নিজস্ব প্রতিবেদক
মাধ্যমিক স্তরে বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপায় নানা অনিয়ম, কেলেঙ্কারির দায়ে ১০টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে বড় অঙ্কের জরিমানা এবং বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এসব প্রতিষ্ঠান সময়মতো বই না দেওয়া, বইয়ে নিম্নমানের কাগজ-কালির ব্যবহার, ভাড়ায় অন্য প্রতিষ্ঠানে বই ছাপানো, সিট মেশিনের পরিবর্তে ওয়েব মেশিনে ছাপানোর প্রমাণ মিলেছে। এরপর এসব প্রতিষ্ঠানকে আর্থিক জরিমানাসহ স্থায়ী কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হয়েছে। গত ৮ মার্চ এনসিটিবির উৎপাদন কমিটির সভায় শাস্তির এসব সিদ্ধান্ত হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
শাস্তির মুখে পড়া ১০ মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান হলো- ভাই ভাই প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন, নুরুল ইসলাম প্রিন্টিং প্রেস, ফাইভ স্টার, অয়ন প্রিন্টিং প্রেস, রাইয়্যান প্রিন্টার্স, সেতু অফসেট, মোলস্না ইন্টারন্যাশনাল, আমাজান, নিউ নাহার এবং মা-বাবা প্রিন্টিং প্রেস। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠান রাজধানীতে এবং মোলস্না ইন্টারন্যাশল প্রিন্টিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান ঠাকুরগাঁওয়ে। এসব প্রতিষ্ঠান ২০২০ শিক্ষাবর্ষের মাধ্যমিক স্তরের ইংরেজি, বাংলা ভার্সন, দাখিল, ভোকেশনাল এবং কারিগরি (ট্রেড বই) ছাপানোর কাজ করে। তবে মালিকদের অভিযোগ, এনসিটিবি বড় প্রতিষ্ঠানকে ছাড় দিলেও ছোটখাটো ভুলে শাস্তি পায় ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো। এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন এনসিটিবির উৎপাদন শাখার কর্মকর্তারা। তারা বলেন, যেসব অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় সে ধরনের অভিযোগ বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না।
এ ব্যাপারে এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক প্রফেসর জিয়াউল হক বলেন, প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দেওয়া হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে বই ছাপাতে ব্যর্থ হলে আর্থিক জরিমানা দেওয়া সাধারণ অপরাধ। এজন্য কাউকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয় না। কিন্তু কাজ পেয়ে নিজে না করে অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে বই ছাপানো, সিট মেশিনের পরিবর্তে ওয়েব মেশিনে বই ছাপানোর মতো গুরুতর অপরাধ যারা করে সেসব প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়। প্রতি বছরের মতো এবারও তাই হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতি বছর প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় ৩৫ কোটি বই ছাপায় সরকার। বইয়ের মান ঠিক রাখতে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের পৃথক মনিটরিং এজেন্সি নিয়োগ দেয় এনসিটিবি ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। দুটি এজেন্সির পেছনে সরকারের ব্যয় হয় প্রায় দুই কোটি টাকা। কিন্তু গত দু`বছর ধরে কাজ পাওয়া দুটি প্রতিষ্ঠান প্রেসে মনিটরিং করার পরিবর্তে প্রেস মালিকদের সঙ্গে এক ধরনের আঁতাঁত করে উৎকোচ নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। এতে নিম্নমানের কাগজের ছাড়পত্র, অন্য প্রতিষ্ঠানে ছাপানো বইয়ের ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। নিম্নমানের এসব কাগজ মাঠ পর্যায়ে যাওয়ার পর মান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে শেষ পর্যন্ত কিছু করার থাকে না। বিষয়টি এনসিটিবির নজরে আসার পর আগামী শিক্ষাবর্ষে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া হবে বলে জানা গেছে।
১০টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রাজধানীর সূত্রাপুরে সেতু অফসেট প্রেস, নিউ নাহার প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স এবং মা-বাবা প্রিন্টার্সের অপরাধের মাত্রা বেশি হওয়ায় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সর্বোচ্চ জরিমানা করে এনসিটিবির স্থায়ীভাবে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং জমা দেওয়া পারফরমেন্স সিকিউরিটি কাটার সিদ্ধান্ত হয়। প্রায় একই অপরাধে ঠাকুরগাঁওয়ের মোলস্না ইন্টারন্যাশল প্রিন্টিং প্রেসকে সর্বোচ্চ জরিমানা কর্তন করে এনসিটিবির সব দরপত্রে ১ বছরের জন্য কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
এছাড়াও রাজধানীর মাতুইয়ালে ফাইভ স্টার, সূত্রাপুরে অয়ন প্রিন্টার্স এবং রাইয়্যান প্রিন্টার্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ গুরুতর হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট ক্রয় আইনে ফৌজদারি মামলা করা হয়েছে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এ তিন প্রতিষ্ঠান এনসিটিবির কোনো কাজে অংশ নিতে পারবে না। ডেমরায় অবস্থিত ভাই ভাই প্রিন্টার্স, সূত্রাপুরের নূরুল ইসলাম প্রিন্টিং এবং বাংলাবাজারের আমাজান প্রিন্টিং প্রেস সিট মেশিনের পরিবর্তে ওয়েব মেশিনে বই ছাপানোর কাজ হাতেনাতে ধরা পড়ার পর ভাই ভাইয়ের ২৬ হাজার ৯২০টি এবং নুরুল ইসলামের ৫০ হাজার বই কেটে দেওয়া হয়। পরে বাতিল হওয়া বই সিট মেশিনে ছেপে উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছানোর পর তাদের সর্বোচ্চ সর্তক করে ৩০০ টাকার নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্পে মুচলেকা দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়। একই অপরাধে আমাজান প্রিন্টিং ভবিষ্যতে এ ধরনের কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকবে মর্মে ৩০০ টাকার নন-জুডিশিয়াল স্টাম্পে মুচলেকা দিয়েছে। উৎপাদন কমিটির সভায় ঊর্ধ্বতন ভান্ডার কর্মকর্তাকে স্থায়ী উৎপাদন কমিটির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
এনসিটিবির উৎপাদক শাখার কর্মকর্তারা জানান, সঠিক সময়ে বই সরবরাহ না করলে পিপিআরে শাস্তির সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। দরপত্রের শর্তভঙ্গ করলে প্রথমে জরিমানা। ২৮ দিন পার হয়ে গেলে দরপত্রের ১০ শতাংশ জরিমানা। তারপরও ব্যর্থ হলে দরপত্রের পারফরম্যান্স সিকিউরিটির নগদায়ন (বাজেয়াপ্ত) করার বিধান রয়েছে। বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নির্ধারিত সময়ে বই সরবরাহ না করার দায়িত্ব এনসিটিবির কর্মকর্তারা এড়াতে পারেন না। শুধু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নয়, এনসিটিবির কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত। তাদের প্রতিটি প্রেসে প্রতিদিন মনিটরিং করার কথা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রেসে অবস্থান করে বই ছাপা নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের জন্য বছরে বাড়তি চারটি বোনাস দেওয়া হয় তাদের। এছাড়া প্রতি বছর দরপত্রের এক থেকে দেড় কোটি টাকা ভাগবাটোয়ার করে নেন এনসিটিবির কর্মকর্তারা।
Discussion about this post