ক্রীড়া ডেস্ক
মাশরাফি বিন মর্তুজার আগে সে অর্থে এক্সপ্রেস ফাস্টবোলার খুব কম ছিল বাংলাদেশের। হাতে গোনা কয়েকজন জোরে বল করতেন। গোলাম নওশের প্রিন্স অবশ্যই কুইক বোলার। এ বাঁহাতি পেসার কৌণিক ডেলিভারির পাশাপাশি বল ভেতরেও আনতে পারতন।
এছাড়া জাহাঙ্গীর শাহ বাদশাহও সন্দেহাতীতভাবে কোয়ালিটি মিডিয়াম পেসার। নিখুঁত ও মাপা লাইন লেন্থ। নিয়ন্ত্রিত সুইং ছিল যার বড় সম্পদ। এদের সঙ্গে আরও একজন পেসার ছিলেন, যিনি বেশ জোরে বল করতেন। ১৯৯৯ সালের প্রথম বিশ্বকাপ ও অভিষেক টেস্টে তিনিই ছিলেন টিম বাংলাদেশের এক নম্বর পেসার।
বলা হচ্ছে, হাসিবুল হোসেন শান্তর কথা। মাশরাফির আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তিনিই ছিলেন বাংলাদেশের এক্সপ্রেস বোলার, পেস বোলিংয়ের চালিকাশক্তি। পরিসংখ্যান ও রেকর্ড দেখে শান্তকে মূল্যায়ন করা কঠিন।
সবচেয়ে বড় কথা, তিনি পেস বোলিং দিয়ে যতো না পরিচিত, তাকে তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ চেনেন ৯৭’র আইসিসি ট্রফির ফাইনালে কেনিয়ার বিপক্ষে শেষ বলে লেগ বাই থেকে তুলে আনা জয়সূচক রানটি নেয়ার জন্য।
বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিককার ‘পোস্টার বয়’ হাসিবুল হোসেন শান্ত। তার সেই ঐতিহাসিক দৌড় প্রতিটি বাংলাদেশ সমর্থক ও ভক্তর স্মৃতিতে ভাস্বর। হাসিবুল শান্তর নাম উচ্চারিত হলেই সবার চোখে ভেসে ওঠে সেই ঐতিহাসিক ছবি।
মালয়েশিয়ার কিলাত ক্লাবে আইসিসি ট্রফির ফাইনালের শেষ বলে এক রান দরকার থাকা অবস্থায় খালেদ মাসুদ পাইলটের সাথে তার রুদ্ধশ্বাস দৌড়। যে দৌড় বাংলাদেশকে পৌঁছে দিয়েছিল জয়ের বন্দরে, কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ জিতেছিল আইসিসি ট্রফি।
আইসিসি ট্রফি বিজয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে এক বলে এক রান দরকার থাকা অবস্থায় লেগবাইতে পাওয়া সেই জয়সূচক রান নিয়েই আসলে দেশের কোটি কোটি ক্রিকেট ভক্ত, সমর্থকদের মনে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছেন শান্ত। তার নামটি এখনও সবার মনের আয়নায় জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু সেটাই তার প্রথম পরিচয় নয়, তিনি পেস বোলার এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলা পেসারদের ভেতরে অন্যতম সেরা পেসার।
সেটাই তার সম্পর্কে চূড়ান্ত মূল্যায়ন নয়। ইতিহাস জানাচ্ছে, হাসিবুল হোসেন শান্ত দুটি দূর্লভ রেকর্ডেরও সাক্ষী। একটি হলো, তিনিই বিশ্বকাপের মাঠে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ওভার বোলিং করেছেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ মে চেমসফোর্ডে নিউজিল্যান্ডের ওপেনার ম্যাট হর্নের বিপক্ষে প্রথম ওভার বোলিং করেন শান্ত। একটি ওয়াইড (পঞ্চম ডেলিভারিটি লেগ সাইডে ওয়াইড) দেয়া ছাড়া সে ওভার থেকে ব্যাটে কোন রান নিতে পারেননি কিউই ওপেনার হর্ন।
একইভাবে অভিষেক টেস্টের প্রথম বলটিও কিন্তু শান্তর করা। ২০০০ সালের ১১ নভেম্বর ভারতীয় ওপেনার শিব সুন্দর দাসের বিপক্ষে প্রথম ওভার বোলিং করেন শান্ত।
তখন অর্থাৎ ৯৯’র বিশ্বকাপের আগে বাংলাদেশ ওয়ানডে খুব কম খেলার সুযোগ পেত। তাই প্রায় ১০ বছরের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে শান্তর ম্যাচ মোটে ৩২টি। ১৯৯৫ সালের ৬ এপ্রিল শারজায় এশিয়া কাপ দিয়ে ওয়ানডে অভিষেক। আর ২০০৪ সালের ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে শেষ ম্যাচ।
টেস্ট ক্যারিয়ার আরও ছোট। ভারতের সাথে ২০০০ সালে অভিষেক টেস্ট দিয়ে শুরু। আর ২০০১ সালের মার্চে ওয়েলিংটনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ টেস্ট খেলতে নামা। টেস্ট খেলেছেন সাকুল্যে ৫টি (৬ উইকেট) আর ওয়ানডে সংখ্যা ৩২ (উইকেট ২৯)।
এর ভেতরে কেনিয়ার বিপক্ষে এক ম্যাচে ৪ উইকেট আছে শান্তর। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পেসারদের শুরুর দিকে ৪-৫ উইকেট খুব বেশি নেই। হাসিবুল হোসেন শান্ত তাদেরই একজন। এছাড়া তার পাকিস্তানের বিপক্ষে আরও একটি স্পেল আছে, সেটা ৯৯’র মার্চে।
বিশ্বকাপের আগে পাকিস্তান দল বাংলাদেশে এসেছিল একটি ম্যাচ খেলতে। সে খেলায় বাংলাদেশের বিপক্ষে ১৫২ রানের বিশাল জয় পেয়েছিল পাকিস্তারিরা। সাঈদ আনোয়ার, ইজাজ আহমেদ আর ইনজামাম উল হকরা সেদিন রান উৎসবে মেতেছিলেন। সে ম্যাচে বাংলাদেশের সবচেয়ে মিতব্যয়ী বোলার ছিলেন শান্ত, ১০ ওভারে ৫০ রান দিয়েছিলেন। পাশাপাশি ৩টি উইকেটও দখল করেছিলেন।
তিনজনই হার্ড হিটার, বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগেই শান্ত তাদের ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। ঐ ম্যাচে শান্তর প্রথম শিকার ছিলেন তখনকার ভয়ংকর ওপেনার শহিদ আফ্রিদি (২২ বলে ১৭), পাকিন্তান ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান ইনজামাম (৭৯ বলে ৭০) আর শেষ দিকে হাত খুলে রান সচল করায় সিদ্ধহস্ত মঈন খান (২৪ বলে ৩২)।
শান্ত যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন, তখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই শচিন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, সাঈদ আনোয়ার, ইনজামাম উল হক, সেলিম মালিক, ইজাজ আহমেদ, শহিদ আফ্রিদিদের তোপ সামলাতে হতো। কাজটা সহজ ছিল না মোটেও। কাজেই শুধু পরিসংখ্যান দিয়ে শান্তকে মাপা ঠিক হবে না।
এ দীর্ঘদেহী হাই আর্ম অ্যাকশনের পেসার কাম হার্ড হিটার বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম ভাল পেসার। আজ শান্তর (৩ জুন) ৪৩তম জন্মদিন। ১৯৭৭ সিলেটের মৌলভীবাজারে জন্ম হয়েছিল এ সদা হাস্যোজ্জ্বল ও প্রাণখোলা স্বভাবের ক্রিকেটারের।
Discussion about this post