কাজী সালমা সুলতানা
‘…একজন বিপ্লবীকে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে সংঘটিত যে কোনো অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সব সময় দৃঢ়ভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে’। কথাগুলো বলেছেন সাম্যবাদী দর্শনে বিশ্বাসী চে গুয়েভারা। পুরো নাম এরনেস্তো গেভারা দে লা সেরনা (Ernesto uevara de la Serna)। বিশ্ববাসীর কাছে তিনি চে গুয়েভারা বা ‘চে’ নামে পরিচিত। চে’র জন্ম ১৯২৮ সালের ১৪ জুন। আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন একজন মার্কসবাদী বিপ্লবী। এর বাইরেও তিনি ছিলেন চিকিৎসক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিক, সামরিক তত্ত্ববিদ ও কিউবা বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব। একজন চিকিৎসক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা। তিনি বিশ্বাস করতেন, সাম্যবাদী দর্শনে বিশ্বাসী একজন মানুষের দেশ থাকে না। বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে, যে কোনো সরকারের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো একজন বিপ্লবীর নৈতিক দায়িত্ব।
একজন বিপ্লবীকে শোষণ, নিপীড়ন, নির্যাতন ও সামাজিক বৈষম্য ঘুচিয়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মানুষের মুক্তির জন্য লড়াই করতে হবে। একজন সাম্যবাদীকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হবে, দেশে দেশে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ভূমিকা রাখতে হবে। জন্ম ভূমির গণ্ডি পেরিয়ে সব দেশে থেকে শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে সাম্যবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এ বিশ্বাস বুকে ধারণ করেই বেড়ে উঠেছিলেন চে গুয়েভারা। তাইতো আর্জেন্টিনার নাগরিক হয়েও তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক কিউবার একনায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাতের লড়াইয়ে। এ লড়াইয়ে বিজয়ের মাধ্যমে বিশ্বের সব সাম্যবাদীর কাছে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন চে।
তরুণ বয়সে চিকিৎসাবিজ্ঞানে অধ্যয়নকালে চে সমগ্র লাতিন আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এ ভ্রমণের মাধ্যমে তিনি ল্যাটিন আমেরিকাজুড়ে অসহায় মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুধাবনের সুযোগ পান। তিনি বুঝতে সক্ষম হন যে, মানুষের অভাব-অনটন সবই সৃষ্টি হয়েছে অন্যের শ্রম শোষণ করে কিছু মানুষের বিত্তশালী হওয়ার অশুভ প্রতিযোগিতার কারণে। তিনি বুঝতে পারেন, ধনী-গরিবের এ ব্যবধানের অবসান ঘটাতে একমাত্র পথ সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এ বিপ্লবের পথে নিজকে দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করেন মার্কসবাদ নিয়ে পড়ালেখা। তার মধ্যে এ বিশ্বাস দৃঢ় হয় যে, এ অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবসান ঘটাতে হলে একমাত্র পথ সমাজতান্ত্রিক বিশ্ববিপ্লব। এ বিশ্বাসেই চে রাষ্ট্রপতি জাকোবো আরবেনজ গুজম্যানের নেতৃত্বাধীন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন।
১৯৫৪ সালে সিআইএ’র ষড়যন্ত্রে গুজমান ক্ষমতাচ্যুত হলে চে’র বৈপ্লবিক আদর্শিক চেতনা আরও শাণিত হয়। পরবর্তীকালে মেক্সিকো সিটিতে বসবাসের সময় কিউবার বিপ্লবী রাউল ক্যাস্ত্রো ও ফিদেল ক্যাস্ত্রোর সঙ্গে চে’র আলাপ হয়। এ আলাপের সূত্রেই চে ফিদেল ক্যাস্ত্রোর ২৬ জুলাই আন্দোলনে যোগ দেন। মার্কিন মদতপুষ্ট কিউবান একনায়ক ফুলগেনসিও বাতিস্তাকে উৎখাতের জন্য গ্রানমায় চড়ে সমুদ্রপথে কিউবায় প্রবেশ করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই চে বিপ্লবী সংঘের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। বিপ্লবের জন্য লড়াইকালে তিনি সেকেন্ড-ইন-কমান্ড পদে পদোন্নতি পান। বাতিস্তা সরকারকে উৎখাতের লক্ষ্যে দুবছর ধরে চলা গেরিলা সংগ্রামের সাফল্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন চে গুয়েভারা।
গেরিলা যুদ্ধ চলাকালেই তিনি ফিদেল ক্যাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি ও অধ্যবসায়ের কথা জানান। তিনি গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি বানানোর চুল্লি প্রস্তুত করেন। এ সময় তিনি নিরক্ষরদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালাও পরিচালনা করেন। এছাড়াও একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য কর্মশালা আয়োজন ও তথ্য আদান-প্রদানের জন্য পত্রিকা চালাতেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাকে ‘ক্যাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। বিপ্লবের প্রতি তার একাগ্রতা, অদম্য সাহস ও সাংগঠনিক ক্ষমতার কারণে তিনি বিদ্রোহী বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে পদোন্নতি পান। তিনি বিশ্বাস করতেন, দলের যে কারও শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে পুরো দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। তাই শৃঙ্খলার প্রতি অবহেলাকারীকে তিনি নির্দ্বিধায় গুলি করতেন। এই কঠোর মানসিকতা তাকে ইউনিটে সবার চেয়ে ভয়ঙ্কর করে তুলেছিল। গেরিলা অভিযানের সময় গুপ্তঘাতকদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দায়িত্ব চে’র ওপর ন্যস্ত ছিল। এমন কঠিন প্রশাসক হওয়া সত্ত্বেও সৈনিকদের শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত প্রিয়। কাজের অবসরে তিনি সবার জন্য বিনোদনের ব্যবস্থাও করতেন।
বিশ্ববিপ্লবে বিশ্বাসী চে গুয়েভারা কিউবায় সফল বিপ্লবের পর নতুন সরকারে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত তিনি কিউবার শিল্পবিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন। এ সময় তিনি কিউবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় কিউবান নোটগুলোয় তার স্বাক্ষরে শুধু ‘চে’ লেখা থাকত। তিনি বিপ্লবী আদালতে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে অভিযুক্তদের আপিল পুনর্বিবেচনা ও ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড প্রদান, শিল্পোদ্যোগমন্ত্রী হিসেবে খামার সংস্কার আইন প্রবর্তন ও সামরিক বাহিনীর ইনস্ট্রাকশনাল ডিরেক্টর, কিউবান সমাজতন্ত্রের প্রচারে বিশ্ব পর্যটন প্রভৃতি দায়িত্ব পালন করেন কিউবার বিপ্লবী সরকারে। তিনি মিলিশিয়া বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ারও সুযোগ পান। তার প্রশিক্ষণেই এ বাহিনী পিগস উপসাগর আক্রমণ করে তা পুনর্দখল করতে সক্ষম হয়। কিউবায় সোভিয়েত পরমাণু ব্যালাস্টিক মিসাইল আনার ক্ষেত্রেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
চে ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বরে বিশ্ববিপ্লবীদের কূটনীতিক হিসেবে পরিচিতি পান। তাই তিনি কিউবার প্রতিনিধি হয়েও জাতিসংঘ অধিবেশনে যোগ দেন। ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ১৯তম অধিবেশনে তিনি আবেগাপ্লুত বক্তৃতায় দক্ষিণ আফ্রিকার জাতিগত বৈষম্যের কঠোর নীতি দমনে জাতিসংঘের দুর্বলতার কথা বলেন। এ সময় চে নিগ্রো জনগণের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কঠোর সমালোচনা ও নিন্দা জানান। চে গুয়েভারা ‘সেকেন্ড ডিক্লারেশন অব হাভানা’ নামে একটি আবেগপূর্ণ ঘোষণা দিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন। তিনি বলেন, এ ঘোষণার জন্ম হয়েছে ক্ষুধার্ত জনগণ, ভূমিহীন কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক ও প্রগতিশীল মানুষ দ্বারা। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের শোষিত জনগোষ্ঠীর একমাত্র চিৎকার এখন হয় স্বদেশ, অথবা মৃত্যু।
চে গুয়েভারা যে বিশ্বাস আর দর্শনে বেড়ে উঠেছেন, তিনি তো শুধু কিউবায় বিপ্লব সংঘটিত করে বসে থাকতে পারেন না। তখনও বিশ্বের দেশে দেশে পুঁজিবাদী শোষণ ও নিপীড়ন চলছিল; মুক্তির জন্য মানুষ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি ১৯৬৫ সালে কিউবা ত্যাগ করে বলিভিয়ায় যান। এখানেই বলিভিয়ান সেনার হাতে বন্দি ও নিহত হন চে গুয়েভারা।
বলিভিয়া সেনাবাহিনীর ভাষ্যমতে, তারা গুয়েভারাকে ৭ অক্টোবর গ্রেফতার করে এবং তার মৃত্যু হয় ৯ অক্টোবর ১৯৬৭ সাল বেলা ১.১০টায়। ধারণা করা হয়, ১৯৬৭ সালের এ দিনটিতে লা হিগুয়েরা নামক স্থানে নিরস্ত্র অবস্থায় গুলি করে হত্যা করা হয় চে গুয়েভারাকে। আরেক মতামত হচ্ছে, যুদ্ধে বন্দি হলেও তাকে এবং তার সহযোদ্ধাদের হত্যা করা হয় কিছুদিন পর। কিন্তু মৃত্যু তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। এ সময়েও চে গুয়েভারা বলেন, ‘আমি জানি তুমি আমাকে হত্যা করতে এসেছো, গুলি করো কাপুরুষ, তুমি শুধু একজন মানুষকেই হত্যা করবে, তার বিপ্লবী চেতনাকে নয়’।
চে গুয়েভারা অসংখ্য ডায়েরি লিখেছেন। সেসব পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। তিনি ৭০টির মতো নিবন্ধ লিখেছেন। চে মূলত কবিতা দিয়ে লেখালেখি শুরু করেন। এছাড়াও প্রচুর চিঠি লিখেছেন। তার লেখা ডায়েরি ১৯৬৩ সালে বই আকারে প্রকাশিত হয়। এটি স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশ পায়। বইটি নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার ছিল। এছাড়া তার বেশ কয়েকটি বই প্রকাশিত হয়।
চে গুয়েভারাকে হত্যার সংবাদ বিশ্বব্যাপী প্রচার হওয়ার পর খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই হাজার হাজার পোস্টার, স্টিকার, টি-শার্টসহ বিভিন্ন পোশাকে বিপ্লবী চে’র ছবিতে ভরে যায়। মার্কিন প্রশাসন বুঝতে পারে যে, জীবিত চে’র চেয়ে মৃত চে আরও শক্তিশালী। এভাবেই বিশ্ববিপ্লবী ‘চে’ যুগে যুগে বেঁচে আছেন মানুষের মাঝে। যুগে যুগে বিপ্লবীদের প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন।
Discussion about this post