুষরা ইউরোপ থেকে এসেছে। ইউরোপীয় পর্যটক মার্কো পোলো বিশ্ব ভ্রমণ করে জানান যে, পৃথিবীর সবচাইতে সমৃদ্ধশালী দেশ হচ্ছে ভারতবর্ষ। ভারত স্বর্ণ, রৌপ্য, মণিমুক্তাসহ প্রাচুর্যের এক বিশাল ভান্ডার। স্পেনের রানি তখন এই ভারতবর্ষ আবিষ্কারের ফন্দি-ফিকির করছিলেন। স্পেনের রানির আগ্রহের সূত্র ধরে ইতালিয়ান নাবিক কলম্বাস ১৪৯২ সালে ভারতবর্ষ আবিষ্কারের লক্ষ্যে জাহাজের পাল তোলেন। প্রায় ছয় মাস কেটে গেলো। কোনও কূল কিনারা পাচ্ছেন না। নাবিকরা বিদ্রোহ করার উপক্রম। এরই মাঝে একদিন হঠাৎ একটুখানি আলোর রেশ। নিশ্চয়ই ভূখণ্ড সামনে। দেখলেন, সত্যিই স্থলভূমি, মানুষের পদচারণা। জাহাজ কিনারে ভিড়ল। ভারত মনে করে কলম্বাস পৌঁছে যান আমেরিকায়। দিনটি ১২ অক্টোবর ১৪৯২। মানব সভ্যতার গতিপথ বদলে দেওয়ার মতো একটি দিন। এই দিনে আমেরিকার মাটিতে পা রাখেন ক্রিস্টোফার কলম্বাস। সেদিন থেকে সূচনা হলো ইতিহাসের নতুন এক বাঁকের। ঝাঁকে ঝাঁকে ইউরোপীয়রা ছুটে আসতে শুরু করল সদ্য আবিষ্কৃত ‘নতুন পৃথিবী’ খ্যাত এই মহাদেশে। এভাবেই বিশ্বের কাছে পরিচিত হলো বিশ্বের নতুন এক ভূখণ্ড, যার নাম আমেরিকা। প্রথমে আমেরিকায় আসে কয়েকশ’ স্পেনের নাগরিক। এরপর পর্তুগাল, ইতালি, জার্মানিসহ পশ্চিম ইউরোপীয়রা হামলে পড়ে আমেরিকায়। আমেরিকার আদিবাসি রেড ইন্ডিয়ানদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়, হাজার হাজার রেড ইন্ডিয়ানকে হত্যা করে। অ্যাজটেক-ইনকাদের সমৃদ্ধ সভ্যতা ও জনপদকে পদানত করে তাদের জমি ও দেশ দখল করতে সেখানে শুরু হয় ভয়ংকর নৃশংসতা। অনেক আদিবাসী পালিয়ে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে। অল্পদিনের মাঝেই ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গরা আমেরিকার ভূমিপুত্র আদিবাসীদের বিশাল ইনকা ও আ্যজটেক সাম্রাজ্য দখল করে নেয়। নিজভূমে পরবাসী হয় আদিবাসীরা। উল্লেখ্য, আদিবাসীরা যুদ্ধের চেয়ে ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত রোগ বালাই তথা মহামারিতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুবরণ করেছে। ইউরেশিয়ার মানুষ বনের পশু-পাখি পোষ মানানোর প্রক্রিয়ায় পশু-পাখির মারাত্মক রোগ ও মহামারি যেমন, গুটিবসন্ত, হাম, যক্ষ্মা, ইনফ্লুয়েঞ্জা ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। অণুজীব বিজ্ঞানীরা বলছেন গবাদি পশু থেকে হাম ও যক্ষ্মা, শূকর থেকে ইনফ্লুয়েঞ্জা এবং উট থেকে গুটিবসন্ত মহামারি আকারে মানুষের মাঝে ছড়িয়েছে। ধীরে ধীরে ইউরোপীয়দের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হলেও আমেরিকার আদিবাসীদের কাছে এ রোগ-মহামারি ছিল অজানা। Jared Diamond তার ‘Why Did Human History Unfold Differently on Different Continets for the Last 13,000 Years?’ প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ইউরোপীয় দখলদাররা প্রস্তর যুগ অতিক্রম করে ব্রোঞ্জ ও লৌহ যুগে প্রবেশ করলেও আমেরিকার আদিবাসীরা প্রস্তর যুগেই আটকে ছিল। ইউরোপীয় দখলদারদের কাছে ছিল ইস্পাতের তরবারি, বন্দুক, অশ্বারোহী বাহিনী, আর রেড ইন্ডিয়ানদের ছিল পাথর ও কাঠের তৈরি অস্ত্র। আদিবাসীদের বনের পশু-পাখি পোষ মানানোর অভ্যাস না থাকায় তাদের অশ্বারোহী বা অন্য কোনও বাহকের বাহিনীও ছিল না। এ সত্ত্বেও ইউরোপীয়রা সামরিক সরঞ্জামের জোরে জয়লাভ করেনি। লাখ লাখ আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানের ৯৫ শতাংশের বেশি মৃত্যুবরণ করেছে ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে এসে গুটিবসন্ত, হাম ইত্যাদি মহামারিতে আক্রান্ত হয়ে। পরে ইউরোপীয়রা মহামারি ছড়িয়ে দেওয়ার একই কৌশল প্রয়োগ করেছে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপনের ক্ষেত্রে।
আমেরিকায় কালো মানুষদের আগমনের ইতিহাস লাঞ্ছনা, শোষণ আর দাসত্বের ইতিহাস। সেই ইতিহাস দাসপ্রথার এক কলঙ্কজনক দৃষ্টান্ত। আমেরিকায় দাসপ্রথা চালু করেছিল ইউরোপীয়রা। কলম্বাস আমেরিকায় পদার্পণের আগে রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে দাসপ্রথা ছিল না। ইউরোপীয়রা আমেরিকা দখলের পর সমস্যা দেখা দিলো মহাদেশের হাজার হাজার মাইল অনাবাদি জমি আবাদ করার মতো জনবল তাদের ছিল না। সেই সমস্যার পৈশাচিক সমাধান বের করা হলো, আফ্রিকা থেকে লাখ লাখ মানুষকে দাস হিসেবে ধরে এনে। আফ্রিকা থেকে আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়ে আমেরিকায় দাস ধরে আনার এই ব্যবসা ইতিহাসে ‘ট্রান্স আটলান্টিক স্লেভ ট্রেড’ হিসেবে পরিচিত। ষোড়শ শতকের শুরু থেকে আরম্ভ হওয়া দাস ব্যবসা ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিনশ’ বছর ধরে চলতে থাকে। এই সময়ে আফ্রিকার প্রায় দেড় কোটি থেকে দুই কোটির মতো নারী, পুরুষ ও শিশুকে দাস বানিয়ে ধরে আনা হয়েছিল। এদের প্রায় তিন ভাগের এক ভাগই মারা পড়েছিল সমুদ্র পথে নিয়ে আসার সময় অত্যাচারে কিংবা ক্ষুৎ-পিপাসা ক্লিষ্ট ও রোগ-শোকে। প্রায় ৮০ লাখের মতো দাস আনা হয়েছিল শুধু ব্রাজিলেই আর ৪ লাখ যুক্তরাষ্ট্রে। বাকিদের হাইতি ও ক্যারিবীয় অন্যান্য দ্বীপে পাঠানো হয়েছিল। এই দাসরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের মূল ভূমিকা পালন করেছিল। তামাক ও তুলার মতো লাভজনক শস্যের চাষ করানো হতো আফ্রিকান নিগ্রোদের দিয়ে। আমেরিকার কৃষি উৎপাদন, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন, রেললাইন নির্মাণ থেকে শুরু করে নতুন আমেরিকান সভ্যতার পেছনে এই কালোরা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া ট্যাক্স ও সম্পদ লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে আমেরিকার জনগণের বিদ্রোহ ও ১৭৭৫ সালে শুরু হওয়া আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে প্যাট্রিয়টিক বাহিনীতে আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গরা অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিল। আট বছর ধরে চলা যুদ্ধ শেষে ১৭৮৩ সালে আমেরিকা স্বাধীন হওয়ার পেছনে আফ্রো-আমেরিকানদের অবদান অনস্বীকার্য। আমেরিকা স্বাধীন হলো, কিন্তু কালো মানুষগুলোর কপালে স্বাধীনতা জুটলো না। তারা দাসই রয়ে গেলো। ১৮৬১ সালের নির্বাচনে আব্রাহাম লিঙ্কন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে দাসপ্রথা বিলুপ্তির উদ্যোগ নেন। দাস বিলুপ্তির পক্ষে-বিপক্ষের সিদ্ধান্ত ঘিরে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। উত্তরের ৭টি অঙ্গরাজ্যের ইউনিয়ন স্টেটের শক্তি নিয়ে প্রতিপক্ষ দক্ষিণের ১১টি অঙ্গরাজ্যের কনফেডারেশনের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে বিজয় লাভের পর আব্রাহাম লিঙ্কন ১৮৬৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে আমেরিকায় দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করেন এবং দাসদের মুক্তির ঘোষণা দেন।
কাগজে-কলমে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলো, কিন্তু মগজে-মননে রয়ে গেলো। কালোদের পক্ষ নেওয়ায় দাসপ্রথার সমর্থকরা ১৮৬৫ সালে আব্রাহাম লিঙ্কনকে গুলি করে হত্যা করে। আব্রাহাম লিঙ্কনের হত্যার প্রায় শত বছর পর কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র আমেরিকায় কালোদের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট গড়ে তোলেন। কালোদের গণ্ডি ছাড়িয়ে সিভিল রাইটস মুভমেন্ট সারাবিশ্ব থেকে আসা অভিবাসীদের ব্যাপক সমর্থন পায়। ১৯৬৩ সালে লিঙ্কন মেমোরিয়ালের সামনে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে লুথার কিং তার বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণ দেন। ১৯৬৮ সালের এপ্রিলে শ্বেতাঙ্গ উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের গুলিতে লুথার কিং নিহত হন। মার্টিন লুথার কিং নিহত হওয়ার তিন বছর আগে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের আরেক অবিসংবাদিত নেতা ম্যাল এক্স (মালিক আল শাব্বাজ) শ্বেতাঙ্গ সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন। ১৯৬৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নিউ ইয়র্কে একটি হলরুমে বক্তৃতা করতে দাঁড়ালে হঠাৎ একসঙ্গে কয়েকটি বন্দুক গর্জে ওঠে। বুকে ৯৫টি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ম্যাল এক্স তথা মালিক আল শাব্বাজ। এভাবেই যুগে যুগে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ মানবতার পক্ষে সোচ্চার কণ্ঠস্বরগুলোকে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমেরিকার দীর্ঘ ইতিহাসে বর্ণবাদকেন্দ্রিক সহিংসতার বহু নজির রয়েছে। তবে বিগত অনেক বছর ধরে আমেরিকায় বিভিন্ন ধর্মের অনুসারী ও বর্ণের মানুষের মধ্যে এক ধরনের স্বাভাবিক সম্পর্ক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখায় একটা প্রয়াস লক্ষণীয় ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছরে বিশেষ করে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ঘুমিয়ে পড়া বর্ণবাদের দৈত্য আবারও জেগে উঠেছে। বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ ও উগ্র ডানপন্থীদের কট্টর সমর্থকেরা হোয়াইট হাউসে শক্ত আসন গেড়ে বসেছে। বর্ণবাদী সন্ত্রাস যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করছে।
১৭৭৬ সালে প্রণীত যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের ভিত্তিতে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে, সে ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে, ‘We hold these truths to be self-evident, that all men are created equal, that they are endowed by their Creator with certain unalienable Rights, that among these are Life, Liberty and the pursuit of Happiness.’ শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি, সাদা-কালো বিভাজন ও আমেরিকার কালো মানুষদের স্রষ্টা প্রদত্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা নয় কি? মানবগোষ্ঠীর কৃষ্ণাঙ্গ সদস্যদের পদদলিত করে, হত্যা-নির্যাতন করে, তাদের প্রতি অন্যায়-অবিচার করে শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদাররা নিজেদের সভ্য বলে দাবি করবেন কোন যুক্তিতে? শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতিবাদের ভাষা ‘নো জাস্টিস, নো পিস’ গৌরবের, কিন্তু প্রতিবাদের নামে লাগাতার ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ কীভাবে ন্যায়বিচার ও শান্তির পথ হতে পারে?
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Discussion about this post