অনলাইন ডেস্ক
অনেক সময় নিজের ছেলে-মেয়েদের তাগিদ থেকেও বাবারা জন্ম দিয়েছেন অসাধারণ কিছু সৃষ্টি। এখানে এমন পাঁচটি সৃষ্টির গল্প উল্লেখ করা হলো।
তোমাদের জন্য রূপকথা, ১৯৮৮
হুমায়ূন আহমেদ একদিন বাসায় গিয়ে শোনেন, বড় মেয়ে নোভাকে পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ খোঁজ খোঁজ। কিন্তু কোথাও নেই নোভা। শেষ পর্যন্ত তাকে পাওয়া গেল ভাঁড়ারঘরের চৌকির তলে। কিন্তু ওখানে কী করছিল সে? বই পড়ছিল। বাবারই লেখা একটা বই, তবে মোটেই সেটা ছোটদের উপযোগী না। বড়দের বই পড়ার জন্য তাকে খুব বকাঝকা করলেন মা গুলতেকিন। তখন নোভা বলল, বাবা এসব বই না লিখে তাদের উপযোগী বই লিখলেই পারে। তখনই হুমায়ূন ঠিক করেন, ছোটদের জন্য রূপকথাজাতীয় বই লিখবেন। কিন্তু করতে গিয়ে দেখলেন কাজটা মোটেও সহজ না, বহু কাটাকুটি করেও গল্প আর মনমতো হয় না। এর মধ্যে মেজো মেয়ে শীলার হলো জ্বর। যাকে বলে উথাল-পাতাল জ্বর। এক রাতে জ্বর একটু কমলে গল্প শোনার আবদার করল শীলা। বিদ্যুৎ ছিল না তখন, মোম জ্বলছে। ওই আধিভৌতিক পরিবেশে শীলাকে গল্প শোনাতে গিয়েই জন্ম নিল ‘আলাউদ্দিনের চেরাগ’। রূপকথার চেনা চরিত্র ব্যবহার করে একেবারে ভিন্ন ধরনের এক গল্প। বইয়ের বাকি কাহিনিগুলোও এভাবে লেখা। তোমাদের জন্য রূপকথা এমন এক বই, যেখানে ডাইনি মোটেই ভয়ংকর নয়, বাচ্চারা দেখলে খিলখিল করে হাসে। দৈত্য ভীষণ বোকা আর ভীতু।
আলিওনুশকার জন্য গল্প, ১৮৯৪-৯৬
রাশিয়ার হাড় হিম করা শীতকাল, বাইরে অঝোরে ঝরছে বরফ। বিছানায় জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে চার বছরের আলিওনুশকা। বাবা গল্প না শোনালে ঘুমাবে না। ওর বাবা দিমত্রি মামিন-সিবিরিয়াক একজন লেখক। স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে এই মেয়েটার মা-বাবা সবই এখন তিনি। মেয়ের মন রাখতে তাই বিছানার পাশের আরাম কেদারাটায় গিয়ে বসলেন সিবিরিয়াক, শোনাতে শুরু করলেন গল্প। এভাবে শীতের রাতে বলা গল্পগুলো থেকেই জন্ম নিল রুশ সাহিত্যের অসাধারণ এক বই ‘আলিওনুশকার জন্য গল্প’। এই গল্পের পাত্র-পাত্রীরা রুশ লোককথার জন্তু-জানোয়ার, পাখি। এভাবেই শিশুসাহিত্যে মেয়ের নামটা অমর করে দিলেন মামিন-সিবিরিয়াক।
জাস্ট সো স্টোরিজ, ১৯০২
রাডিয়ার্ড কিপলিংয়ের ‘জাস্ট সো স্টোরিজ’-এর গল্পগুলোর আদি শ্রোতাও কিন্তু তার প্রথম সন্তান এফি ওরফে জোসেফিন। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে প্রতি সন্ধ্যায় নতুন নতুন গল্প শোনাতেন কিপলিং। মেয়েকে ঠিক যেমন যেমন বলেছিলেন, হুবহু সেই রকম [জাস্ট সো] রেখেই পরে বাচ্চাদের ম্যাগাজিনে ছাপতে শুরু করেন, মেয়ের কড়া হুকুম—একটা শব্দও পাল্টানো যাবে না। আর তাই থেকেই পরে বইটির নামও রাখেন জাস্ট সো স্টোরিজ। তিনটা গল্প বের হওয়ার পরই অবশ্য জোসেফিন মারা যায়। বইতে মোট গল্প আছে ১৩টি। বিভিন্ন প্রাণী কিভাবে তার সবচেয়ে চমৎকার বৈশিষ্ট্যটি পেয়েছে, গল্পগুলোতে তা-ই কাল্পনিকভাবে বলা হয়েছে। যেমন—চিতাবাঘ কিভাবে সুন্দর ফুটকিগুলো পেয়েছে, কিংবা তিমি কিভাবে তার কুঁজ পেল, গণ্ডার তার চামড়া, হাতি তার শুঁড়। বইয়ের চমৎকার ছবিগুলোও কিপলিংয়ের আঁকা।
জেমস অ্যান্ড দ্য জায়ান্ট পিচ, ১৯৬১
‘চার্লি অ্যান্ড দ্য চকোলেট ফ্যাক্টরি’, ‘মাটিল্ডা’, ‘বিএফজি’র মতো দুনিয়া মাতানো বইয়ের স্রষ্টা রোয়াল্ড ডাল শুরুতে কিন্তু ছোটদের লেখক ছিলেন না, লেখকজীবনের প্রথম ১৫ বছরে বাচ্চাদের জন্য একটাই গল্প লিখেছিলেন তিনি, ‘গ্রেমলিন’। তা-ও প্রাণের তাগিদে না, সিনেমা কম্পানি ডিজনির নির্দেশে গল্পটা লিখেছিলেন তিনি। পরেও হয়তো ছোটদের জন্য এত সব বই লেখা হতো না, যদি না বাবাকে একরকম চেপে ধরে বাধ্যই করত তাঁর দুই মেয়ে অলিভিয়া আর টেসা। বাবা তাদের জন্য কিছুই লেখেন না, এই ছিল তাদের দুঃখ। তাদের মন রাখতেই ঘুমানোর সময় বানিয়ে গল্প বলতে লাগলেন ডাল। ব্যস, জন্ম নিল ‘জেমস অ্যান্ড দ্য জায়ান্ট পিচ’। এটা ছোট্ট বালক জেমসের কাহিনি। রহস্যময় এক লোক সবুজ কিছু বীজ দিয়ে তাকে বলে, এগুলো তার জীবনকে অ্যাডভেঞ্চারে ভরিয়ে দেবে। ওই বীজ থেকেই জন্মে একটা পিচগাছ, তাতে ধরে বিশাল এক পিচ। একসময় এর আকার হয়ে ওঠে একটা বাড়ির সমান। তারপর সত্যি দারুণ এক অ্যাডভেঞ্চারে জড়িয়ে পড়ে জেমস।
গুপী গাইন বাঘা বাইন, ১৯৬৯
সন্দীপ রায়ের বয়স তখন ১০। হঠাৎ বাবা সত্যজিৎ রায়কে আবদার করে বসল, আমাদের জন্য ছবি বানাতে হবে। তত দিনে ১০টা পুর্ণদৈর্ঘ্য ছবি আর একটা তথ্যচিত্র বানিয়ে ফেলেছেন সত্যজিৎ, কিন্তু তার একটাও ঠিক ছোটদের ছবি না। অতএব, দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর কাহিনি নিয়ে ছেলের জন্য ছবি বানানোর পরিকল্পনা করলেন সত্যজিৎ। নানা অসুবিধায় সেই ছবির কাজ শুরু করতে অবশ্য আরো চার বছর লেগে গেল। ছবির কাহিনিতে দেখা যায়, গুপী আর বাঘা সংগীত ভালোবাসে, অথচ এ বাবদে তাদের কোনো প্রতিভাই নেই। ভূতের রাজা তাদের তিনটি বর দেয়। সেই ক্ষমতাবলে মজার সব অ্যাডভেঞ্চারে বেরিয়ে পড়ে তারা।
Discussion about this post