সুধাময় সরকার
এন্ড্রু কিশোর আর নেই- রবিবার (৫ জুলাই) বিকাল নাগাদ এই বলে যখন সোশ্যাল মিডিয়ায় মাতম উঠেছিল, ঠিক সেই সময়টাতে নিজ বিছানায় নীল বেদনায় ছটফট করছিলেন প্লে-ব্যাকের এই প্রবাদ পুরুষ। তার এই বেদনা যতোটা না দম ধরে রাখার, ততোধিক অভিমানের।
কারণ, রাজধানী থেকে কয়েকশ মাইল দূরে রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোনের বাসা থেকে এন্ড্রু কিশোর শুনছিলেন তার নিজেরই মৃত্যুর খবর! যে খবরটির জন্য তিনি মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে কদিন আগেই দেশে ফিরেছেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতাল থেকে। করোনাকাল, তাই সকল ফ্লাইট বন্ধ। ক্যানসার যন্ত্রণার কাতরতা ভুলে তবুও তিনি বার বার সহধর্মিণী ও চিকিৎসকদের বলছিলেন, ‘দেশে যাবো। ব্যবস্থা করো। যেভাবেই হোক। আমি আমার জন্মগ্রামে যাবো। আমি আমার দেশেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলতে চাই। বিদেশে নয়।’
মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে তিনি দেশে ফিরেছেন, গেছেন নিজের জন্মশহরে। সবটাই করেছেন খুব নীরবে, নিজ সিদ্ধান্তে। হানিফ সংকেত, কুমার বিশ্বজিৎ- চার দশকের অধিক সময়ের এমন সহযোদ্ধাদের সঙ্গে শেয়ার করে রেখেছেন নিজের দুঃখ-সুখের গল্পগুলো। এ যেন মৃত্যুকে বরণ করে নেওয়ার সকল আয়োজন করে রেখেছেন নিজ হাতে।
অথচ সেই কিংবদন্তির গায়েবী মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেল অন্তর্জালে, রবিবার বিকালে! ঠিক সূর্যটা ডুবে যাওয়ার আগে আগে স্ত্রীর সাহায্য নিয়ে নিজেই জানালেন ফেসবুক পেজে, ‘বর্তমানে আমার সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত খবর বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রচার করছে। ভুল সংবাদ বিশ্বাস করবেন না। আমি এখন আমার পরিবারের সাথে সময় কাটাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করবেন।’
এমন ঘটনা এই শহরে এবারই প্রথম ঘটলো, তেমনটা নয়। বরং এমন সংস্কৃতি এই মিডিয়ায় বেশ পুরনো। যার প্রমাণ বহুবার মিলেছে আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, বারী সিদ্দিকী আর এটিএম শামসুজ্জামানের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের বেলায়। এরমধ্যে এমন গুজবের সর্বোচ্চ শিকার হয়েছেন অভিনেতা এটিএম। যিনি এখনও বেঁচে আছেন, ভালো আছেন।
বলে রাখা দরকার, এন্ড্রু কিশোর বরাবরই ছিলেন সোশ্যাল মিডিয়া এড়িয়ে চলা মানুষ। তার নামে অসংখ্য প্রোফাইল ও পেজ রয়েছে ফেসবুকে। কিন্তু তার ৯৯ ভাগই কে চালায়, কেউ নিশ্চিত নন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে চিকিৎসার স্বার্থে লম্বা সময় বিদেশে অবস্থানের কারণে স্ত্রী ইতি কিশোরের সুবাদে একটি পেইজ খুলেছেন তিনি। সেখানেই রবিবার সন্ধ্যায় নিজের মৃত্যু সংবাদের প্রতিবাদ জানালেন এই ক্যানসার যোদ্ধা।
এটুকু নিশ্চিত, এন্ড্রু কিশোর ভালো নেই। ক্রমশ যাচ্ছেন অবনতির দিকে। রয়েছেন চিকিৎসক বোনের বাসায়। সেই বিষয়টি নয়, বরং সিঙ্গাপুর থেকে মৃত্যু পরোয়ানা বুকে বেঁধে একজন এন্ড্রু কিশোরের ফিরে আসার দৃশ্যপটগুলোই সবার সামনে তুলে ধরলেন ইতি কিশোর।
তার লেখাটি বেদনার যেমন, আবেগেরও। হুবহু তুলে ধরা হলো লেখাটি-
অনেকেই ভাবছেন এটা আসল না নকল। আসল যারা ভেবেছেন তাদের জন্য শুভকামনা। প্রথম যে পোস্ট দুইটা দেওয়া হয়েছে সেটা এন্ড্রু কিশোরের কথা। আমি শুধুমাত্র লিখেছি। আমি কিশোরের বউ। এখন আমি কিছু বলবো।
গত বছর, ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯, আমরা সিঙ্গাপুর গিয়েছিলাম। সেখানে কিশোরের ক্যানসার ধরা পড়ে (Diffuse Large B Cell Lymphoma)। তারপর কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি শেষ হয় এপ্রিল মাসে। ডাক্তার বলেন এখন আর কোনও কিছুর দরকার নেই। ঔষধ দিয়ে বলেন, আগস্ট মাসে আসতে। আমরা ১৩ মে দেশে আসার জন্য টিকিট কাটি, কিন্তু কিশোর ভয় পায়। কারণ সে শারীরিক ভাবে খুব দুর্বল ছিল। আমি টিকিট বাতিল করি। ডাক্তার বলেন, এটা কেমোর জন্য, আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে, সময় লাগবে।
পরে ১০ জুনের টিকিট কাটি, কিন্তু হঠাৎ ২ জুন কিশোরের হালকা জ্বর আসে, ৩ জুন রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। ৪ জুন হাসপাতালে ভর্তি করেন ডাক্তার। কিন্তু জ্বর বার বার আসতে থাকে। কোনও ঔষধে তার শরীরে কাজ করছিল না। হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন, পিইটি স্ক্যান করতে হবে, লিম্ফোমা আবার ব্যাক করেছে কিনা দেখতে হবে। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, মনে মনে শুধু ঈশ্বরকে ডেকেছি। কারণ শুরুতে ডাক্তার বলেছিলেন, লিম্ফোমা (Lymphoma) যদি একবারে নির্মূল না হয়, যদি ব্যাক করে, তাহলে সেটা দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে আসে। আর খুব দ্রুত ছড়ায়। এবং সেটা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
৯ জুন পিইটি স্ক্যান হয় এবং সেদিন রাতে ডাক্তার আমাকে ফোন করে বলেন যে, পরদিন মানে ১০ জুন সকাল ১০ টায় আমার সাথে পিইটি স্ক্যান রিপোর্ট নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চান। ৯ জুন রাতটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর রাত। আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি, সকালে ১০টার আগে হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকি কিশোরের পাশে।
কিশোর আমাকে বললো, ‘ডাক্তারকে বলবা, হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দিতে, আমরা দেশে ফিরবো।’ আমি ভয়ে চুপ করে বসে আছি, শুধু বললাম দেখি ডাক্তার লিম কী বলে। কিছুক্ষণ পরে একজন নার্স এসে আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে গেল, বললো ডাক্তার ডাকছে। লিম আমার সামনে এসে একটাই কথা বললো, ‘লিম্ফোমা ব্যাক করেছে।’ আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, কোনও কথা বলতে পারছিলাম না, বুঝলাম সব শেষ। ডাক্তার বললেন, ‘এন্ড্রুকে বলবো?’ আমি বললাম, ‘বলতে তো হবে।’ ডাক্তার আমাকে কম্পিউটার স্ক্রিনের সামনে নিয়ে গেলেন এবং দেখালেন। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থিতে কিছু নাই কিন্তু লিম্ফোমা ভাইরাস ডান দিকের লিভার এবং স্পাইনালে ছড়িয়ে গিয়েছে। শরীরের বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প আছে। আমি কোনও কথা বলতে পারছিলাম না। চোখের জল ঠেকাতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে ডাক্তারকে বললাম, ‘হোয়াট নেক্সট?’ ডাক্তার বললেন, ‘আই অ্যাম স্যরি, আমার আর কিছুই করার নাই।’ আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি, চোখ দিয়ে অঝোরে জল পড়ে যাচ্ছে।
নিজেকে এত অসহায় লাগছিল যে, কী করবো বুঝতে পারছিলাম না। কিশোর বুঝতে পেরেছিল, আমাকে ডাকতে থাকে।
ডাক্তার কিশোরকে বলে লিম্ফোমা ব্যাক করেছে। কিশোর ডাক্তারকে বলে, ‘তুমি আজই আমাকে রিলিজ করো। আমি আমার দেশে মরতে চাই, এখানে না। আমি কালই দেশে ফিরবো।’ আমাকে বলে, ‘আমি তো মেনে নিয়েছি, সব ঈশ্বরের ইচ্ছা। আমি তো কাঁদছি না, তুমি কাঁদছ কেন?’ কিশোর খুব স্বাভাবিক ছিল, মানসিকভাবে আগে থেকে প্রস্তুত ছিল, যেদিন থেকে জ্বর এসেছিল সেদিন থেকে। কিশোর তখনই বাংলাদেশ হাই কমিশনে ফোন করে বলে, ‘কালই আমার ফেরার ফ্লাইট ঠিক করে দেন। আমি মরে গেলে আপনাদের বেশি ঝামেলা হবে, জীবিত অবস্থায় পাঠাতে সহজ হবে।’
১০ জুন বিকালে হাসপাতাল থেকে ফিরি এবং ১১ জুন রাতে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে দেশে ফিরে আসি আমরা।
ঈশ্বরের কী খেলা, ১০ জুন আমরা সম্পূর্ণ পজেটিভ রেজাল্ট নিয়ে ফিরতে চেয়েছিলাম দেশে। অথচ ১১ জুন ফিরলাম পুরো নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে। আমি ডাক্তারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম আর কতোদিন বাঁচবে। সে আমাকে এটা লিখেছিল “It’s difficult to predict but typically in terms of months rather than years”।
এখন কিশোর কোনও কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কী ভাব?
ও বলে, ‘কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে। আর ঈশ্বরকে বলি, আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিয়ো না।’
ক্যানসারের লাস্ট স্টেজে খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।
আমার মনে হলো, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ। তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত-স্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।
এটাই আমার শেষ পোস্ট। এরপর আর কিছু বলা বা লেখার মতো আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না, অথচ আমি থাকবো। মেনে নিতে পারছি না।
এই অসময়ে, সবাই সাবধানে থাকবেন, নিজের প্রতি যত্ন নেবেন। সুস্থ থাকবেন, ভালো থাকবেন আর কিশোরের প্রতি ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টি রাখবেন। ওর জন্য প্রাণখুলে দোয়া করবেন। বিদায়।
তারও ৫দিন আগে ১ জুলাই এন্ড্রু কিশোর ফেসবুক পেজে একটি পোস্ট দেন। যেখানে তিনি তুলে ধরেন সোশ্যাল মিডিয়ায় তার থাকা না থাকা প্রসঙ্গে। সেটি হলো এমন-
পরদিন আরেকটি পোস্টে নিজের জীবনের অসাধারণ একটি গানের দুটি চরণ তুলে ধরে তিনি লেখেন, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে, রইবো না আর বেশি দিন তোদের মাঝারে। আমি আমার প্রিয় ভক্ত-শ্রোতাদের অনুরোধ করছি- আমার গান ভালোবেসে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আমার গাওয়া গানকে স্বাভাবিক ও সাবলীল রেখে এবং বিকৃত না করে যত্ন করে রাখবেন।’
এদিকে পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, এন্ড্রু কিশোর-ইতি দম্পতির দুই সন্তান। দুজনই অস্ট্রেলিয়া থাকেন। মেয়ে মিনিম এন্ড্রু সংজ্ঞা সিডনিতে গ্রাফিক ডিজাইন এবং ছেলে জে এন্ড্রু সপ্তক মেলবোর্নে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ে পড়াশোনা করছেন। দুজনই দুই এক দিনের মধ্যে দেশে ফেরার চেষ্টা করছেন।
এন্ড্রু কিশোর বাংলা চলচ্চিত্রের সর্বাধিক ১৫ হাজার গান গাওয়া শিল্পী। চলচ্চিত্রে তার চেয়ে বেশি জনপ্রিয় গান আর কারও নেই। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’, ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’, ‘পড়ে না চোখের পলক’, ‘পদ্মপাতার পানি’, ‘ওগো বিদেশিনী’, ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’, ‘আমি চিরকাল প্রেমের কাঙাল’ প্রভৃতি।
বাংলা চলচ্চিত্রের গানে অবদান রাখার জন্য তিনি কয়েকবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।
Discussion about this post