বিজ্ঞানের একটি অন্যতম শাখা হচ্ছে চিকিৎসা বিজ্ঞান। আর এই চিকিৎসা বিজ্ঞানে একজন বিজ্ঞানী বিশ্বজুড়ে সুনাম অর্জন করেছিলেন। তাঁর
লেখা চিকিৎসা বিষয়ক গ্রন্থ “আল কানুন ফিল থিব” কে দীর্ঘকাল ইউরোপে
চিকিৎসার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত করা হতো। মানবদেহের অঙ্গসংস্থান ও শরীরতত্ত্ব সন্বন্ধে তিনি যে সব তথ্য প্রদান করেছিলেন সেগুলো সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশের চিকিৎসকেরা অনুসরণ করেছিলেন। বলা যায়, শল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে তাঁর কালজয়ী
অবদান উল্লেখযোগ্য। এই খ্যাতিমান বিজ্ঞানী হচ্ছেন আবুল আলি ইবনে সিনা। তিনি ইবনে সিনা নামে অধিক পরিচিত।
বিজ্ঞানীর জীবনে অবিস্মরণীয় ঘটনা
অবাক করা ঘটনা, মাত্র দশ বছর বয়সেই ইবনে সিনা পবিত্র কোরআন শরীফ মুখস্ত করতে সক্ষম হন। ইবনে সিনা লাইব্রেরীতে পড়ার সুযোগ পেয়ে রীতিমত অধ্যয়ন শুরু
করলেন এবং লাইব্রেরীর সব বই মুখস্থ করে ফেললেন। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি
বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, গণিত, জ্যামিতি,
ন্যায়শাস্ত্র, ধর্মতত্ত্ব, চিকিৎসা বিজ্ঞান, কাব্য ও সাহিত্য বিষয়ে
অসামান্য পান্ডিত্য অর্জন করেন। ২১ বছর বয়সে তিনি আল মুজমুয়া নামে একটি
বিশ্ব কোষ রচনা করেন। এতে তিনি গণিত ছাড়া সব বিষয় লিপিবদ্ধ করেন।
বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল
এসো এবার এই বিজ্ঞানীর সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল জেনে নিইঃ
নাম- আবুল আলি ইবনে সিনা।
জন্ম-আনুমানিক ৯৮০ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বরে এবং মৃত্যু-১০ ডিসেম্বর ১০৩৭।
বাসস্থান- উজবেকিস্তানের বিখ্যাত শহর বোখারার নিকটবর্তী আফসানা গ্রামে।
শিক্ষা জীবন- শৈশবে ইবনে সিনা অত্যন্ত মেধাবী ও প্রখর স্মৃতিশক্তির
অধিকারী ছিলেন। মাত্র দশ বছর বয়সেই তিনি পবিত্র কোরআনের ৩০ পারা মুখস্ত
করেছিলেন। এছাড়া তিনজন গৃহ শিক্ষকের নিকট তিনি ধর্মতত্ত্ব, ফিকাহ্,তাফসীর, গণিত শাস্ত্র, দর্শন, ন্যায়শাস্ত্র এবং এমনকি জ্যামিতি বিষয়ে
অধ্যায়ন শুরু করেন। এভাবে তিনি মাত্র ১৭ বছর বয়সে সেসময় প্রচলিত সকল জ্ঞান অর্জন করতে পেরেছিলেন। বলা হয়ে থাকে ইবনে সিনা সাহিত্য, ধর্মতত্ত্ব, ইউক্লিডের জ্যামিতি, এরিস্টটলের দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং বীজগণিতে
বুৎপত্তি লাভ করেন। মূলত কিডোর ইচ্ছায় তাঁকে আইন শাস্ত্রে অধ্যায়ন শেষে আঠার বছর বয়সে গণিত ও চিকিৎসাশাস্ত্র অধ্যায়ন করেন। এতে তাঁর যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া দর্শন শাস্ত্রেও তিনি অধ্যায়ন করেন।
তখনকার দিনে তিনি ‘হাকিম’ অর্থাৎ প্রজ্ঞাবান উপাধিতে ভূষিত হন।
ইবনে সিনার জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। বুখারার সুলতান মাহমুদ এক কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ায় বহু নামকরা চিকিৎসক আসেন তাঁকে চিকিৎসা করতে।কেউ পারলেন না তাঁর রোগ নির্ণয় করতে। এ মুহূর্তে তরুণ ইবনে সিনা স্বেচ্ছায়
রাজ দরবারে গিয়ে রাজার চিকিৎসার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন। সহসাই তিনি
অনুমতি পেলেন। ইবনে সিনার চিকিৎসার গুণে অতি অল্পদিনের মধ্যে সুলতান আরোগ্য লাভ করলেন। সুলতানও তাঁর প্রতি খুশী হলেন এবং চাইলেন তাঁকে
পুরস্কৃত করতে। এ সময় ইবনে সিনা সুলতানের প্রিয় এক বিরাট গ্রন্থাগারে এসে পড়াশোনা করার অভিপ্রায় ব্যক্ত করলেন। বরং সুলতান তাঁর উপর সমগ্র
গ্রন্থাগারের ভার অর্পণ করলেন। হঠাৎ একদিন এই গ্রন্থাগারে আগুন লেগে সমস্ত বই নষ্ট হয়ে যায়। বিরোধীরা
সুলতানের নিকট প্রকাশ করলেন এটি ইবনে সিনার কাজ। তারা বললেন, ইবনে সিনা
বইগুলো কন্ঠস্থ করে নিয়ে ইচ্ছে করেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছেন। কানপাতলা সুলতান এ কথায় বিশ্বাস স্থাপন করলেন। এবং ইবনে সিনাকে বিতাড়িত করলেন।মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। এই
ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজাগণ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার প্রতি আগ্রহশীল হয়ে
উঠেছিলেন। আর এসব রাজ্যের রাজাগণ চাইতেন রাজসভায় বড় বড় পণ্ডিত রাখতে। ইবনে
সিনার তেমন অসুবিধা হলো না। তিনি বুখারা পরিত্যাগ করে খরজমে গেলে সেখানকার
সুলতান তাঁকে রাজচিকিৎসক নিয়োগ করলেন।
খরজমের রাজসভায় বহু গণ্য-মান্য ব্যক্তিবর্গ ছিলেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক,বিজ্ঞানী ও দার্শনিক আলবেরুনী যিনি সুলতান মাহমুদের সঙ্গে ভারতবর্ষে
এসেছিলেন এবং তৎকালীন ভারতের ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। একদিন সুলতান মাহমুদের কর্ণগোচর হয় ইবনে সিনা, আলবেরুনী প্রভৃতি পণ্ডিতের পাণ্ডিত্যের
খ্যাতি। তিনি খরজমের সুলতানের কাছে তাঁরই সভায় প্রেরণের দাবী করলেন। আর
মাহমুদের
দাবীকে উপেক্ষা করতে পারলেন না খরজমের শাসক। তিনি পণ্ডিতদের
সেখানে প্রেরণ করলেন। কিন্তু ইবনে সিনা কেমন যেন ঘৃণাবোধ করায় সুকৌশলে নিজেকে মুক্ত করে পালিয়ে গেলেন। কিছুদিন অগোচরে থাকার পর ইবনে সিনা একদিন উপস্থিত হলেন ইরানের রাজসভায়।সুলতান তাঁর পূর্ণ পরিচয় পেয়ে খুব আনন্দিত হলেন। সেই সঙ্গে তাঁকে
সভাপণ্ডিতে পদ দান করলেন। এদিকে সুলতান মাহমুদ এত সহজে হার মানার পাত্র
ছিলেন না। গুপ্তচরের মুখে সংবাদ পেয়ে ইবনে সিনাকে বেঁধে আনার নির্দেশ
দিলেন।
Discussion about this post