ক্রীড়া ডেস্ক
খেলোয়াড়ি জীবনে না হলেও খেলা ছেড়ে অনেক ক্রিকেটারই আজকাল ক্যারিয়ারের অনেক অজানা ঘটনা ও না বলা কথাবার্তা বলছেন। ক্যারিয়ারের অনেক পুরোনো স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে অনেকেই একে-ওকে দুষছেন।
কিন্তু জাতীয় দলের সাবেক পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত খেলা ছাড়ার পর কখনও জহুর এলাহির ওপর দোষ চাপাননি। কোন বিদ্বেষমূলক বিবৃতিও দেননি। কোন সাক্ষাৎকারে শান্ত বলেননি যে, জহুর এলাহিই আমার ক্যারিয়ারের সর্বনাশ করেছে, তার কারণেই আমার বোলিং ক্যারিয়ারটা নষ্ট হয়েছে।
শান্ত অভিযোগ করেননি, জহুর এলাহিকে কখনও আসামীর কাঠগড়ায়ও দাঁড় করাতে চাননি। হাঁটুতে ব্যথা পাওয়ার ঘটনা নিয়ে কথা বললেও মুখ ফুটে সরাসরি জহুর এলাহিকে আক্রমণ করে কোন বিবৃতি দেননি কখনও। বরং বারবার বিনয় ও সর্বোচ্চ সৌজন্যতাবোধ নিয়ে যতটা সম্ভব রয়েসয়েই কথা বলেছেন ।
জহুর এলাহির ওপর শতভাগ দোষ না চাপালেও, ইতিহাস বলছে শান্তর ইনজুরির ঘটনায় পাকিস্তানের সাবেক জাতীয় ক্রিকেটারই দোষী। তার ব্যাটই শান্তর হাঁটুতে গিয়ে আঘাত হানে, সেই হাঁটুর আঘাত বড়সড় ইনজুরি হয়ে দেখা দেয়। যে কারণে শান্তকে প্রায় ছয় মাস মাঠের বাইরে কাটাতে হয় এবং সে ইনজুুরি আর পুরোপুরি ভালও হয়নি। শান্ত আর নিজেকে ফিরেও পাননি।
সেটা ছিল ১৯৯৯ সালে প্রিমিয়ার লিগের ঘটনা। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত টানা ৫ মৌসুম মোহামেডানে খেলার পর সেবারই আবাহনীতে যোগ দিয়েছিলেন শান্ত। লিগের প্রথম থেকে ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। প্রথম তিন-চার ম্যচেই তুলে নিয়েছিলন ১২-১৩ উইকেট।
তখনই কলাবাগানের সঙ্গে ম্যাচে ঘটে তার ক্যারিয়ারের সেই বিষাদময় ঘটনা। কলাবাগানও তখন খুব ভাল দল। পাকিস্তানের জহুর এলাহি ছিলেন ফর্মের তুঙ্গে। আগের খেলাগুলোয় একাধিক সেঞ্চুরিও করেছিলেন। কিন্তু আবাহনীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শান্ত তাকে ফিরিয়ে দেন মাত্র ১২ রানে।
শান্তর অফস্টাম্পের ঠিক বাইরের বলে গালিতে ক্যাচ তুলে বিদায় নিয়েছিলেন জহুর এলাহি। আউট হওয়ার পর শান্ত যখন উল্লাতে ফেটে পড়েছিলেন, ঠিক তখনই জহুর এলাহির ব্যাট গিয়ে আঘাত হানে তার ডান ঊরুতে। আর সঙ্গে সঙ্গে থেমে যায় উল্লাস, মাটিতে লুটিয়ে পড়েন শান্ত। সে ইনজুরিই কাল হয়ে দাঁড়ায়। সেবার আর প্রিমিয়ার লিগে খেলতে পারেননি। প্রায় ছয় মাসের মত মাঠের বাইরে কাটাতে হয়।
সেই ব্যাট কি জহুর এলাহি ইচ্ছে করে ছুড়ে দিয়েছিলেন? নাকি তার হাত ফস্কে উল্লাসে মাতোয়ারা শান্তর হাটুতে গিয়ে লাগে? এ প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানাই রয়ে গেছে। সবচেয়ে আশ্চর্য্যজনক বিষয় হলো, শান্ত নিজেও এখনও এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরছেন। তার এখনও বুঝে উঠতে কষ্ট হয়, আসলে কি জহুর এলাহি ইচ্ছে করেই তার শরীরে ব্যাট ছুড়ে দিয়েছিলেন?
আজ (বুধবার) নিজের ৪৩তম জন্মদিনে জাগো নিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপে সেই দিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শান্ত বলেন, ‘আসলে আমি এখনও ভেবে পাই না, জহুর এলাহি কি ইচ্ছে করেই ব্যাট ছুড়ে মেরেছিলেন কি না আমাকে?’
তাহলে কী মনে হয় আপনার? শান্তর ব্যাখ্যা, ‘আসলে সেটা ছিল ঐবারের লিগের খুব বড় ম্যাচ। কলাবাগান সেবার ভাল দল, আবাহনীও শিরোপা প্রত্যাশী। জহুর এলাহি ছিল ফর্মের চূড়ায়। সে আগের ম্যাচগুলোয় সম্ভবত একাধিক সেঞ্চুরি করেছিল। আমিও খুব ভাল বোলিং করে প্রথম তিন-চার ম্যাচে মনে হয় ১২-১৩ উইকেট দখল করেছিলাম। খুব স্বাভাবিকভাবেই কলাবাগান তাকিয়ে ছিল জহুর এলাহির দিকে। আমিও চাইছিলাম তাকে অল্প রানে আউট করতে। আমার বলে খুব সম্ভবত ১২ রানে গালিতে ক্যাচ দিয়ে আউট হন জহুর এলাহি। আমি উল্লাসে তার খুব কাছে গিয়ে বললাম, হেই ম্যান আমি তোমাকে আউট করেছি। আর পরক্ষণেই তিনি ব্যাট ছুড়ে দিলেন। ঠিক কেন ছুড়লেন? আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।’
‘প্রথমে মনে হয়েছিল দলের ও নিজের প্রত্যাশা পূরণ করতে না পেরে অল্প রানে আউট হওয়ায় নিজের ওপর হতাশ প্রকাশে জহুর এলাহি তার ব্যাট ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। যা আমার হাঁটুতে গিয়ে আঘাত হানে। সেটা ইচ্ছে করেই আমাকে আঘাত করার জন্য কি না?- তা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি। সেটা আসলে মহান আল্লাহ আর জহুর এলাহিই ভাল বলতে পারবেন। এ ছাড়া আর কারও পক্ষে বলাও সম্ভব না।’
জহুর এলাহিকে না দুষলেও হাসিবুল শান্ত মানছেন, ঐ পাকিস্তানির ছুড়ে দেয়া ব্যাট হাঁটুতে লাগায় যে ইনজুরির শিকার হয়েছিলেন, সেটা তার ক্যারিয়ারের জন্য রীতিমতো কুঠারাঘাত। শান্তর ধারণা, তার টেস্ট ক্যারিয়ার দীর্ঘ না হওয়ার প্রধান কারণ ঐ ইনজুরি।
তার ভাষায়, ‘আসলে ঐ হাঁটুর ইনজুরি আমার সবচেয়ে ক্ষতি করেছে আমার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে, টেস্ট ক্যারিয়ার লম্বা হয়নি ঐ হাঁটুর ব্যথার কারণে। আমি অভিষেক টেস্টেও শতভাগ ফিট হয়ে স্বাভাবিক ছন্দে বোলিং করতে পারিনি। বলের গতি কম ছিল।’
দীর্ঘদিন পর আজ জন্মদিনের শুভক্ষণে একটি আক্ষেপের কথাও শুনিয়েছেন শান্ত। মনের দুঃখ জানিয়ে বলেন, ‘তখনকার বোর্ড আমার কোনরকম চিকিৎসার উদ্যোগ নেয়নি। এখন জাতীয় দলের ক্রিকেটারদের দেখভালের কত সুব্যবস্থা! আমাদের সময় কিছুই ছিল না। হাঁটুর ইনজুরির সত্যিকার ও উন্নত চিকিৎসা হয়নি তখন।’
‘ব্যথা কমে না দেখে আমি নিজে ব্যাঙ্গালুরুতে গিয়ে চিকিৎসা করাই। সেখানকার চিকিৎসকরা জানান, আমাার হাঁটুর বাটির ভেতরের হাড় ভেঙে ছোট ছোট টুকরা হয়ে গিয়েছিল। তারা কিছু বেরও করেছিল। কিন্তু তাতেও আমার হাঁটুর ক্ষত সারেনি আর। সত্যি বলতে কি আমি আর স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে পাইনি আর নিজের সেরা ফর্মে ফেরা সম্ভব হয়নি।’
Discussion about this post