শিহাবউদ্দিন শিশির
যতটা না তিনি ‘নূর ভাই’ হিসেবে পরিচিত, তারও বেশি পরিচিত ‘বাকের ভাই’ হিসেবে। ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকের ‘বাকের ভাই’ চরিত্রে অভিনয় করে সারাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করে নিয়েছেন তিনি। বলছি আসাদুজ্জামান নূরের কথা। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে অন্যতম সেরা ধারাবাহিক ‘এইসব দিনরাত্রি’, ‘বহুব্রীহি’, ‘কোথাও কেউ নেই’ ও ‘অয়োময়’ আবারও বিটিভিতে প্রচার হলো । এই তিন নাটকের প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর। তাকে নিয়েই এই প্রতিবেদন
এ সময়ে আমাদের দেশের টেলিভিশনে প্রচারিত চারটি ধারাবাহিক নাটকের নাম বলতে পারবেন? মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে অনেকেই কিছুটা চিন্তায় পড়বেন। কারণ, গত কয়েক বছর ধরে প্রায় প্রতি সন্ধ্যায় শহর বা গ্রামের বাড়িতে কলকাতার সিরিয়াল সদর্পে চলছে! অথচ এমনটা ছিল না। একটা সময় ছিল, যখন বিটিভির নাটক শুরু হলে, রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত! সেই সময়ে পশ্চিমবঙ্গের দর্শকরাও আমাদের নাটক দেখার জন্য মুখিয়ে থাকতেন। সম্প্রতি বিটিভি তাদের সেরা নাটকগুলো পুনরায় প্রচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই মধ্যে প্রচার শেষ হয়েছে ‘বহুব্রীহি’ ও ‘কোথাও কেউ নেই’। শুরু হয়েছে ‘এইসব দিনরাত্রী’ ও ‘অয়োময়’। জনপ্রিয় এই চার ধারাবাহিক লিখেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই চার ধারাবাহিকের অন্যতম প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন আসাদুজ্জামান নূর।
হুমায়ূন আহমেদ ‘এইসব দিনরাত্রি’ লিখেছিলেন ১৯৮৫ সালে। সেই সময় ধারাবাহিক লেখার ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদের আগ্রহ না থাকলেও, বাড়িতে একটি রঙিন টিভি কেনার তাগিদেই লিখলেন ‘এইসব দিনরাত্রি’। নাটকটি প্রযোজনা করেন মোস্তাফিজুর রহমান। ঢাকায় বাস করা এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের জীবনযাপন ঘিরে এর গল্প। যার শেষ হয় ‘টুনি’ নামের লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত এক ছোট্ট মেয়ের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।’ এই নাটকে ‘রফিক’ চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। এটিই ছিল নূর অভিনীত প্রথম ধারাবাহিক। তিনি বলেন, ‘এই নাটকে অভিনয়ের আগে, যেসব নাটকে অভিনয় করতাম, তার বেশিরই ছিল প্রেমের। ফলে খুব একটা স্বস্তি মিলত না। যখন ‘এইসব দিনরাত্রি’র নাটকে অভিনয়ের প্রস্তাব পেলাম- দেখলাম ‘রফিক’ চরিত্রটি একেবারেই অন্যরকম। এই রফিকের দায়িত্বজ্ঞান কিছুটা কম। এ কারণেই চাকরি না থাকা সত্ত্বেও, হুট করে বড়লোকের মেয়ে শারমিনকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসে। তবে কিছুটা গম্ভীর সময়ে রফিক দমকা হাওয়ার মতোই কাজ করে।’
শুরুতেই বলেছি, ধারাবাহিকে হুমায়ূন আহমেদের তেমন আগ্রহ না থাকলেও, ১৯৮৮ সালে আবারও তিনি কলম ধরলেন। এবার হাসির নাটক। যার প্রযোজনার দায়িত্ব নেন নওয়াজেশ আলী খান। নাম ‘বহুব্রীহি’। ‘এইসব দিনরাত্রি’র মতো ‘বহুব্রীহি’র কেন্দ্রবিন্দুও ছিল একটি পরিবার। যে পরিবারের সব পুরুষ চরিত্র আধা-পাগল, আর নারীরা সুস্থ ও স্বাভাবিক। সেই বাড়ির ভাড়াটিয়া হিসেবে দুই সন্তান নিয়ে বিপত্নীক যুবক আনিস এসে উপস্থিত হন। আনিস বুদ্ধিমান ও যুক্তিসম্পন্ন মানুষ। এই চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। ‘বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন’, ‘কুত্তাওয়ালী জবাব চাই’, কিংবা, ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’- এই স্লোগানগুলো কোনো রাজনৈতিক নেতার ফাঁসি ঠেকাতে ব্যবহূত হয়নি। নাটকের একটা চরিত্রকে বাঁচানোর জন্য এসব স্লোগান ব্যবহার হয়েছিল। নাটকের একটি চরিত্রের ফাঁসি ঠেকানোর জন্য এসব করা, নাট্যকারের বাসায় হামলা- এ রকম অদ্ভুত ঘটনা ইতিহাসে খুব কমই আছে। এমন ঘটনাই ঘটেছিল ‘কোথাও কেউ নেই’ এর বাকের ভাইকে ঘিরে। এই চরিত্রে অভিনয় করেন আসাদুজ্জামান নূর। অন্যদিকে ব্রিটিশ ভারতে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারের আভিজাত্য, অহংকারসহ আরও নানা বিষয় নিয়ে নির্মিত হয় টেলিভিশন অন্যতম সেরা ধারাবাহিক ‘অয়োময়’। এই নাটকে মির্জা সাহেব চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর অনবদ্য অভিনয় করেন। এই নাটকটি প্রযোজনা করেছিলেন নওয়াজেশ আলী খান। বিটিভিতে আবারও পুরোনো জনপ্রিয় নাটক প্রচার করছে। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন? আসাদুজ্জামান নূর বলেন, ‘বিটিভি দারুণ একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে করে এই সময়ের দর্শকরা যারা শুধু সেই সময়ের নাটকের নাম জানতেন, তারা নাটকগুলো দেখতে পারছেন। অন্যদিকে যারা সেই সময়ে নাটকগুলো দেখেছেন, তারা সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে পারছেন।’
এই নাটকগুলোতে অভিনয় করতে গিয়ে তো আপনার সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের বন্ধুত্ব হয়েছিল? ‘হ্যাঁ। একটা সময় ছিল, যখন হুমায়ূন আমার কথা চিন্তা করেই নাটক লিখতেন। আমাকে বুঝে নাটক লিখতেন আর আমিও তাকে বুঝতাম যে, তিনি কী চান? হুমায়ূন টেলিভিশন নাটকের ধারাটাই বদলে দিয়েছিলেন। তার গল্পগুলো ছিল আমাদের প্রতিদিনের জীবন নিয়ে, কিন্তু তার ভেতরে হিউমার ছিল।’ আপনার শুরু ধারাবাহিক থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত দাড়ি নিয়েই কাজ করতে দেখা যায়… দাড়ি ছাড়া কাজ করেননি? ‘করেছি। একদম শুরুর দিকে। দাড়ি রাখার একটা কারণ ছিল। সেটা হলো, আমি রাশিয়ান ইনফরমেশন সেন্টারে চাকরি করতাম। সেখানকার নিয়ম ছিল অনেক কড়া। সকাল ৮টায় অফিসে পৌঁছতে হতো। তখন থেকেই আমি বেশি সকালে ঘুম থেকে উঠতে পারি না। ঘুম থেকে উঠে শেভ করে অফিসে যাওয়ার জন্য অনেক আগে ওঠার একটা ব্যাপার ছিল। সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই দাড়িটা রেখে দিলাম। আমার অনেক বন্ধু এটা নিয়ে মজাও করেছে- প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়ে দাড়ি রেখেছি। পরে সবাই বলল, দাড়িতে খারাপ লাগছে না। আর দু-একটা নাটকে অভিনয়ের পরও দেখলাম, সবাই ভালোভাবেই নিচ্ছে। পরে বিভিন্ন দিক ভেবেচিন্তে দাড়ি রেখেই দিলাম। আমাকে অনেকে বলেছে দাড়ি কেটে ফেলতে, কিন্তু তা করিনি।’ জীবনের অনেকগুলো সময় পার করেছেন। এখন পেছন ফিরে দেখলে কী মনে হয়? ‘ পেছনে তাকালে মনে হয় সময়টা ঠিকমতো কাজে লাগাইনি। হয়তো আরও অনেক কিছু করার ছিল। আবার এটাও মনে হয় যা পেয়েছি, সেটিও কি আমার পাওয়ার কথা ছিল? এই দেশ, আমার বাংলাদেশ আমাকে অনেক দিয়েছে। এই ঋণ শোধ করি কী করে?
Discussion about this post