অনলাইন ডেস্ক
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস থেকে কেউ রেহায় পাচ্ছেন না কেউ। চিকিৎসক থেকে শুরু করে মন্ত্রী-এমপি সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন। সম্প্রতি করোনায় পাকিস্তানের লাহোরে ২১ বছর বয়সী মেডিকেল শিক্ষার্থী সালমান তাহিরের মৃত্যু হয়েছে। তিনি লাহোরের একটি প্রাইভেট মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। সালমানের মৃত্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক হৃদয়বিদারক স্ট্যাটাস দিয়েছেন তাঁর ডাক্তার মা শবনম তাহির। সালমানের বাবা প্রফেসর সালেম তাহিরও করোনা আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশনে আছেন।
পাকিস্তানের লাহোর হাসপাতালের গাইনোকোলজির অধ্যপক ডা. শবনম তাহির ফেসবুক পোস্টে লেখেন, গতকাল আমাদের ডাক্তারি পড়ুয়া মাত্র ২১ বছরের প্রিয়তম সন্তানকে হারিয়েছি। এর চেয়ে বেদনার দিন কোনো মায়ের এই পৃথিবীতে নেই। প্রচণ্ড শোকের মাঝে অন্য সব মায়েদের এই বার্তা দেয়ার একমাত্র কারণ হলো- আর কোনো মাকে যেন এইভাবে তার সন্তানকে হারাতে না হয়। আমি শুধু মা না। আমি একজন ডাক্তার। আমার স্বামীও ডাক্তার। মাত্র ২১ বছরে আমাদের শোকের মাঝে রেখে চিরতরে চলে যাওয়া আমার ছেলেও মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী।
তিনি জানান, ছেলের শারীরিক কোনো সমস্যা ছিলো না। একজন স্বাস্থ্যবান তরতাজা যুবক ছিল। প্রচণ্ড মানসিক, শারীরিক শক্তি ছিল। বন্ধুবৎসল ছিল। সবসময় প্রাণোচ্ছল ছিল। পাশাপাশি সে তুখোড় মেধাবী একজন ছাত্র ছিল। মা-বাবার মতো ডাক্তার হওয়ার স্বপ্নে তার অধ্যয়নে কোনো ঘাটতি ছিল না। কিন্তু মাত্র ৭২ ঘণ্টার মাঝে আমাদের জীবনের সবকিছু উলট-পালট হয়ে গেল।
তিনি আরও জানান, লকডাউনে সে কোথাও যায়নি। মাত্র দুবার পাঁচ মিনিটের জন্য নিজের গাড়িতে করে বাইরে যায়। আর ঘরে ফেরার সাথে-সাথে নিজের শরীরকে ভালো করে ধুয়েছে। সচেতনতার কোনো ঘাটতি ছিলো না-আমাদের পরিবারে। যেহেতু সে নিজেই ডাক্তারি পড়ছে আর আমরা ডাক্তারি পেশায় আছি। ঈদের আগের দিন রাতে সে দুই বন্ধুর সাথে- বড়জোড় দুই-আড়াই ঘণ্টার জন্য বাইরে যায়। এর পর ঘরে এসে গোসল করে শুতে যায়। পরদিন সকালে সে সামান্য মাথা ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে। আমি ওকে Panadol tablet খেতে দেই।
ডা. শবনম তাহির জানান, মাথা ব্যথা না কমলে- চারপাশে ঘটা বর্তমান পরিস্থিতির কথা চিন্তা করে আমি ওর শরীরের তাপমাত্রা নেই। দেখি ৯৯ ডিগ্রি। সাথে সাথে ওকে আমি অন্য একটা ঘরে আলাদা করে দেই। চব্বিশ ঘণ্টার ভেতরে ওর শরীরের তাপমাত্রা বেড়ে হয় ১০১ । আমি ওকে Panadol+Brufen দেই। সে তার ঘাড়েও ব্যথা অনুভব করে। আমার Pediatrician স্বামী মনে করেন -ছেলের হয়তোবা Meningitis হতে পারে। কিন্তু ওর কোনো বমি বা বমির কোনো ভাব নেই। আমরা দ্রুত টেস্টের জন্য ব্লাড স্যাম্পল পাঠাই এবং ডাক্তাররা বলেন -ওর Bacterial Meningitis হয়েছে এবং এন্টিবায়োটিকস দেয়া শুরু করি এবং আধ ঘণ্টার ভেতরে ওকে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করি।’
তিনি লেখেন, সব সময় আমি ওর সাথে ছিলাম। ওর কোনো ঠাণ্ডা, গলা ব্যথা, কাশি, বুক ব্যথা, পেট ব্যথা এসবের কিছুই ছিল না। ডাক্তাররা মনে করছেন Meningitis-ই হয়েছে। নিউরোসার্জন এসে দেখে গেলেন এবং সিটি স্ক্যান করা হলো নিশ্চিত হতে আমার ছেলের অন্য কোনো সমস্যা নেই। এ সময় লক্ষ করলাম ওর একটা চোখের কিছু অংশ ফোলা। বুকের এক্সরে করে দেখা যায় ছোট একটা দাগ। এরই মধ্যে কভিডের রেজাল্ট আসে। আমার ছেলে করোনায় আক্রান্ত। পরের ৮- ১০ ঘণ্টা ছিল জীবনের দুঃসহ যন্ত্রণার দিন। ওর হার্ট রেট, রেসপাইরেটরি রেট বাড়ছেই, অক্সিজেন লেভেল ড্রপ করছে। প্রতি মুহূর্তে মুহূর্তে ছেলে আমাদের চোখের সামনে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা কেউ কিছুই করতে পারছি না। কিছু বুঝে ওঠার আগে ছেলে চোখ বন্ধ করে। আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
তিনি আরও লেখেন, এরই মধ্যে আমার স্বামীরও করোনা পজিটিভ রেজাল্ট আসে। তাকেও আলাদা করা হয়। মেডিকেল প্রসিডিউর অনুযায়ী আমার সন্তান সালমানের জানাজা, দাফন হয়। কাউকে জড়িয়ে ধরে যে কাঁদবো -সেই সুযোগও হয়নি। কেউ হাসপাতালে ওয়ার্ডে ভর্তি হচ্ছে। কেউ লাশের গাড়িতে করে সরাসরি কবরস্থান, শশ্মানে চলে যাচ্ছে। কারো পাশে কেউ নেই। আমার সন্তানকে তো আমরা হারিয়েছি। এই শোক এই পৃথিবীতে আর কোনোদিনও কাটিয়ে উঠতে পারবো না। তাই নিজের সন্তানকে হারানোর আগে দয়া করে আমার কথাগুলো শুনুন—
১) ভুলেও মনে করবেন না যে- আপনার করোনা হবে না। আপনার নিজের না হলেও হয়তোবা আপনি করোনা ভাইরাসের বহনকারী হবেন। আমাদের যেটা মনে হচ্ছে, আমি আর আমার স্বামী প্রতিদিন নিজ নিজ কাজে গেছি। আর হয়তোবা আমরা নিজেরাই আমাদের সন্তানের জন্য বহন করে নিয়ে এসেছি। আর বেচারা ঘরে বসে থেকেই আমাদের কাছ থেকে ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে।
২) এখনো সময় আছে সতর্ক হোন। অধৈর্য্য হয়ে ঢিলেঢালা হয়ে চলাটা আপনার জন্য ঠিক মনে করলেও ভাইরাস কিন্তু সেটা মনে করছে না। তাই যাবতীয় জনসমাগম এড়িয়ে চলুন। এখন জীবনের তাগিদে যদি কাউকে বাইরে যেতে হয়- সেক্ষেত্রে কি বলা দরকার সেটা আমার জানা নেই।
৩) একজন ডাক্তার হিসাবে infertility treatment’র জন্য আমি প্রতিদিন ফোন কল পাচ্ছি। আপনাদের প্রতি বিনীত অনুরোধ দশবছর অপেক্ষা করতে পেরেছেন। সারা জীবন নিজের জন্য বাঁচতে এবং অন্যকে বাঁচাতে কেন মাত্র আরো ছয়টি মাস অপেক্ষা করতে পারছেন না। প্লিজ ধৈর্য্য ধরুন।
৪) সরকারের দেওয়া নির্দেশনা খুবই কড়াকড়িভাবে মেনে চলুন। একজন আরেক জনকে দোষারূপ করলে কিছুই হবে না। নিজ নিজ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক না হলে এই মৃত্যু মহামারি আটকানো যাবে না। হাসপাতালের যাবতীয় সুযোগ সুবিধা পেয়ে, নিজে ডাক্তার, নিজের স্বামী ডাক্তার হওয়ার পরও আমাদের সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি।
৫) আপনাদের মাঝে যারা বলছেন- এসব মিথ্যা। শুধু টাকা আয় করবার কৌশল। তাদেরকে বলছি- আমাদের সব সম্পত্তি দিয়ে দিতে চাই। শুধু আমাদের সন্তানকে একটিবার ফিরিয়ে দিন।
৬) যারা মনে করছেন- আমাদের আর করোনা হবে না। হওয়ার থাকলে এতো দিনে হয়ে যেতো। বিশ্বাস করেন, কিছু বুঝে ওঠার আগেই জীবন শেষ হয়ে যাবে। কিছুই বুঝতে পারবেন না। জীবন-মরণ আমাদের হাতে না। কিন্তু সাবধান থাকা আমাদের হাতে। তাই সতর্ক হোন, সাবধান হোন। আর কোনো মাকে যেনো আমার মতো হাহাকার করতে না হয়।’
Discussion about this post