ছেলেটি তার বয়সী অন্যদের চেয়ে একটু আলাদা। লিকলিকে গড়ন, গড়পড়তা বাঙালি তরুণদের চেয়ে দীর্ঘদেহী। অন্য রকম এক ব্যক্তিত্বের অধিকারী। না, মোটেও রাশভারী নয়, বরং উল্টো। অফুরন্ত প্রাণশক্তি, বন্ধু-অন্তঃপ্রাণ, আড্ডার মধ্যমণি। সারা দিন হইহুল্লোড় আর বন্ধুদের নিয়ে গলা ছেড়ে গান। ’৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন যখন দানা বাঁধতে শুরু করে, তখন ওই কিশোর ছেলের বুকেও দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার আগুন। সুরের মূর্ছনায় মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টায় আত্মনিয়োগ করে নিজেকে। বলছি কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী আজম খানের কথা।
১৯৬৮ সালে, তাঁর বয়স যখন ১৮, যোগ দেন গণসংগীত শিল্পীগোষ্ঠী ‘ক্রান্তি’র সঙ্গে। ১৯৬৯–এ গণ–অভ্যুত্থানে ছিলেন সামনের সারিতে। সংগত কারণেই পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর চক্ষুশূল ছিলেন তাঁরা। এ সময়ে নানা রকম বাধা ও হয়রানির শিকার হতে হয় তাঁদের।
১৯৭১–এর ২৫ মার্চের কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাকাণ্ড এবং তৎপরবর্তী সময়ে তাদের অত্যাচার-নির্যাতন আজম খানকে করে বিক্ষুব্ধ। সিদ্ধান্ত নেন যুদ্ধে যাবেন তিনি। মাকে কথাটা বলতেই মা বললেন বাবার সঙ্গে কথা বলার জন্য। ভয়ে ভয়ে বাবার কাছে অনুমতি চাইলেন আজম। কথাটা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন সরকারি কর্মকর্তা আজম খানের বাবা। তিনি ভেবেছিলেন বাবা হয়তো ‘না’ বলবেন। কিন্তু আজম খানকে অবাক করে দিয়ে তাঁর বাবা বললেন, ‘যুদ্ধে যাচ্ছিস যা, দেশ স্বাধীন না করে ফিরবি না।’ নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না আজম!
কয়েকজন বন্ধু মিলে আজম খান বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে। প্রথমে কুমিল্লা, তারপর সেখান থেকে হেঁটে আগরতলা। আগরতলা থেকে মেঘালয়ে গিয়ে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ২ নম্বর সেক্টরে যোগ দেন। সেখানে দুই মাস প্রশিক্ষণ শেষে সম্মুখযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁর প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল কুমিল্লার সালদায়। সফলভাবে সেই অপারেশন সম্পন্ন করার পর সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফ তাঁকে ঢাকায় গেরিলা অপারেশন পরিচালনার জন্য সেকশন কমান্ডারের দায়িত্ব দেন। গুলশান ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় তাঁরা বেশ কয়েকটি দুঃসাহসী অপারেশন পরিচালনা করে পাকিস্তান বাহিনীর ঘুম হারাম করে দেন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল ‘অপারেশন তিতাস’। এর মূল লক্ষ্য ছিল ঢাকা শহরের গ্যাস পাইপলাইন ধ্বংস করে দেওয়া।
ক্যাম্পে থাকাকালীন আজম খান বাটি আর চামচকে বাদ্যযন্ত্র বানিয়ে গান করতেন। আর এর মধ্য দিয়ে চাঙা রাখতেন মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তাঁর অমর গ্রন্থ ‘একাত্তরের দিনগুলি’তে লেখা, ‘২০ আগস্ট ১৯৭১। একটি তাঁবুতে আলো জ্বলছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে গানের সুর—“হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ।” বুঝলাম আজম খান গাইছে। আজম খানের সুন্দর গলা। আবার অন্যদিকে ভীষণ সাহসী গেরিলা, দুর্ধর্ষ যোদ্ধা।’
সেই রক্তঝরা উত্তাল দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে গিয়ে বিশিষ্ট নাট্যকার ও মুক্তিযোদ্ধা নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বলেন, ‘আজম খান মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক জগতে একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি। এই আজম খানের বেড়ে ওঠার সময়ের একজন সাক্ষী আমি। ষাটের দশকে কৈশোর ও যৌবনের আবেগদীপ্ত সময় একসঙ্গে কাটিয়েছি আমরা কজন ঢাকার বন্ধু। আজমের সারল্য আমাকে কৈশোরেই আকৃষ্ট করেছিল। আমাদের ছাত্রজীবন কেটেছে আন্দোলনে-সংগ্রামে। একটি জাতির স্বাধীন হওয়ার প্রক্রিয়ায় আমরা সবাই জড়িয়ে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আজম মেলাঘরে পাহাড়ের পাদদেশে টিনের বাসন ও চামচ দিয়ে তাল ঠুকে গান গাইতেন, সঙ্গে ছিল অনেক তরুণ যোদ্ধা। এ দৃশ্য ভোলার না!’
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আজম খান তাঁর সহযোদ্ধাদের নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। ঢাকায় প্রবেশের প্রাক্কালে মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে এক সম্মুখযুদ্ধে পরাজিত করেন পাকিস্তান বাহিনীকে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। অনেক ক্ষেত্রে যুবসমাজ বিভ্রান্ত, কেউ কেউ বিপথগামী। এই যুবকদের সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে আজম সংগীতকে বেছে নেন অস্ত্র হিসেবে। পশ্চিমা রক সংগীতের আদলে তিনি বাংলা সংগীতে যুক্ত করেন এক নতুন ধারা। তাঁর সৃষ্ট ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ অল্প কিছুদিনের মধ্যে তরুণদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। অনেকেই আজম খানকে বাংলার বব ডিলান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ষাটের দশকে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বব ডিলানের গান যেভাবে মুক্তিকামী মানুষকে সাহস জুগিয়েছে, তেমনি করে আজম খানের গানও অনুপ্রাণিত করেছে এ দেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীকে।
সংগীতের ওপর তাঁর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, কিংবা কারও কাছে সে অর্থে গান শেখেননি তিনি। অথচ তিনিই বাংলা পপ সংগীতের মুকুটহীন সম্রাট। কোনো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন না গুরু! তবে কেউ, সে যে যন্ত্রই হোক, ভুল বাজালে সঙ্গে সঙ্গে তিনি তা ধরে ফেলতেন এবং শুধরে দিতেন। তাঁর অবিসংবাদিত কিছু গান সৃষ্টির পেছনের কথা:
১.
আলাল ও দুলাল
আজম খানের দুই প্রিয় বন্ধু, দুই ভাই শাহজাহান ও জাহাঙ্গীর। এই দুই ভাইকে তাঁরা দুষ্টুমি করে আলাল ও দুলাল বলে ডাকতেন। গানে তাঁদের বাবার নাম হিসেবে ব্যবহৃত ‘হাজি চান’ নামটা প্রতীকী। তাঁদের বাবা সাইকেল চালাতেন। অসম্ভব ডানপিটে স্বভাবের এই দুই সহোদরকে নিয়ে এই গান: ‘আলাল ও দুলাল; আলাল ও দুলাল; তাদের বাবা হাজি চান; চানখারপুলে প্যাডেল মেরে পৌঁছে বাড়ি।’
২.
হাইকোর্টের মাজারে
গুরু একদিন হাইকোর্টের মাজারে যান। সেখান থেকে বেরিয়ে রিকশা করে বাসায় ফিরছিলেন। রিকশা ভাড়া দিতে গিয়ে দেখেন মানিব্যাগ নেই! বুঝতে বাকি রইল না মাজারেই হাওয়া হয়ে গেছে সেটা। কিছুটা দুঃখ আর হতাশা থেকে সৃষ্টি হলো অসম্ভব জনপ্রিয় এক গানের, ‘হাইকোর্টের মাজারে কত ফকির ঘুরে, কজনা আসল ফকির; প্রেমেরও বাজারে কত প্রেমিক ঘুরে কজনা আসল প্রেমিক।’
৩.
রেললাইনের ওই বস্তিতে
১৯৭৪–এর দুর্ভিক্ষের সময় আজম খান একদিন রেললাইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। অসংখ্য অভুক্ত শিশু তাঁকে ঘিরে ধরল সাহায্যের জন্য। তাঁর কাছে যা ছিল সব দিয়ে দিলেন। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয় নিয়ে তিনি তৈরি করলেন কালজয়ী এক গানের, ‘রেললাইনের ওই বস্তিতে; জন্মেছিল একটি ছেলে; মা তার কাঁদে; ছেলেটি মরে গেছে; হায় রে হায় বাংলাদেশ।’
৪.
ওরে সালেকা ওরে মালেকা
একদিন দুপুরবেলায় আজম তাঁর বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা মারছিলেন তাঁদের পাড়ায় নির্মাণাধীন হোটেল টাওয়ারে। এ সময়ে তাঁর বন্ধু নীলু পানির ট্যাংকির মুখকে ড্রাম বানিয়ে বাজানো শুরু করলেন। আর স্বভাব কবি আজমের কণ্ঠ থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে এল,‘’ওরে সালেকা, ওরে মালেকা; ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে।’
৫.
পাপড়ি কেন বোঝে না
গুরুর বাসায় দোতলায় ভাড়া থাকত মেয়েটা। তার সঙ্গে প্রেম হয়ে যায় গুরুর। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর শুভ পরিণতিতে গড়ায়নি প্রেম। প্রচণ্ড কষ্ট নিয়ে তিনি গান বাঁধলেন: ‘সারা রাত জেগে জেগে কত কথা আমি ভাবি; পাপড়ি কেন বোঝে না; তাই ঘুম আসে না।’
রণাঙ্গন দাপানো, গানের মঞ্চ কাঁপানো বাংলা পপ গানের এই গুরু ছিলেন প্রচারবিমুখ, নির্মোহ আর বিনয়ী। মাটির মানুষ বলতে যা বোঝায়, আজম খান ছিলেন তেমনি এক ব্যক্তিত্ব। তিনি বেঁচে থাকবেন আজীবন ভক্তকুলের হৃদয়ে তাঁর কালজয়ী গানের মধ্য দিয়ে।
Discussion about this post