অধ্যক্ষ মো. আবুল বাশার হাওলাদার
বিশ্বব্যাপী স্মরণকালের ভয়াবহ মহাদুর্যোগে মানুষ সংকটময় সময় অতিক্রম করছেন। সব শ্রেণি-পেশার মানুষ জীবন-জীবিকার তাগিদে এখন দিশেহারা। সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতির মুখোমুখিদের অন্যতম শিক্ষক সমাজ, বিশেষ করে বাংলাদেশের বেসরকারি শিক্ষকরা।
আমরা জানি, বেসরকারি শিক্ষকরা সামান্য বেতনে চাকরি করেন; বেতনের একটি অংশ সরকার থেকে পান এবং বাকি অংশ প্রতিষ্ঠান থেকে দেয়া হয়। শিক্ষকরা এই সামান্য বেতনের টাকায় কোনোমতে সংসার নির্বাহ করেন। যখন কোনো বিশেষ প্রয়োজন হয় যেমন পরিবারের কারো অসুস্থতা, বিয়ে-সাদী বা অন্য কারণে বাড়তি টাকার প্রয়োজন হয় তখন ব্যাংক বা অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। কনজ্যুমার, পারসোনাল লোনসহ নানা নামে এই ঋণ নিয়ে থাকেন শিক্ষকরা। এমনকি চড়া সুদের ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমেও ঋণ নিয়ে থাকেন। অনেক কষ্ট করে এই ঋণের টাকা পরিশোধ করেন মাসে মাসে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। কোভিড ১৯ এর মহাপ্রলয়ে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বেতন পাচ্ছেন না। অভ্যন্তরীণ কোচিংসহ নানা উৎস থেকে আয় বন্ধ হয়ে গেছে। এমপিওবিহীন শিক্ষকদের অবস্থা আরো খারাপ। এমতাবস্থায় বাড়িভাড়া, সাংসারিক ভরণপোষণ ও ঋণের কিস্তি চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। যদিও ঋণের কিস্তি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত না দিলেও চলবে। তবে এই ঋণের টাকা চক্রবৃদ্ধি সুদ, সরল সুদ-সহ নানা রকম হিডেন চার্জ, লেট ফাইন নিয়ে বিশাল অঙ্কের টাকা শিক্ষকদের ঘাড়ে জমা হবে। এই টাকা এই পরিস্থিতিতে পরিশোধ করা সম্ভব হবে না। কখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে তা-ও সঠিক বলা যাচ্ছে না। আর্থিক টানাপোড়েন দীর্ঘ মেয়াদী হচ্ছে। এই ঘাটতি পূরণ করা তো সম্ভব হচ্ছেই না বরঞ্চ স্বাভাবিক জীবন চালিয়ে যাওয়া দুরূহ হয়ে পড়েছে।
এই ঋণের টাকা শিক্ষকরা পরিশোধ করতে পারবেন না। পরিস্থিতি এমনই হয়েছে, ধারদেনা করে কোনোমতে চলছে জীবন-জীবিকা। যখন ব্যাংক ঋণ আদায়ের হিড়িক পড়বে, ফোনে বকাবকি শুরু হয়ে যাবে, কালেকশন টিম বাড়ির দরজায় কড়া নাড়বে ঔপনিবেশিক কায়দায় টাকা আদায় করতে, এমনকি মামলা করে পুলিশি হয়রানি শুরু হয়ে যাবে নিরীহ শিক্ষকদের ওপর, তখন শিক্ষকরা অসহায়ত্ব বরণ করে মহাসংকটের মুখে আর একটি মহাদুর্যোগ প্রত্যক্ষ করবেন। জেলজুলুম শুরু হয়ে যাবে। যদিও হাজার কোটি টাকা ঋণখেলাপী রাঘব বোয়ালদের কাছেও যাবে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
শিক্ষকরা দেশ গড়ার কারিগর, এটা সর্বজনবিদিত। তাদের আর্থিক অসচ্ছলতার কথাও সবাই জানেন। বিশ্বব্যাপী এমন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি হবে বা হতে পারে কেউ স্বপ্নেও ভাবেননি। তাই চরম মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি অসহায় ঋণগ্রস্ত শিক্ষকদের সবধরনের ঋণ মওকুফ করে এই মহাবিপদ থেকে রক্ষা করতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সবিনয় আবেদন করছি। এমন ঋণ মওকুফের দৃষ্টান্ত এর আগেও ঘটেছে। তখন এত কঠিন অবস্থা ছিল না। তাই বর্তমান শিক্ষকবান্ধব সরকার অবশ্যই মানবিক বিবেচনায় ঋণগ্রস্ত শিক্ষকদের ঋণের বোঝা থেকে মুক্তি দেবেন, শিক্ষকদের এমনটাই প্রত্যাশা। তাই সব ব্যাংক, অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান, এনজিও ও ক্রেডিট কার্ড-সহ যেকোনো প্রকার ঋণ মওকুফ করার দাবি করছি। এটা হলে শিক্ষকরা মহাসংকট থেকে মুক্তি পাবেন এবং শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় নিজেদের স্বাচ্ছন্দ্যে নিয়োজিত রাখতে পারবেন।
লেখক : অধ্যক্ষ মো. আবুল বাশার হাওলাদার, সভাপতি, বাংলাদেশ শিক্ষক ইউনিয়ন।
Discussion about this post