করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে ২৯ মার্চ থেকে সংসদ টেলিভিশনে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির ক্লাস সম্প্রচার করা শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। তবে এই ক্লাস রেকর্ডিং করতে গিয়ে পুকুরচুরি করছে একটি সিন্ডিকেট। সাধারণ মানের ২০ মিনিটের প্রতিটি ক্লাস রেকর্ডিংয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। তবে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কোনোভাবেই প্রতিটি ক্লাস রেকর্ডিংয়ের ব্যয় তিন থেকে চার হাজার টাকার বেশি হবে না। এর পরও এরই মধ্যে এক হাজার ক্লাস রেকর্ডিং হয়ে গেছে। আগামী অক্টোবর পর্যন্ত আরো দুই থেকে আড়াই হাজার ক্লাস রেকর্ডিং করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, প্রথমে ক্লাস রেকর্ডিং ও সম্প্রচার ব্যয় হিসাবে ১৬ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ব্যয় বিভাজন পাঠায় মাউশি অধিদপ্তর। সে সময় ২০ মিনিটের প্রতিটি ক্লাস সম্প্রচারে ৩৫ হাজার টাকা হিসাবে আট কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। আর তিন মাসের জন্য দুই হাজার ৫২০টি ক্লাস রেকর্ডিং ব্যয় হিসাবে দেখানো হয় সাত কোটি ৬৮ লাখ টাকা। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংসদ টেলিভিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেখানে বিনা মূল্যে ক্লাস সম্প্রচারের অনুমতি দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে শুধু ক্লাস রেকর্ডিংয়ের জন্য সাত কোটি ৬৮ লাখ টাকা বরাদ্দ চায় মাউশি অধিদপ্তর।
সূত্র জানায়, প্রতিটি ক্লাস রেকর্ডিংয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে তিনজন ক্যামেরাম্যানের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ছয় হাজার, স্টুডিও সেটআপ (লাইট, ব্যাটারি, ক্যামেরা, রেকর্ডার, টাইমার ইত্যাদি) ব্যয় ১২ হাজার, সহায়ক সার্ভিস দুইজনের জন্য এক হাজার, একজন শিক্ষকের জন্য সম্মানী তিন হাজার এবং সমন্বয় বা নির্দেশনার জন্য ধরা হয়েছে দুই হাজার টাকা। এভাবে দুই হাজার ৫২০টি ক্লাসের জন্য ব্যয় ধরা হয় ছয় কোটি চার লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর বাকি এক কোটি ৬৩ লাখ ২০ হাজার টাকা শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ নানা খাতে ব্যয় ধরা হয়।
তবে এই ব্যয়ের যথার্থতা খুঁজতে গিয়ে অনুসন্ধানে পুকুর চুরি বেরিয়ে আসে। সর্বোচ্চ চার হাজার টাকার রেকর্ডিং খরচ দেখানো হচ্ছে ২৪ হাজার টাকা করে। কারণ মাধ্যমিকের এই ক্লাস রেকর্ডিং প্রথম দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো (ব্যানবেইস) এবং বেসরকারি দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের স্টুডিওতে করা হয়। ব্যানবেইস যেহেতু নিজেদের সেখানে মাউশি অধিদপ্তরকে কোনো খরচই করতে হয়নি। আর বাকি দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও এক টাকা খরচ নেয়নি। এমনকি ক্লাস রেকর্ডিং সম্পূর্ণ করে দেওয়াসহ খাওয়া-দাওয়াও করিয়েছে প্রতিষ্ঠান দুটি। তবে ক্লাসের সংখ্যা বাড়তে থাকায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম), রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুল, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুলে ক্লাস রেকর্ডিং করা হয়।
এসব প্রতিষ্ঠানে স্টুডিও বলতে ক্লাসরুম ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে সাজসজ্জার পেছনে কোনো ব্যয় করা হয়নি। এখন পর্যন্ত যেসব শিক্ষকের ক্লাস রেকর্ডিং হয়েছে তাঁদের এক টাকাও দেওয়া হয়নি। সমন্বয় বা নির্দেশনা নিজেরাই করছেন। শুধু ক্যামেরা ও ক্যমেরাম্যান ভাড়া করে আনা হয়েছে। আর এক ক্যামেরা দিয়েই সারা দিনে অন্তত ১০ থেকে ১৫টি ক্লাস রেকর্ডিং করা হয়েছে। আর এসব ক্লাসে কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক নেই, ভিডিও খুব বেশি কাটারও প্রয়োজন হয় না। ফলে এডিটিংয়েও তেমন কোনো খরচ নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিনটি ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যান ভাড়া করে আনলে তারা কি শুধু একটি ২০ মিনিটের ক্লাস রেকর্ডিং করেই চলে যাবে? একটি ক্লাসের জন্য কী এমন নির্দেশনা দিতে হয় যাতে প্রত্যেক ক্লাসের জন্য একজনকে দুই হাজার টাকা করে দিতে হবে? একজন পিয়ন তার ডিউটি আওয়ারে যদি ২০টি ক্লাসের সার্ভিস প্রদান করে তাহলে তাকে কি দিনে ২০ হাজার টাকা সম্মানী দেওয়া হবে? এভাবে প্রতিটি রেকর্ডিংয়ে আলাদা ব্যয় দেখিয়ে মাউশি অধিদপ্তরের একটি সিন্ডিকেট পুকুর চুরি করার চেষ্টা করছে। এমনকি একাধিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ক্লাস প্রস্তুত করে দেওয়া পর্যন্ত সব কাজ বিনা মূল্যে করে দেওয়ারও প্রস্তাব দিয়েছিল। অনেক শিক্ষকই ক্লাস করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন। কিন্তু হরিলুট করার জন্য নিজেরাই গোপনে সব কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয় মাউশি অধিদপ্তর।
সিনেমায় কাজ করেন এমন একজন প্রফেশনাল হাউসের মালিক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমরা সারা দিনের জন্য একটি সনি আলফা ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যানসহ ভাড়া দিই পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। সারা দিনে দুটি ক্যামেরা দিয়ে অনায়াসেই ২০ মিনিটের ২০টি ক্লাস রেকর্ডিং করা যাবে। ক্লাস রেকর্ডিংয়ে এর চেয়ে কম দামের মার্ক-৪, মার্ক-৫ ক্যামেরা হলেই যথেষ্ট। আর এসব কাজে খুব বেশি এডিটিং লাগে না। তার পরও প্রতি ক্লাসের জন্য ৫০০ থেকে এক হাজার টাকা দিলেই যথেষ্ট। ফলে সব মিলিয়ে প্রতি ক্লাসে দেড় থেকে দুই হাজার টাকার বেশি খরচ হওয়ার কথা নয়।’
নাম প্রকাশ না করে রাজধানীর গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি স্কুল থেকে ক্লাসে অংশ নেওয়া একজন শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের ক্লাসের জন্য ডাকা হয়েছে। তবে কোনো টাকা-পয়সা দেওয়া হয়নি। আর এ ব্যাপারে আমাদের কিছু বলাও হয়নি। টিভিতে আমার ক্লাস প্রচার হলে আমারই সুনাম হবে। এ জন্য আমি টাকাও নিতে রাজি নই। এ ছাড়া সরকারি স্কুলের শিক্ষক হিসেবে এটা আমার কাজের অংশের মধ্যেই পড়ে।’
জানা যায়, ক্লাস রেকর্ডিংয়ের জন্য মাউশি অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী সমন্বয়ে ২৭ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রো-গ ১৫-০১০৭ এবং ঢাকা মেট্রো-ঘ ১১-৮৫৭৪ নম্বরের দুটি গাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি ক্লাসের জন্য ক্যামেরা ও ক্যামেরাম্যানের খরচই মূল খরচ। এ ছাড়া এডিটিংয়ের সামান্য খরচ রয়েছে। এ জন্য প্রতি ক্লাসের জন্য সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা খরচই যথেষ্ট। এ ছাড়া স্টুডিওতে লাইটিং করতে হয়, যা একবার করলেই যথেষ্ট। আর খাবার খরচসহ আনুষঙ্গিক কিছু ব্যয় রয়েছে। শিক্ষকদের কিছু সম্মানীও দেওয়া যায়। সব মিলিয়ে এই খরচ কোনোভাবেই চার হাজার টাকার বেশি হবে না।
ক্লাস রেকর্ডিংয়ের কমিটিতে থাকা ২৭ জনের মধ্যে পক্ষ থেকে সাতজনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। একমাত্র মহাপরিচালক ছাড়া আর কেউ ব্যয়ের ব্যাপারে জানেন না বলে জানিয়েছেন।
সূত্র জানায়, কমিটির চারজন ছাড়া বাকিদের কাউকেই ব্যয়ের ব্যাপারে কোনো তথ্য জানানো হয়নি। এমনকি সাত-আটজন ছাড়া অন্যদের তেমন কোনো কাজকর্মেও ডাকা হয় না। রেকর্ডিংয়ের ব্যাপারে মূল দায়িত্ব পালন করছেন মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক, পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী এবং পরিচালক (প্রশিক্ষণ) অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য। এ ছাড়া অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারটি জানেন পরিচালক (অর্থ ও ক্রয়) অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম খানসহ আরো দু-একজন কর্মকর্তা। আর তাঁরা নিজেদের পছন্দমতো লোকের মাধ্যমে রেকর্ডিংয়ের কাজ করাচ্ছেন।
পরিচালক (প্রশিক্ষণ) অধ্যাপক ড. প্রবীর কুমার ভট্টাচার্য বলেন, ‘আমি ব্যয়ের ব্যাপারে জানি না। তবে শিক্ষকদের ডাকা, কোথায় রেকর্ডিং হবে এসব বিষয় নিয়েই কাজ করছি। এরই মধ্যে এক হাজারের ওপরে ক্লাস রেকর্ডিং হয়েছে। চার শতাধিক ক্লাস প্রচার হয়েছে।’ এরপর পরিচালক (অর্থ ও ক্রয়) অধ্যাপক মো. সিরাজুল ইসলাম খানের কাছে ব্যয়ের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. সৈয়দ গোলাম ফারুক বলেন, ‘ক্লাস রেকর্ডিংয়ের বাজেটের টাকা এখনো পাস করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আমরা যে বাজেট দিয়েছি, সেটা বিচার বিশ্লেষণ করে মন্ত্রণালয় তা অনুমোদন করবে। তবে প্রশিক্ষণসহ কিছু কাজের জন্য টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। যা ফেরত যাবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন ও অর্থ) ড. অরুনা বিশ্বাস বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবটা যেহেতু হঠাৎ করে এসেছে, তাই আগে থেকে ক্লাস রেকর্ডিংয়ের খাতে আমাদের কোনো বরাদ্দ ছিল না। তবে সংশ্লিষ্ট খাত থেকে এই টাকার জোগান দেওয়া হচ্ছে।’ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাধ্যমিক) মোমিনুর রশীদ আমিন বলেন, ‘ক্লাস প্রচারসংক্রান্ত তথ্য আমার কাছে আছে। তবে আমি রেকর্ডিং ব্যয়ের ব্যাপারে কিছুই জানি না।’
(সূত্র: কালেরকণ্ঠ)
Discussion about this post