ড. এম মেসবাহউদ্দিন সরকার
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিপর্যস্ত জনজীবন। হোম কোয়ারেন্টিনের গত তিন মাস ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকলেও শিশুদের লেখাপড়া চলছেই। ‘আমার ঘরে—আমার স্কুল’ প্রগ্রামের আওতায় সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে সরকারি স্কুলের পাঠক্রম অনলাইনের পরিচালিত হচ্ছে। মোবাইল ফোনে হেল্পলাইনও (নম্বর-৩৩৩৬) খোলা হয়েছে বিশেষজ্ঞ শিক্ষকের পরামর্শ বা সেবা নেওয়ার জন্য। এখানে পাঁচ মিনিট পর্যন্ত বিনা খরচে শ্রেণিপাঠ ও পরামর্শ নিতে পারবে। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে শিক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেখাপড়ার খোঁজ নেবেন শিক্ষকরা এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মা-বাবার কাছে দিয়ে আসবেন পরীক্ষা নেওয়ার জন্য। ব্যক্তি মালিকানাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব উদ্যোগে জুম-প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে ক্লাস নিচ্ছে, হোমওয়ার্ক দিচ্ছে এবং সেই কাজগুলো অনলাইনে তথা ই-মেইলে ফেরত নিচ্ছে। এভাবে গত তিন মাসে পরিবারের বড় ভাই-বোন, মা-বাবা এবং অন্য সদস্যরা যখন অনেকটা কর্মহীনভাবে সময় কাটাচ্ছে—তখন ঘরের ছোট্ট সোনামণিরা ব্যস্ত সময় পার করছে তাদের লেখাপড়া নিয়ে।
প্রাণঘাতী কভিড-১৯ রোগ থেকে বাঁচতে প্রাপ্তবয়স্করা কোনোভাবে বাড়িতে থাকতে পারলেও, ছোট শিশুটিকে ছোটাছুটি, ঘরের বাইরে যাওয়া বা অন্য শিশুর সঙ্গে খেলাধুলা থেকে বিরত রাখা সহজ নয়। আবার দীর্ঘদিন ধরে ঘরে থাকলে শিশুমনে মানসিক চাপ বাড়তে পারে। অবশ্য প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কম থাকলেও তাদের এসব বিষয় সম্পর্কে জানাতে হবে। আতঙ্ক ও ভয় দূর করে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে ছোটকাল থেকেই। শিশুমনে করোনার বিষয়ে যেন আতঙ্ক ও ভয়ের সৃষ্টি না হয়, এ জন্য পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে শিশুদের সময় দিতে হবে মা-বাবাকে, ঘরের ভেতরেই শিশুদের হাসিখুশি রাখতে, খেলাধুলা ও বিনোদনের আয়োজন করতে হবে। আর বিনোদনের তালিকায় যদি থাকে কম্পিউটার গেমস, তাহলে তো আর কোনো কথাই নেই। তাই করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে সফটওয়্যার কম্পানিগুলো শিশুদের জন্য তৈরি করছে মজার মজার ফ্রি অনলাইন গেম, যা মোবাইল/ডেস্কটপ/ল্যাপটপ দিয়ে খেলা যায়। অর্থাত্ লেখাপড়া ও খেলা চলবে সমানতালে।
শিশুদের জন্য বিশ্বের প্রথম করোনাভাইরাস গেম বানালেন ইউনিভার্সিটি অব হার্টফোর্ডশায়ারের মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক রিচার্ড ওয়াইজম্যান। গেমটির নাম ‘ক্যান ইউ সেভ দ্য ওয়ার্ল্ড’। গেমটিতে শিশুরা সামাজিক দূরত্ব সম্পর্কে, ব্যস্ত রাস্তায় কিভাবে পথচারী, সাইকেল আরোহী এবং মানুষের হাঁচি-কাশি এড়িয়ে চলা যায় সেটা দেখানো হয়েছে। এভাবে গেমটিতে নিজেকে রক্ষার পাশাপাশি যত বেশি মানুষকে বাঁচানো যাবে গেমের স্কোর তত বাড়বে। ‘লাইফ দ্য গেম’ নামের অপর গেমটিতে ছোট একটি ছেলে খেলার মাঠে ঘুরে বেড়ায় যেখানে আরো কিছু শিশু তাদের নিজেদের মতো করে খেলাধুলা করে। অন্য শিশুদের থেকে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে মাঠের মধ্য দিয়ে শিশুটিকে টেনে নিয়ে যেতে পারলে পয়েন্ট পাবে। উদ্ভাবনী এ গেমটি একটি বাচ্চাকে সামাজিক দূরত্ব শিখতে প্রশিক্ষণ দেবে, যা কভিড-১৯-এর ঝুঁকি রোধে গুরুত্বপূর্ণ।
এদিকে ‘Cerba-20’ নামে শিশুদের জন্য মজার একটি গেম বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে মাত্র ৯ বছর বয়সী ইতালির শিশু লাপো দাতুরি। এই গেমের খেলোয়াড়রা মহাকাশযানে চড়ে যুদ্ধ নামে প্রতিপক্ষ কভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে। সব করোনাভাইরাসকে মেরে ফেলে যুদ্ধে এরা জয়ী হয়। শিশুদের অতি প্রিয় ‘মিনা-রাজু’ কার্টুনে করোনাভাইরাসসংক্রান্ত স্বাস্থ্যবিধিগুলো চমত্কারভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। মিনা ও রাজু তাদের সঙ্গীদের নিয়ে রুমাল দিয়ে নাক চেপে ধরা এবং সাবান দিয়ে হাত ধৌত করার দৃশ্য দেখেই প্রতিপক্ষ করোনাবাহিনী পালাতে থাকে। এমনি করে ‘সিসিমপুর’ শিশুতোষ কার্যক্রমটি তিন থেকে আট বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের বিকাশ, জীবনদক্ষতার উন্নয়ন, মৌলিক শিক্ষার চাহিদা পূরণের জন্য তৈরি হয়েছে, যেখানে শিশুদের পাশাপাশি তাদের মা-বাবা এবং শিক্ষকরাও অন্তর্ভুক্ত আছেন। করোনাকালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সব বিধি-নিষেধগুলো দেখাচ্ছে এবং মেনে চলার আহ্বান জানাচ্ছে। খেলার ছলে ভিডিও গেমের মাধ্যমে শিশুরা এভাবে ছোটকাল থেকেই হাত, মুখ, নাখ পরিষ্কার রাখার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারছে।
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে মাস্ক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বস্তু। এবার সেই মাস্কে ছেয়ে গেছে শিশুদের অনলাইন গেমেও। কোথাও গেম শুরু করার আগে নিজের পছন্দের চরিত্রের মুখে বাঁধতে হচ্ছে মাস্ক, আবার কোথাও খেলার প্রধান কুশীলবরা সবাই হাজির হচ্ছে মাস্ক পরে। খুদেদের খুবই পছন্দের খেলা ‘মাই হর্স স্টোরিজ গেম’। যেখানে ফার্মের পছন্দের ঘোড়ায় চড়া শিখতে হলে কাউবয়কে সাজতে হবে মাস্ক পরে। গেমে তাদের পছন্দের নায়ক-নায়িকা এমনকি সুপারহিরোদের মুখও এখন মাস্কে ঢাকা। এভাবে পছন্দের মাস্ক মুখে লাগিয়ে নিলেই এগোনো যাবে পরবর্তী ধাপে। ‘হিপহপ’, ‘ব্যালে’ বা ‘জ্যাজ’ নাচের জন্য ‘ডান্স স্কুল স্টোরিজ’, ‘আইস স্কেটিং’ বা ‘প্রিটি ব্যালেরিনা’র মতো গেমের চরিত্রেও আজ মুখ ঢেকেছে মাস্কে। ‘চিয়ারলিডার ডান্স অব চ্যাম্পিয়নশিপে’ নামতে গেলে শারীরচর্চার জন্য যেতে হয় জিমে। সেখানেও দেখা যাচ্ছে, জিম থেকে ডান্স ফ্লোর—মাস্ক পরলে তবেই মিলছে ছাড়পত্র। এভাবে পরবর্তী ধাপে গেলেই অপেক্ষা করছে হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাথার ক্যাপ, পিপিই ইত্যাদি। কোনো কোনো গেমে শুধু গুলি করেই ‘করোনা’ মারতে হবে এবং মারতে মারতেই হবে জয়। কয়েক দফায় জিতে ‘কোয়ারেন্টিন জোন’-এ ঢুকে পড়লে লড়াই আরো কঠিন। কোনো গেম আবার জানাচ্ছে, ভাইরাসে ভরে গেছে শহর। ছোঁয়া বাঁচাতে আক্রান্ত মানুষদের থেকে ছুটে পালাতে হবে। অপর একটি গেমে আবার খেলোয়াড়দের হাসপাতালের কর্মী সাজিয়ে হাসপাতালেরই বাস চালিয়ে ভাইরাস আক্রান্তদের পিষে মারার প্রতিযোগিতায় নামাচ্ছে। ছোটদের করোনা সংক্রমণ নিয়ে জানাতে এবং করোনাসংক্রান্ত স্বাস্থ্য সরঞ্জামের কার্যকারিতা শেখাতেই এতসব উদ্যোগ। তাই একদিকে ভিডিও কম্পানিগুলো যেমন গেমকে প্রাণবন্ত করছে, অন্যদিকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসকে পুঁজি করে প্রতিনিয়ত বাজারে ছাড়ছে নিত্যনতুন মজার মজার শিশুতোষ গেম।
টিভি, মোবাইল, ট্যাব তথা স্ক্রিন মিডিয়া শিশুমনে কিরূপ প্রভাব ফেলে—এ নিয়ে বিশ্বে অনেক গবেষণা চলছে। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব গেমে সামাজিক ইতিবাচক আচরণকে উত্সাহিত করে সেগুলো বাস্তবেও মানুষকে প্রভাবিত করতে পারে। ভিডিও গেমের মাধ্যমে যে বার্তা দেওয়া হয় তা মানুষকে, বিশেষ করে শিশুদের জীবনে সত্যিকারের প্রভাব ফেলে। তাদের মতে, সরকার, স্কুল এবং স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ লকডাউন তোলার পরও শিশুদের উত্সাহিত করার জন্য গেমটি ব্যবহার করতে পারে। তবে এসব গেম নিয়ে চিন্তায় আছে সমাজতত্ত্ববিদ, মনোরোগ চিকিত্সক এবং সাইবার বিশেষজ্ঞরা। এ ধরনের ভাইরাস গেম হিংসাত্মক আচরণকে প্রশ্রয় দেয় কি না সেটা চিন্তার বিষয়। তারা জানায়, গেমের নিয়ম মানতে গিয়ে মৃত্যুর উদাহরণও রয়েছে। পাবজির মতো গেম খেলায় শিশুমনে বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল দিল্লির শিশু সুরক্ষা কমিশন। আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির তিন মনোবিজ্ঞানীর পরিচালিত এক সমীক্ষায় তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম গ্রেডের এক হাজার ৩২৩ জন ছেলে-মেয়ের ওপর সমীক্ষায় দেখা গেছে, যেসব ছেলে-মেয়ে দৈনিক দুই ঘণ্টার বেশি টিভি বা ভিডিও গেম দেখে, তারা গড় হারের দেড় গুণ থেকে দুই গুণের বেশি মনঃসংযোগ সমস্যায় পড়ে। শিশু মনোবিজ্ঞানী ডগলাস জেনটাইলের মতে, ভিডিও গেমগুলোতে দ্রুত দৃশ্য বদল, আলো, শব্দ, ক্যামেরার অ্যাঙ্গেলের সর্বক্ষণ পরির্বতন ও কম্পন এমনভাবে হয়ে থাকে যে শিশুদের মনে ও মস্তিষ্কে তা স্থায়ী হয়ে যায়। এই অবস্থায় শিশুরা যখন ক্লাসরুমে যায় তখন সেখানে এ ধরনের কিছু না পেয়ে শিক্ষকের নিরস পাঠদানের প্রতি মনঃসংযোগ থাকে না।
তাই বাড়িতে হোক কিংবা ক্লাসরুমেই হোক, বাচ্চাদের মনোযোগ পাওয়ার জন্য যেসব মা-বাবাকে হিমশিম খেতে হয়, তাঁদের উচিত সন্তানের টিবি দেখা বা ভিডিও গেম খেলা সীমিত করে দেওয়া। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘক্ষণ টিভির পর্দা, মোবাইল ফোন কিংবা ট্যাবলেটের মতো ছোট স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলে চোখের দৃষ্টি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শিশুদেরকে অন্যান্য বিনোদনমূলক কাজ যেমন—ছবি আঁকা, নাচ-গান, গল্প-কবিতা আবৃত্তি, ধর্মকর্মের কাজ, এমনকি মায়ের সঙ্গে সংসারে ছোটখাটো কাজে তথা ছাদে বা বারান্দায় বাগান পরিচর্যায় সম্পৃক্ত করানো উচিত।
লেখক : অধ্যাপক ও পরিচালক (আইআইটি) এবং তথ্য-প্রযুক্তিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Discussion about this post