অনলাইন ডেস্ক
তোমরা তো নিশ্চয়ই কক্সবাজার-সেন্টমার্টিনের সৈকতে বেড়াতে গেছ, যারা গেছ তাদের নিশ্চয়ই বালুর মধ্যে আটকে থাকা ঠিক তারার মতো কিছু একটা চোখে পড়েছে। দৃষ্টিনন্দন তারাগুলো সাগরের ঢেউয়ে ভেসে আসে আর বালুর সৈকতে আটকে থাকে। শামুক-ঝিনুক কুড়ানোর মত করে অনেকেই কুড়িয়ে নেয়, কিন্তু কুড়ানোর পর নাকের কাছে নিলেই ওয়াক! ওতে যে মাছের মতো আঁশটে গন্ধ। অনেক আবার খুব সুন্দর জিনিস দেখে শখ করে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেই। ব্যাস সমস্যা হবে তখনই। মরার পর দু-একদিন ব্যাগে থাকলে তো কথাই নেই, বাড়িশুদ্ধ লোক টের পাবে কী আছে ব্যাগে।
বস্তুটার গন্ধ যখন আঁশটে তখন তোমাদের মনে হতে পারে ওটা আসলে মাছ। তারপর নাম যখন ‘তারামাছ’ তখন ওটা মাছ না হয়ে কি পারে? কিন্তু ‘তারামাছ’ আসলে মাছ নয়, সাগরের এক অমেরুদণ্ডী একাইনোডার্মাটা বর্গের প্রাণী। ওর শরীরে কোনো কাঁটা বা হাড় ও আইশ নেই, মাছের মতো ফুলকা নেই। জলে থাকে, তারার মতো গড়ন। সে জন্য ওকে বলে তারামাছ। অনেকে আবার ওকে মাছ বলতে রাজি না। তারা এই প্রাণীকে বলে ‘সি স্টার’। আকাশের তারার মত তারামাছের শরীরের পাঁচ দিকে পাঁচটা সুন্দর বাহু থাকে। আচ্ছা ভালো কথা, আসলেই কি আকাশের তারার পাঁচ বাহু থাকে? না, মোটেই তা নয়। আকাশের তারার কোন বাহুই থাকে না। বহুদিন আগ থেকেই আকাশের তারা বুঝাতে পাঁচবাহু ওয়ালা এই প্রতীক আমরা ব্যবহার করে আসছি। তারার প্রতীকের মত হওয়ায় এদের তারামাছ বলা হয়। তবে সবসময়ই যে সব তারামাছের পাঁচটাই বাহু থাকবে তা কিন্তু নয়। কোনো কোনো তারামাছের বাহুর সংখ্যা ৫০টি পর্যন্ত হতে পারে। সেসব তারামাছকে অনেকটা সূর্যমুখী ফুলের মতো দেখায়।
তোমাদের যেমন চোখ আছে তা দিয়ে তোমরা সব দেখতে পাও, তারামাছের কিন্তু সেরকম কোনো চোখ নেই। তবুও ওরা পানির তলে আলো আছে কি না ঠিকই তা দেখতে পারে, অন্ধকার বুঝতে পারে। ওদের প্রতিটি বাহুর মাথায় বিশেষ কিছু কোষ আছে, যা চোখের মতো কাজ করে। ওদের পাঁচটি বাহু থাকলে চোখও থাকে পাঁচটি। তারামাছের সবকিছুই মজার। মুখ থাকে পেটের কাছে। আর মলদ্বার থাকে পিঠে। ওরা মুখের চেয়েও বড় শিকার খেতে পারে। শিকার ধরার সময় শিকারকে ওরা বাহুগুলো দিয়ে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে। তারপর তাকে ঝাকি মেরে মুখের গর্তে পুরে দেয়। ওরা প্রধানত শেলফিশ খায়। এ ছাড়া অয়েস্টার, সি অর্চিন, কীট ইত্যাদিও খায়। ওরা সাধারণত সাগরের পানিতে অন্য মাছের মতো সাঁতার কেটে বেড়ায় না। তাদের চেয়েও ধীরে চলে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মাছ বা জীব শিকার করে খায়। তবে ওদের অনেক প্রজাতি আবার সাগরের পানিতে মরে পচে যাওয়া প্রাণী ও পচা আবর্জনা খেয়ে বাঁচে। তবে ওদের খাওয়ার মতো শত্রুর অভাব নেই। সাগরের মাছ, ভোদড়, পাখি এমনকি মানুষেরাও তারামাছ খায়। তারামাছ সাধারণত ২০ সেন্টিমিটার বা ৮ ইঞ্চি লম্বা হয়। তবে এর চেয়ে ছোট ও বড় তারামাছও আছে।
এমনকি ৩ মিটার লম্বা তারামাছও আছে! পৃথিবীর সব সাগর-মহাসাগরেই তারামাছ আছে। পৃথিবীতে এ পর্যন্ত প্রায় দুই হাজার প্রজাতির তারামাছের সন্ধান পাওয়া গেছে। সব তারামাছই থাকে সাগরের তলার মাটি বা পাহাড়ের খাড়ির গায়ে। বেশির ভাগ তারামাছ আছে ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরে। মিঠা পানি বা নদীতে কখনো তারামাছ থাকে না। তারামাছ ৩৫ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।
তারামাছের বাহুগুলো মিলিত হয় একটা গোলাকার চাকতির সাথে, যার ঠিক মাঝখানে থাকে মুখছিদ্র। সে মুখছিদ্র আবার থাকে দেহের নীচের দিকে। কোন খাবার মুখের ভিতরে নিতে হলে পাঁচ (বা ততোধিক) বাহুতে ভর করে মুখছিদ্রটিকে উঁচু করে তুলতে হয়। এদের দেহের কাঠামো গঠিত হয় শক্ত ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (চূনা পাথর) ঘটিত উপাদান দিয়ে তৈরি প্লেটের সমন্বয়ে। এই কারণে আমরা যেমন খাবার খাওয়ার সময় মুখ বড় করি তারা তা পারে না। মুখছিদ্রের আকার থাকে সীমিত, প্রসারণশীল নয় যার ফলে অতি ক্ষুদ্র আকারের খাদ্য গ্রহণ ছাড়া এদের উপায় থাকে না! তাই এরা সাধারণত সামুদ্রিক শৈবাল, বিভিন্ন প্রাণীর দেহাবশেষ, অতি ক্ষুদ্র ভাসমান উদ্ভিদ বা প্রাণী ছোট্ট মুখছিদ্র দিয়ে গ্রহণ করে থাকে। তবে তারামাছের বেশির ভাগ প্রজাতি এই সামান্য খাদ্যে সন্তুষ্ট থাকতে পারে না, এতে তাদের পুষ্টির প্রয়োজন মেটে না, খাওয়ার তৃপ্তিও হয় না। তখন এরা বেছে নেয় অন্য কিছু খাদ্য হিসেবে।
এই অন্য কিছুর মধ্যে থাকে এমন কিছু প্রাণী যাদের দেহের আকার তারামাছের মুখছিদ্রের চেয়ে অনেক গুণ বেশি! অয়েস্টার, চিংড়ি জাতীয় প্রাণী, ছোট মাছ, ঝিনুক এদের অনেককেই তারামাছের ক্ষুধা মেটাতে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। শক্ত প্রাচীর বেষ্টিত ছোট মুখ ছিদ্র দিয়ে কেমন করে এত বড় আকারের খাদ্য পাকস্থলীতে প্রবেশ করায় তা বেশ বিস্ময়কর! প্রাণী জগতে বিস্ময়ের অন্ত নেই! আর তেমনই এক বিস্ময় সৃষ্টি করেছে সমুদ্রে বসবাসকারী এই তারামাছ। শক্ত ঝিনুকের খোলস খুলে দেহের নরম অংশ হজম করা সহজ কাজ নয় মোটেও। একটা তাজা ঝিনুক খুলবার অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারা সবাই জানেন কাজটা কত কঠিন। এই কঠিন কাজটি করতে হয় তারামাছকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার গরজেই!
তারামাছ খুবই অলস, অথবা বলতে পারো এদের দৈহিক গঠনের কারণে এরা দ্রুত চলাচলে অক্ষম। ক্ষুধার্ত হলেও এরা শিকারের পিছনে ছুটতে পারে না, অপেক্ষা করে শিকার কাছে আসার। কোন ঝিনুক, অয়েস্টার বা ছোট মাছ কাছাকাছি এসে পড়লে তারামাছ বাহুগুলোর অগ্রপ্রান্তে ভর দিয়ে দেহের মাঝখানটা উঁচু করে রাখে। শিকার দেহের নীচে যাবার সাথে সাথে বাহু দিয়ে তাকে ঘিরে ফেলে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে। ঝিনুক জাতীয় খাবার হলে প্রথমে তার খোলস খুলবার জন্য তারামাছ সর্বশক্তি প্রয়োগ করে। তারামাছের প্রত্যেক বাহুতে সজ্জিত থাকে অসংখ্য নালী পা। পাঁচ বাহুর অসংখ্য নালী পায়ের সমন্বিত ক্রমাগত টানে ঝিনুকের দুই খোলস খুলে যেতে থাকে।
তবে অনেকটা খুলবার জন্য তারামাছ অপেক্ষা করে না। মাত্র ১ মিমি. পরিমাণ ফাঁকা হলেই তার পরিপাক যন্ত্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। তোমরা ভাবছো হয়তো ঐ ১ মিমি. ফাঁকা স্থান দিয়ে গপাগপ খেতে শুরু করে? না মোটেও তা নয়। আগেই বলেছি এরা তাদের মুখকে প্রসারণ করতে পারেনা। তাই এক্ষেত্রে তারামাছ শিকারকে তার মুখের ভিতরে নেয় না মোটেও, নিতেও পারে না। মুখের বদলে এগিয়ে দেয় সে তার পাকস্থলীটিকে শিকারের দিকে। অবাক হচ্ছো! অবাক হওয়ার মতই ঘটনা। মুখছিদ্র দিয়ে পাকস্থলী ঠেলে বাইরে বের করে এনে ঝিনুকের খোলসের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয়। পাকস্থলীর প্রাচীর দিয়ে ঝিনুকের দেহের নরম অংশ বেষ্টন করে ধরে শুরু করে দেয় হজম প্রক্রিয়া! ঝিনুকের খোলস অভ্যন্তরের মাংস তারামাছের পাকস্থলীর বেষ্টনীতে হজম হয়ে গেলে পড়ে থাকে খোলস, তারামাছ তার পাকস্থলী ফিরিয়ে নিয়ে যায় নিজের দেহের ভিতরে। বেচারা ঝিনুক বুঝতেই পারে না কি থেকে কি হয়ে যায়!
একটা তারামাছ যদি তোমরা উপুড় করে দেখ, দেখবে ওদের দেহের তলপাশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য নল বা কাঁটার মতো অঙ্গ আছে। এগুলোকে বলে টিউব ফিট বা নল পা। এর সাহায্যে তারামাছ চলাচল করে, চড়ে, হামাগুড়ি দেয় ও শ্বাস নেয়। কোনো কোনো তারামাছের ৪০ হাজার পর্যন্ত নল পা থাকে। তারামাছ নিয়ে আরো অবাক হওয়ার মত কিছু তথ্য দেই, তারামাছ প্রাণী হলেও ওদের কোনো মাথা নেই, মস্তিষ্ক নেই, দেহে এক ফোঁটা রক্তও নেই। দেহে রক্তের বদলে আছে একটি পানি সঞ্চালন ব্যবস্থা। সিভ প্লেটের মাধ্যমে ওরা পাম্প করে সাগরের পানি দেহে ঢুকায় ও বের করে। কোনো কারণে যদি ওদের একটি বাহু ছিঁড়ে বা কেটে যায় তবে আপনা আপনি আবার সেখানে এক বছরের মধ্যে একই রকম আর একটা বাহু গজায়। সাধারণত কখনো কখনো শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্য ওরা ওদের দু-একটা বাহু খসিয়ে ফেলে। যেমন ধরো সমুদ্রের অন্য কোন মাছ তারামাছকে খাওয়ার জন্য তার এক বাহুকে কামড়ে ধরলো। সাথে সাথেই তারামাছ ঐ বাহু খসিয়ে সেখান থেকে দ্রুত পালিয়ে যাবে। খালি স্থানে আরেকটি বাহু গজিয়ে যাবে ধীরে ধীরে। যদি কখনো একটা ছাড়া বাকি সব বাহু খসে যায় তাহলেও তারামাছ বেঁচে থাকে এবং পরে সব খসে যাওয়া বাহুর জায়গায় নতুন বাহুর জন্ম হয়। আবার কখনো কখনো ওদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া এক টুকরো বাহু থেকেও নতুন আর একটা তারামাছের জন্ম হয়।
তবে তোমরা ভেবো না এটাই তারামাছের বংশবৃদ্ধির মাধ্যম। তারামাছ ডিম পেড়ে বাচ্চার জন্মও দিতে পারে। মেয়ে ও পুরুষ তারামাছ আছে বটে। তবে ইচ্ছে করলে ওরা যেকোনো সময় মেয়ে বা পুরুষে রূপ নিতে পারে। পৃথিবীতে এ রকম আর একটা প্রাণীও আছে কি না জানিনা, আল্লাহ্ই ভালো জানেন! একটা তারামাছ একবারে ২০ লাখ পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। ডিম পুরুষ তারামাছ দ্বারা নিষিক্ত হওয়ার পর বাচ্চা ফুটে। বাচ্চা অবস্থায় তিন সপ্তাহের মতো থাকার পর বাচ্চারা তারা আকৃতি ধরে। সব ডিম ফুটে বাচ্চা হয় না। অনেক সামুদ্রিক প্রাণী ওদের ডিম খেয়ে ফেলে। সেটাই ভালো। নইলে সমুদ্রভর্তি হয়ে যেত তারামাছে। পৃথিবীর বহু স্থানে তারামাছ উপাদেয় খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কিছু কিছু অসাধারণ সৌন্দর্যমন্ডিত তারামাছ শো-পিস এবং মহিলাদের অলংকার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। তারামাছ শুকিয়ে সংরক্ষন করা যায়। এছাড়াও গবেষণাগারে গবেষণার জন্য তারামাছ ফরমালিন দিয়ে সংরক্ষন করা হয়।
Discussion about this post