‘পার্থ শঙ্কর সাহা ও অর্ণব সান্যাল
মহীনের ঘোড়াগুলি’র একটি বিখ্যাত গান আছে। সেটি হলো, ‘আমি ডানদিকে রই না, আমি বামদিকে রই না, আমি দুই দিকেতেই রই, পরান জলাঞ্জলি দিয়া রে…’। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও তাদের কারণে মানুষের বিভ্রান্ত হওয়ার অবস্থা বোঝাতে এই গান একেবারে নিখুঁত উদাহরণ! কারণ সংস্থাটি আজ এক কথা বলছে তো, কাল সেটিই বাতিল করে দিচ্ছে। এ নিয়ে তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তি ও সিদ্ধান্তহীনতা। আর কে না জানে, মহামারির কালে এসবের প্রভাব ভয়ংকর।
এমন ঘটনার সাম্প্রতিকতম উদাহরণটি তৈরি হয়েছে উপসর্গহীন করোনা রোগীদের বিষয়ে। গত সোমবার সংস্থাটির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা মারিয়া ভ্যান কেরখোভে এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছিলেন, ‘উপসর্গহীন রোগীদের মাধ্যমে করোনা ছড়ানোর ঘটনা বেশ কম।’ এমনকি উপসর্গহীন রোগীদের বিষয়ে গুরুত্ব কম দিয়ে অন্যান্য ক্ষেত্রে মনোযোগ বাড়ানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঠিক এক দিনের মাথায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাটির আরেক শীর্ষ কর্তা জানালেন, এ বিষয়ে জানাশোনা এখনো বড্ড কম। তাই এ নিয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত দেওয়ার সময় এখনো আসেনি। এখন মারিয়া ভ্যান কেরখোভে বলছেন, ‘এটা একটা “ভুল-বোঝাবুঝি” ছিল। আমি ডব্লিউএইচওর কোনো নীতি বা এ জাতীয় কিছু নিয়ে কথা বলতে চাইনি। আমরা জানি যে উপসর্গহীন কিছু লোক অর্থাৎ যেসব লোকের কোনো উপসর্গ নেই, তাঁরাও করোনা ছড়াতে পারেন।’
অথচ এর আগেই ‘নেচার’ সাময়িকীতে ছাপা হওয়া একটি গবেষণাপত্রে করোনা ছড়ানোর ক্ষেত্রে উপসর্গহীন রোগীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। সেই গবেষণা আবার বিশ্বব্যাপী বেশ সমাদৃতও হয়েছিল। ওই গবেষণায় বলা হয়েছিল, উপসর্গ দৃশ্যমান হওয়ার দুদিন আগ থেকেই করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তিরা রোগটি ছড়াতে থাকেন এবং সেই সময়েই রোগ ছড়ানোর হার বেশি থাকে। এই গবেষণায় আরও বলা হয়েছিল, বর্তমানের নতুন আক্রান্ত লোকজনের ক্ষেত্রে ৪৪ শতাংশের বেশি সংক্রমণ হয়েছে উপসর্গহীন ব্যক্তিদের মাধ্যমে।
অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন তা খারিজ করে দিচ্ছে। এ ঘটনায় এরই মধ্যে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। রোগতত্ত্ব ও চিকিৎসাবিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এভাবে বারংবার এক ধরনের বক্তব্য দিয়ে, কিছুদিনের মধ্যে তার উল্টোটা বললে বড় ধরনের বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। মনে রাখতে হবে, এই মহামারির কালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একেবারে শীর্ষ অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি তদারকি করছে। তাদের কাছ থেকে এমন কথা মানুষের মধ্যে দ্বিধার সৃষ্টি করে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষেত্রে। কারণ এসব দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো বেশ দুর্বল। আর এসব দেশ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো প্রতিষ্ঠানের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
শুধু সাম্প্রতিক উদাহরণটিই একমাত্র নয়। খুঁজলে এমন উদাহরণ আরও পাওয়া যাবে। যেমন ‘নভেল করোনাভাইরাস মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না’, ‘করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে রোগপ্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হয় না’ প্রভৃতি। এসব বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাই বলেছে, প্রচারও করেছে। এবং একসময় সেই অবস্থান থেকে সরেও এসেছে। কিন্তু মধ্যবর্তী সময়ে অনেক দেশই তাৎক্ষণিকভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী জাতীয় নীতি তৈরি করেছে। ফলে নিন্দুকেরা এখন বলছেন, নতুন করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পেছনে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তৈরি বিভ্রান্তিরও অবদান আছে।
করোনা-আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের জন্ম দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের গবেষণার ভিত্তিতে সংস্থাটি ঘোষণা দেয়, ম্যালেরিয়ার ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন করোনার চিকিৎসায় কোনো কাজে আসে না। বরং এর তীব্র পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। কিছুদিন পরে সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে ওই অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে গিয়ে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ঘোষণা দেয়।
বিল ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় দূত হিসেবে কর্মরত ছিলেন ডেনিয়েল স্পিগেল। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’কে তিনি বলেছেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বোঝা উচিত, এভাবে কোনো বক্তব্য ঘোষণার ফলাফল মহামারির সময় কেমন হতে পারে। সঠিক ও পর্যাপ্ত তথ্য হাতে না থাকলে কখনোই এ ধরনের সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য প্রচার করা উচিত না। বাইরের বিশেষজ্ঞ ও সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার পরই এমন বক্তব্য দেওয়া উচিত। হুটহাট ঘোষণা দিয়ে আবার কথা ফিরিয়ে নিলে তাতে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
গত এপ্রিলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, করোনাভাইরাসে একবার সংক্রমিত হওয়ার পর তা যে দ্বিতীয়বার সংক্রমণ ঠেকাতে পারে, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পরে এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যা জানায় তা হলো, এখনো এর সপক্ষে ব্যাপক গবেষণালব্ধ উপাত্ত নেই। কিন্তু চিকিৎসাসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো, ভাইরাস যেভাবে কাজ করে, সেই প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই বলা যায় যে কোভিড-১৯ রোগে একবার আক্রান্ত হলে তাতে আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী ক্ষমতা তৈরি করার কথা। বৈজ্ঞানিক যুক্তি সে কথাই বলে। পরে সুর পাল্টে এপ্রিলের ২৫ তারিখ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলে, তারা আশা করে, কোভিড-১৯ রোগে প্রথম আক্রান্তদের দেহে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হবে, যা কিনা করোনা প্রতিরোধে কিছু হলেও সক্ষমতা তৈরি করবে।
ওই মাসেরই শুরুর দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, করোনা ঠেকাতে মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই। কিন্তু গত শুক্রবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে সংস্থাটি আবার বলেছে, করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে অবশ্যই মাস্ক পরে বাইরে চলাচল করতে হবে। নতুন তথ্যের বরাত দিয়ে সংস্থাটি বলে, ফেস মাস্ক ‘সম্ভাব্য সংক্রামক ড্রপলেটের’ জন্য বাধা হিসেবে কাজ করতে পারে। অথচ এর অনেক আগে থেকেই করোনার বিস্তার রোধে মাস্ক ব্যবহারের সুফল নিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা লাগাতার বক্তব্য দিয়েছেন। মার্কিন প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল বহু আগেই জানিয়েছিল, জনসমক্ষে মুখে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম পলিটিকোর এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, এর আগে গত জানুয়ারি মাসে চীনের করোনা পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জনস্বাস্থ্যগত জরুরি অবস্থা জারি করতে চায়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অথচ তত দিনে তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড ও দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়ে গিয়েছিল। পরে গত মার্চ মাসে প্রথমে জরুরি অবস্থা ও পরে বিশ্বব্যাপী মহামারি পরিস্থিতি ঘোষণা করতে বাধ্য হয় ডব্লিউএইচও। এ ছাড়া গত ফেব্রুয়ারির শুরুতেও আন্তর্জাতিক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা বা কড়াকড়ি আরোপ করতে চায়নি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ‘পলিটিকো’র নিবন্ধে বলা হয়েছে, এসবের মধ্য দিয়ে মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। দেরি করায় পুরো বিশ্বে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস।
তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবচেয়ে সমালোচিত বক্তব্য হলো, মানুষ থেকে মানুষে করোনা সংক্রমণবিষয়ক ঘোষণা। গত ১৪ জানুয়ারি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা টুইট করে বলে যে, করোনাভাইরাসের মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণের কোনো স্পষ্ট প্রমাণ পায়নি চীন। পরে অবশ্য এ অবস্থান থেকে ফিরে আসে সংস্থাটি। কিছুদিনের মধ্যেই বলা হয় যে, করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে সীমিত আকারে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ দেখা গেছে। তবে ওই সময়ও কোভিড-১৯ রোগকে ফুসফুসের সাধারণ সংক্রমণ হিসেবেই সংস্থাটি দেখছিল। সমালোচকেরা বলছেন, এভাবে বারবার কথা পাল্টেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং এর ফলে সংস্থাটি করোনা নিয়ন্ত্রণের সংগ্রামে যথাযথ নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।
সমালোচনা যে শুধু বাইরে হচ্ছে তা নয়। সংস্থাটির ভেতরের কর্মীরাও এখন সরব হচ্ছেন। ডব্লিউএইচও কোলাবরেটিং সেন্টার অন ন্যাশনাল অ্যান্ড গ্লোবাল হেলথ ল-এর পরিচালক লরেন্স গসটিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’কে বলেছেন, বিশ্বমঞ্চে বিজ্ঞানের নেতৃত্বের পর্যায়ে থাকা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রথম ও প্রধানতম দায়িত্ব। কিন্তু সংস্থাটি যখন এমন সব পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে থাকে, যেগুলো কিনা বিজ্ঞানের চিরন্তন সিদ্ধান্তসমূহের বিপরীতে চলে যায় এবং এসব বক্তব্য দেওয়ার সময় যদি প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা বা কোনো গবেষণাপত্রের বরাত না দেওয়া হয়, তখন পুরো সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়।
এতসব সমালোচনার বিপরীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবারই বলছে গবেষণা ও গবেষণালব্ধ তথ্যের সংকটের কথা। বলা হচ্ছে, যতটুকু তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তার ভিত্তিতেই বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ (জিডিজি) রোগসংক্রান্ত নানা বিষয়ে নির্দেশিকা বা গাইড তৈরি করে। বাংলাদেশ সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন জিডিজির সদস্য। তিনি বলেন, এই ভাইরাসটি নতুন। তাই এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত পাল্টাতেই পারে। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কোনো ব্যক্তির প্রতিষ্ঠান না। এখানে সারা বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা জড়িত। তাঁরা কোনো কিছু প্রমাণের ভিত্তিতেই কথা বলেন। এখানে একটি প্রক্রিয়া থাকে। উদাহরণ হিসেবে মুশতাক হোসেন মাস্কের বিষয়ে বলেন, নন-মেডিকেল মাস্কে যে সংক্রমণ কমে যায় এটা প্রমাণ পাওয়া গেছে। পরে এই প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে এবং মতামত নিয়ে মাস্ক নিয়ে সংস্থা তাদের মত দিয়েছে। একটি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা হতেই পারে।
মানুষ থেকে মানুষে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি নিয়ে মুশতাক হোসেন বলেন, চীনের রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ কথা বলেছিল। পরে চীনা কর্তৃপক্ষ জানায়, এটি সংক্রমিত করে। পরে সংস্থাও সেই তথ্য জানায়।
তবে মুশতাক হোসেন মনে করেন, উপসর্গহীন ব্যক্তির মাধ্যমে করোনা কম ছড়ায় বলে যে মন্তব্য কেরখোভে করেছেন, তা উচিত হয়নি। তাঁর কথা, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পোডিয়ামে থেকে এ ধরনের কথা বলাটা ঠিক হয়নি। এর যে মারাত্মক প্রভাব আছে সেটা ভাবা উচিত ছিল।’ সৌজন্যে- প্রথম আলো
Discussion about this post