বিশেষ প্রতিবেদক
গত প্রায় এক দশকে সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট অনেকাংশেই কমে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা এই শব্দটি ভুলতে বসেছিলেন। কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দীর্ঘ ছুটির জের ধরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছয় মাস থেকে প্রায় এক বছর পর্যন্ত সেশনজট পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ কথা বলছেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যগণ! প্রথমে তাঁরা ভেবেছিলেন, এক-দুই মাস বন্ধ থাকলে পরে হয়তো সাপ্তাহিক ছুটি কমিয়ে ও অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দিতে পারবেন। কিন্তু এখন এসব করেও সেশনজট ঠেকানো সম্ভব হবেনা।
গত ১৭ মার্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটি শুরু হয়েছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ছয় মাস এসব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে। তবে করোনার সংক্রমণ বিবেচনায় এই ছুটি বাড়তে বা কমতেও পারে।
এ পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নতুন ভর্তি, ক্লাস নেওয়া, পাঠ্যক্রম শেষ করা, পরীক্ষা গ্রহণ ও ফল প্রকাশে সামগ্রিক জটের মধ্যে পড়ে গেছে।
উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পৌনে ৫ মাসের ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ মাস থেকে এক বছরের সেশনজট তৈরি হতে পারে। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাস নিতে পারেনি। ছয় মাসের সেমিস্টার হওয়ায় পাঠ্যক্রম শেষ করা তো দূরের কথা, অর্ধেকও এগোয়নি। ৬ আগস্টের পর যদি আর ছুটি নাও বাড়ে তবু ৯ মাস থেকে ১ বছরের সেশনজট হবে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে বিদ্যমান সেমিস্টার।
দেশে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় চারটি—ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৪২টি। এর মধ্যে আছে চারটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
নানা প্রতিবন্ধকতায় অনলাইন পাঠদান
আশার আলো হতে পারতো অনলাইন পাঠদান চালু করা।ইউজিসিও চাচ্ছিল, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে ক্লাস শুরু হোক। কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত চারটিসহ সাতটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের প্রায় সবাই বলছেন, অসম্ভব না হলেও কাজটি বেশ কঠিন। তাঁদের মতে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থান করা শিক্ষার্থীদের সমস্যা, ইন্টারনেট সংযোগ না থাকা বা ইন্টারনেটের ধীরগতি, ডিজিটাল ডিভাইসের অভাবসহ নানা কারণে অনলাইন ক্লাস সেভাবে চালু হয়নি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেও অনীহা ভাব রয়েছে। বিশেষ করে স্বায়ত্তশাসিত ও ঐতিহ্যবাহী ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ব
ড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এ ক্ষেত্রে সক্ষমতা প্রদর্শনের সুযোগ থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি।তবে এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের অনিচ্ছাও প্রধান প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করছে।
ইউজিসি গত মে মাসে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনলাইন শিক্ষার ভূমিকা ও কার্যকারিতার বিষয়ে একটি জরিপ চালায়। এতে অংশ নেন প্রায় ১৯ হাজার শিক্ষার্থী এবং ৭ হাজারের বেশি শিক্ষক। ওই জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের প্রায় ৮৭ শতাংশের স্মার্টফোন আছে। কিন্তু ক্লাস নেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্টারনেট খরচ, দুর্বল নেটওয়ার্কসহ বেশ কয়েকটি সমস্যার কথা বলেছেন শিক্ষার্থীরা।
বায়োটেড নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গত ৯ থেকে ১১ মে একটি সমীক্ষা চালায়, যার মাধ্যমে বেরিয়ে আসে শিক্ষার্থীদের মাত্র ২৩ শতাংশ অনলাইনে ক্লাস করতে চান, বাকি ৭৭ শতাংশ আগ্রহী নন। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ২ হাজার ৩৮ জন শিক্ষার্থী এতে অংশ নেন। সমীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৫৫ শতাংশের ক্লাস করার উপযোগী ডিভাইস, অর্থাৎ ল্যাপটপ বা কম্পিউটার রয়েছে, বাকিদের নেই।
সমীক্ষা অনুযায়ী, ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থীর ক্লাস করার উপযোগী ইন্টারনেট সংযোগ নেই। আর ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী মনে করেন, অনলাইনে ক্লাসরুম সত্যিকার ক্লাসরুমের মতো কার্যকর নয়।
বিভাগভিত্তিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এ নিয়ে আপত্তি আছে। যেমন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান নাসরীন সুলতানা জানান, তাঁরা অনলাইনের ক্লাসের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়েছিলেন। তাতে দেখা যায়, স্নাতক পর্যায়ে ৫০ শতাংশের কম শিক্ষার্থীর এই সুযোগ আছে। আর স্নাতকোত্তরে মাত্র ২০ শতাংশের মতো এই সুযোগ আছে। এমন বাস্তবতায় শিক্ষকেরা মনে করেন, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ধনী-গরিব শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন। তাঁদের অনেকেরই ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহারের সুযোগ ও সামর্থ্য নেই।সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত না করে অনলাইনে ক্লাস কার্যকর হবে না।
বেশ ক’জন শিক্ষক জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মানবিক ও বাণিজ্যের বেশ কিছু বিষয়ে, বিশেষ করে তত্ত্বীয় বিষয়ে অনলাইনে পড়ানো তুলনামূলক সহজ। কিন্তু ব্যবহারিকনির্ভর বিজ্ঞানের বিষয়গুলো অনলাইনে পড়ানো প্রায় অসম্ভব।
তবে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঈদের আগেই অনলাইন ক্লাস শুরু হয়েছে। যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন, তাঁদের বর্তমান সেমিস্টারের বেশির ভাগ ক্লাস শেষ হয়েছে। তারপরও সিদ্ধান্ত হয়েছে বাকি ক্লাসের বিষয়গুলো ওয়েবসাইটে দেওয়া হবে, সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা নেবেন।
এ ছাড়া শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্নভাবে অনলাইন ক্লাস নিচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, সীমিত সামর্থ্য অনুযায়ী অনলাইনে ক্লাস নেওয়া হবে। এর উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের এই সময়ে সক্রিয় রাখা এবং খোলার পরপর যাতে কমসংখ্যক ক্লাস নিয়েই পরীক্ষা শুরু করা যায়। তবে একটি বিষয় পরিষ্কার থাকা ভালো, অনলাইনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে ডিগ্রি দেওয়া সম্ভব নয়।
সেমিস্টার নিয়ে সংকট
বেশ কিছুসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেমিস্টার পদ্ধতি থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিস্থিতি তুলনামূলক জটিল। সেমিস্টার পদ্ধতিতে ছয় মাসে একটি সেমিস্টার। আটটি সেমিস্টারে চার বছরের স্নাতক এবং দুই সেমিস্টারে এক বছরের স্নাতকোত্তর শেষ করতে হয়। আর বর্ষ পদ্ধতিতে এক বছরের মধ্যে একটি বর্ষ শেষ করতে হয়।
ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী—এই চার বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮৩টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু আছে। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধশত বিভাগে এটি চালু আছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিজ্ঞতা হচ্ছে, দ্রুততম সময়ের মধ্যে ফল প্রকাশে তারা পিছিয়ে পড়ছে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আট সপ্তাহ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০ সপ্তাহের মধ্যে ফল প্রকাশ করার কথা। বাস্তবে ১৮ থেকে ২০ সপ্তাহ সময় লাগছে। ফলে এক সেমিস্টারের ফল প্রকাশ হওয়ার আগেই আরেক সেমিস্টারের ক্লাস শুরু হচ্ছে। করোনার ধাক্কায় এই সমস্যা আরও বেড়েছে।
অবশ্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে সনাতন পদ্ধতিতে বর্ষভিত্তিক স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর পড়াশোনা হয়।
পরিপূর্ণ ক্লাস নেয়াই যেখানে সম্ভব হচ্ছেনা সেখানে পরীক্ষা নেয়াতো আরো দূর! তাই নিশ্চিত সেশন জটে পড়তে যাচ্ছে আটলাখ ছাত্রছাত্রী।
সেশনজট নিরসনে ইউজিসির ভাবনা
সেশনজট নিরসনে ইউজিসি নানা কৌশল চিন্তা করছে বলে জানা গেছে।
তন্মধ্যে একটি হলো- পড়ানো সিলেবাস থেকে চলতি সেমিস্টারের পরীক্ষা ব্যাচ ধরে নিয়ে পরের সেমিস্টারে শিক্ষার্থীদের উত্তীর্ণ করা। এক্ষেত্রে পরীক্ষা চলাকালীন শুধু একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে আনা হবে। বাড়ি থেকে তাদের নিয়ে আসা হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে। এরপর একইভাবে অন্য আরেকটি ব্যাচের পরীক্ষা নেয়া হবে।
করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি এডিয়ে কীভাবে এই কৌশল বাস্তবায়ন করা যাবে- এ বিষয়ে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম গণমাধ্যমকে বলেন, চলতি সেমিস্টারের শিক্ষার্থীদের ব্যাচভিত্তিক পরীক্ষা নেয়া যায়। যেমন- প্রথম বর্ষের সব শিক্ষার্থীকে এনে পরীক্ষা নেয়া হবে। এক কক্ষে সর্বোচ্চ দু’জন থাকবে। তাদের বিদায় দিয়ে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীদের ডাকা হবে। একই প্রক্রিয়ায় তারা পরীক্ষা দেবে। এভাবে আলাদাভাবে মাস্টার্স পর্যন্ত পরীক্ষা নেয়া যায়। শিক্ষার্থীদের বাড়ি থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসেই আনা-নেয়া করা হবে।
এ ব্যাপারে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, সেশনজটের অভিজ্ঞতা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। কী করে মোকাবেলা করতে হবে তা সংশ্লিষ্টরা ভালো জানেন। আমাদের সঙ্গে শুধু অবহিত আর সম্মতির সম্পর্ক। সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করবেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল, ডিনস কমিটি ও সিন্ডিকেট। আমাদের চিন্তা ভিসিদের বলব। আগামী ২৫ জুন তাদের সঙ্গে কথা হবে।
Discussion about this post