বিশেষ প্রতিবেদক
এ বছরের এসএসসি পরীক্ষায় দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অধীনে এ বিদ্যালয় থেকে অংশ নিয়েছিল মাত্র সাত শিক্ষার্থী। তাদের সবাই ফেল করেছে। ১১ শিক্ষক মিলেও সাত পরীক্ষার্থীকে পাস করাতে পারেননি! ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পুরোনো এ বিদ্যালয়ের ১১ এমপিওভুক্ত শিক্ষক প্রতি মাসে সরকার থেকে বেতন-ভাতা পান।
এ বিদ্যালয়ের মতো সারাদেশের ১০৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি। এই ১০৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৪৮টি দাখিল মাদ্রাসা এবং ৫০টি ভোকেশনাল স্কুল। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৮১৯ জন। মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে যে ৪৮টি মাদ্রাসার একজনও পাস করতে পারেনি, তার মধ্যে অন্তত নয়টি মাদ্রাসার পরীক্ষার্থী ছিল মাত্র একজন করে! সেই একজনকেও ১১ জন শিক্ষক মিলে পাস করাতে পারেননি। দিনাজপুর জেলার খানসামা উপজেলার চকরামপুর হাই স্কুল।
শিক্ষাবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন, এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাহলে রেখে লাভ কী। তাদের পরামর্শ, মানহীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে প্রয়োজনে পার্শ্ববর্তী বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এসব প্রতিষ্ঠান একীভূত করে দেওয়া যেতে পারে। এতে শিক্ষার্থীরাও মানসম্মত শিক্ষা পাবে, সরকারেরও অহেতুক অর্থ অপচয় রোধ হবে। এ ছাড়া এসব উদাহরণ শিক্ষাব্যবস্থায় মনিটরিংয়ের দুর্বলতার পরিচয় বহন করে বলে তারা মনে করেন।
২০২০ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল গত ৩১ মে ঘোষণা করা হয়। এবার সারাদেশে গড় পাসের হার ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ। এ বছর মোট জিপিএ ৫ পেয়েছে এক লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৮ জন, যা গত বছর পেয়েছিল এক লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন। ফলে দেখা গেছে, এবার এসএসসি-সমমান পরীক্ষায় ২০ লাখ ৪০ হাজার ২৮ শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। তাদের মধ্যে ১৬ লাখ ৯০ হাজার ৫২৩ জন পাস করেছে। এত ভালো ফলের পরও ১০৪টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কেউ পাস করেনি। এর মধ্যে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
এমপিওভুক্তির জনবল কাঠামো অনুসারে মাধ্যমিক স্তরের (দশম শ্রেণি পর্যন্ত) প্রতিটি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা একজন প্রধান শিক্ষক/সুপারসহ মোট ১২ জন শিক্ষক সরকার থেকে এমপিওভুক্ত হয়ে বেতন পেয়ে থাকেন। এর সঙ্গে আরও চারজন কর্মচারীও এমপিওভুক্ত হন। সরকারের বিপুল বিনিয়োগ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে।
এমপিওভুক্তির নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. গোলাম ফারুক বলেন, ‘শতভাগ ফেল করা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হবে। জবাব সন্তোষজনক না হলে আমরা তাদের এমপিওভুক্তি স্থগিত করে দেব। বোর্ড পরীক্ষার পরবর্তী ফল ভালো না পর্যন্ত এমপিও স্থগিতই থাকবে।’
বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘শতভাগ ফেল করার দায় শিক্ষার্থীর একার নয়, তারা ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থার শিকার। দেশে পাসের হার বেড়েছে, শিক্ষার মান বাড়েনি। মনিটরিংয়ের বালাই নেই। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এখন আগে জরুরি।’ তিনি বলেন, মানহীন প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়াই শ্রেয়। প্রয়োজনে পাশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মার্চ করে দেওয়া যেতে পারে।’
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই বছর সাতক্ষীরার কলারোয়া শহীদ সত্য সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল মাত্র এক শিক্ষার্থী। দুর্ভাগ্যক্রমে ইংরেজিতে ফেল করেছে সে। বিস্ময়কর হলো, এ বিদ্যালয়ে ইংরেজি এবং গণিতের কোনো শিক্ষকই নেই। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আল হুদা আদর্শ দাখিল মাদ্রাসায় চলতি বছরে ২০ জন দাখিল পরীক্ষার্থী ছিল। তাদের সবাই গণিত, আরবি বা উভয় ক্ষেত্রেই ফেল করেছে। প্রতিষ্ঠানটিতে গণিত ও আরবি বিষয়ে কোনো শিক্ষক নেই।
এবার মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীনে ৯ হাজার ১০০টি মাদ্রাসা দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। গতবার মাদ্রাসাগুলোতে ৮৩ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ পাস করলেও এবার পাস করেছে ৮২ দশমিক ৫১ শতাংশ। অতীতে প্রায় প্রতি বছরই মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার তুলনামূলক অন্য বছরের চেয়ে বেশি ছিল। ২০১৫ সালে এই বোর্ডে পাসের হার ছিল ৮৮ দশমিক ২২ শতাংশ। মাদ্রাসাগুলোর প্রতি মাদ্রাসা বোর্ড ও মাদ্রাসা অধিদপ্তরের নজরদারির অভাবে এমনটি হচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্টরা।
দাখিল ফলের তথ্য অনুযায়ী, এবার ঠাকুরগাঁওয়ের গেদুরা ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় দাখিল মাদ্রাসা, একই জেলার রানীশংকৈলের সিএস দাখিল মাদ্রাসা, দিনাজপুরের খানসামার মারগাঁও ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা, জামালপুরের সূর্যনগর বসুন্ধরা আদর্শ মাদ্রাসা, মুক্তাগাছা বিন্যাকুড়ি দাখিল মাদ্রাসা, পটুয়াখালীর বেগম রাবেয়া ইয়াছিন বালিকা দাখিল মাদ্রাসা, নাটোরের শেখপাড়া দাখিল মাদ্রাসা, বাগাতিপাড়া থেকে মাত্র একজন করে পরীক্ষার্থী দাখিল অংশ নিয়েও ফেল করেছে। এ ছাড়া ২২ পরীক্ষার্থী অংশ নিয়ে সবাই ফেল করেছে ভোলার দৌলতখানের জয়নগর আদর্শ দাখিল মাদ্রাসা থেকে। একই সংখ্যক পরীক্ষার্থীও সবাই ফেল করে যশোরের চৌগাছার মাকাপুর দাখিল মাদ্রাসা থেকে। ২০ পরীক্ষার্থী নিয়ে ফেল করেছে রাজশাহী ও রংপুরের আরও দুটি মাদ্রাসা। দুই পরীক্ষার্থীর মধ্যে দু’জনই ফেল করেছে চারটি মাদ্রাসার। আর তিন পরীক্ষার্থী নিয়ে সবাই ফেল করেছে পাঁচটি মাদ্রাসার।
Discussion about this post