এই যুদ্ধের নাম জঙ্গে জামাল । জামাল অর্থ উট । আয়েশা (রাঃ) এর উট ব্যবহার করিয়া মোনাফিকেরা যুদ্ধ চালাইয়া যাইতেছিল । যখন এই উট বসিয়া পড়িল যুদ্ধও ক্ষান্ত হইল । মুনাফিকেরা পলায়ন করিল ।
জঙ্গে জামালে আলী (রাঃ) জয়ী হবার পর আমীর মুআবিয়া (রাঃ) বুঝিতে পারিলেন যে আলী (রাঃ) এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভবপর হইবে না । তাই শোরাহবিল ইবনে সামাত (রাঃ) এর সহযগীতায় তিনি সিরিয়াব্যাপী ব্যাপক সমর্থন আদায় করিবারা প্রয়াস করিলেন । ওসমান (রাঃ) এর রক্তমাখা জামা এবং তৎপত্নী নায়েলা (রাঃ) এর কাটা অঙ্গুলি [ যাহা ওসমান (রাঃ) কে রক্ষা করার চেষ্টায় কাটা গিয়াছিল ] এই দুইটি জিনিস জনসাধারণকে উত্তেজিত করতে ব্যবহার করা হইয়াছিল ।
এদিকে আমীর মুআবিয়া (রাঃ) এর প্রভাব হ্রাস এবং রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর স্মৃতিবিজড়িত শহর মদিনাকে আক্রমণ থেকে হেফাজতের উদ্দেশ্যে আলী (রাঃ) মদীনা থেকে রাজধানী কুফায় স্থানান্তর করিলেন ।
হযরত আলী (রাঃ) মুআবিয়া (রাঃ) এর সৈন্যদলকে ভয় করিতেন না; কিন্তু মুসলমানদের মধ্যে হানাহানি তিনি পছন্দ করিলেন না । তাই মুআবিয়া (রাঃ) এর নিকট সন্ধিপত্র পাঠাইয়া দিলেন এই মর্মে যে তিনি উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদের বিচার করিবেন তবে এই জন্য আলী (রাঃ) এর বাইয়াত গ্রহণ করা জরুরী । কারন হযরত আলী (রাঃ) মুহাজির ও আনসারগণের দ্বারাই খলিফা নির্বাচিত হইয়াছেন । জবাবে মুআবিয়া (রাঃ) লিখিলেন, ‘আমরা আপনার হাতে বাইয়াত করিতে অস্বীকার করিতেছি না এবং আপনার যোগ্যতাও অস্বীকার করি না, তবে একটা শর্ত আছে এবং উহা এই যে, হযরত উসমান (রাঃ) এর হত্যাকারীদেরকে আমাদের হাতে অর্পন করিতে হইবে ।’
হজরত আলী (রাঃ) পুনরায় চিঠিতে মতৈক্যে পোছাতে আমীর মুআবিয়া (রাঃ) এবং তাঁর উপদেষ্টা আমর ইবনুল আ’সকে নির্দেশ দিলেন; অন্যথায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল হইবে এবং উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া হইবে ।
এই চিঠির পরো কোন ধরনের মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভবপর হয় নি । বাধ্য হইয়া হিজরি ৩৬ সালের শেষভাগে হযরত আলী (রাঃ) আশি হাজার সৈন্য লইয়া আমীর মুআবিয়ার মোকাবেলার জন্য রওনা হইলেন এবং ফোরাত নদীর তীরে সিফফফীন নামক স্থানে গিয়া অবস্থান করিলেন ।
এদিকে আমীর মুআবিয়ার সৈন্যগণ আগেই ফোরাত অধিকার করিয়া রাখিয়াছিলেন । তাহারা আলী (রাঃ) এর সৈন্যদের পানি ব্যাবহার করিতে দিত না । ফলে পানি লইয়া যুদ্ধ লাগিয়া গেল । এই যুদ্ধ সিফফিনের যুদ্ধ নামে পরিচিত । মুআবিয়া (রাঃ) এর সৈন্যগণ পলায়ন করিলেন । কিন্তু ফোরাতের পানি অধিকারে আসার পর হাসেমীগন এই পানি পানে কাউকে বাঁধা প্রদান করেননি । কয়েক মাসব্যাপী বারংবার এই যুদ্ধ চলে । উভয়পক্ষের অনেক সৈন্য নিহত হইল । রণক্ষেত্র লাশে পরিপূর্ন হইয়া গেল । দীর্ঘ যুদ্ধের পর মুআবিয়া (রাঃ) এর সৈন্যদল ক্রমশঃ দূর্বল হইয়া পড়িল এবং পরাজয়ের আশঙ্কায় সন্ধিপ্রস্তাব হযরত আলী (রাঃ) কে পাঠাইলেন । হিজরি ৩৭ সনের রবিউল আউয়াল মাসে উভয়পক্ষ সন্ধিপত্রে সাক্ষর করিল এবং সিদ্ধান্ত হইল যে, বিচারকদের সিদ্ধান্ত ঘোষণার অনুষ্ঠান শাম ও ইরাকের মধ্যবর্তী এলাকা দুমাতুল জন্দল নামক স্থান অনুষ্ঠিত হইবে । দুইজন বিচারক হওয়ায় যা হইবার তাহাই হইল; রায়ের পরিণাম দুঃখজনক হইল । সন্ধির পরপর একদল বিপ্লবী সন্ধি ভাঙ্গিয়া পুনরায় যুদ্ধ আরম্ভ করিবার চেষ্টা করিল । কুটচেষ্টায় ব্যর্থ হওয়ায় আলী (রাঃ) এর দলত্যাগ করিল । ইতিহাসে তাহারা খারিজি বলে পরিচিত । ইহাদের অনেক আকিদা ইসলাম সঙ্গত ছিল না । তাহারা একত্রিত হইয়া নিরীহ মুসলমান নর-নারীকে নির্দয়ভাবে হত্যা করিয়া চলিল । অবশেষে তাহাদের দমনার্থে আলী (রাঃ) অগ্রসর হইলেন । মুসলমানদের হাতে তারা পরাজিত হইল । কিন্তু আলী (রাঃ) এর বাহিনী ক্রমশঃ দূর্বল হইয়া গেল ।
অপরদিকে আমীর মুআবিয়া (রাঃ) শক্তিশালী হইয়া হেজাজ, ইরাক ও মিশরে আধিপত্য বিস্তার করিতে লাগিলেন । তাঁহার হাতে মক্কা ও মদিনার পতন হইল । অতঃপর ইয়ামনে আক্রমণ করিলেন এবং বহু সাধারণ লোক নিহত হইল । এইরূপ অরাজকতায় খারিজিরা সুযোগ লইল । আব্দুর রহমান ইবনে মুজলেম ১৮ ই রমজান ফজরের নামাজ ইমামতীকালীন আলী (রাঃ) কে বিষমাখা তরবারি দ্বারা মাথায় আঘাত করিল । হযরত আলী (রাঃ) নামাজের মসল্লাতেই শুইয়া পড়িলেন । তিনদিন পর ২১ শে রমজানর রাত্রে এই এলেমের সূর্য অস্ত গেল ।
রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর কোলে যিনি লালিত-পালিত হইয়াছিলেন, রাসুলুল্লাহ (সঃ) এর মুখে যিনি কোরআন পাক শ্রবণ করিয়াছেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর কাছেই যিনি কুরআন শিক্ষা লাভ করিয়াছেন এবং বুঝিয়াছেন, তাঁহার এলম সম্পর্কে আর কাহার এলেমের তুলনা করা যাইতে পারে? রাসুলুল্লাহ (সঃ) ফরমাইয়াছেনঃ “আমি এলেমের শহর এবং আলী উহার দরজা ।“ এই কাড়নের সাহাবীগণের মধ্যে হযরত আলী (রাঃ) অন্যান্য সাধারণ জ্ঞানের অধিকারী ছিলেন ।
Discussion about this post