বিনোদনডেস্ক
খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছানোর পরও কখনও অহংকার স্পর্শ করতে পারেনি রাজশাহীর ছেলে এন্ড্রু কিশোরকে। গানের জন্য জন্মস্থান ছেড়ে রাজধানী ঢাকায় গিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তিনি ভুলে যাননি শেকড়ের কথা।
নাড়ির টানে সময় পেলেই রাজশাহীতে ছুটে আসতেন এন্ড্রু কিশোর। তার জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল- এই রাজশাহীর মাটিতেই যেন তাকে সমাহিত করা হয়। আর এন্ড্রুর শেষ ইচ্ছার প্রতি সম্মান জানিয়ে তা পূরণও হতে চলেছে।
সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১৫ জুলাই বিকেলে তাকে (এন্ড্রু কিশোরকে) সমাহিত করা হবে রাজশাহী সার্কিট হাউজের সামনে চার্চ অব বাংলাদেশের খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সিমেট্রিতে (কবরস্থানে)।
সংগীতাঙ্গনের উজ্জ্বল নক্ষত্র এন্ড্রু কিশোর চলে গেছেন না ফেরার দেশে, এ কথা যেন এখনও অনেকের কাছে দুঃস্বপ্ন। সবাইকে কাঁদিয়ে গত ৬ জুলাই সন্ধ্যায় এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে বিদায় নিয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। তিনি ছিলেন বাংলা গানের ‘ঐশ্বর্য’। যার খ্যাতির চাইতে কণ্ঠের দ্যুতিই ছিল বেশি।
বিংশ শতাব্দীর শেষ দুই দশক থেকে সংগীতের বলয়ে যার জাদুকরি কণ্ঠ দর্শক-শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখে, যার অব্যাহত ধারা একবিংশতেও সমান বহমান ছিল। সেই শৈল্পিক সুরেলা কণ্ঠ আজ চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেছে। প্রায় তিন প্রজন্মের জনপ্রিয় এই কিংবদন্তি শিল্পীর কী অভিমান ছিল, তা কারো জানা নেই! তবে তিনি হয়তো তার অগণিত শ্রোতা ও ভক্ত অনুরাগীর কাছে সে কষ্ট ইচ্ছে করেই জানাননি।
এমনকি ক্যান্সার আক্রান্ত হাওয়া পর তার রুগ্ন শরীরটাকেও কারও সামনে প্রকাশ করতে চাননি। রাজশাহী আসার পর সবাইকে তার সঙ্গে দেখা না করতে অনুরোধ জানান।
উপমহাদেশের এই গুণী শিল্পীর শেষ ইচ্ছাতেই তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। আবাসভূমি রাজশাহীতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। মাটি আর মানুষের অবিস্মরণীয় এই সন্ধিই হয়তো তার কণ্ঠকে শৈল্পিক সাবলীলতায় অনুপম করে তুলেছিল। একজন এন্ড্রু কিশোর হয়ে উঠেছিলেন ‘প্লেব্যাক সম্রাট’।
এরপরও এন্ড্রু কিশোর সময় পেলেই রাজশাহীতে ছুটে যেতেন। বিশেষ করে ২০১১ সাল থেকে প্রতি তিন মাস অন্তর একবার যেতেনই। ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর শিষ্য ছিলেন তিনি। তাই রাজশাহীতে ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এন্ড্রু।
নিজেই ছিলেন সেই সংগঠনের সভাপতি। তার উদ্যোগেই নিয়মিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো সেখানে। যতই ব্যস্ততা থাক আর যেখানেই থাকুন না কেন সেই অনুষ্ঠানে হাজির হতে তিনি রাজশাহীতে ছুটে যেতেনই। ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর সুরবানী সংগীত বিদ্যালয়ের ছাত্র কখনও ওস্তাদকে ভুলে যাননি।
সে সময়ে একই ওস্তাদের শিষ্য ছিলেন- সুরকার ও সংগীত পরিচালক ইথুন বাবু, রিজিয়া পারভীন, এম এ খালেক, ইফফাত আরা নার্গিস, রফিকুল আলম ও আরও অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। মৃত্যুর আগে বলা যায় একরকম ওসিয়ত করেই তিনি এই সংগঠনের ভার দিয়ে গেছেন বাল্যবন্ধু রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাসের ওপরে। এখন ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’র পরবর্তী সভাপতি তিনিই।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক কণ্ঠশিল্পী মঈনুল ইসলাম জানান, সব কিছুই আগের মত আছে। কেবল এন্ড্রু কিশোর নেই! তার জন্য সবকিছুই যেন কাঁদছে! মৃত্যুর আগে এন্ড্রু তার সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব হস্তান্তর করে গেছেন। এন্ড্রু কিশোরের বাল্যবন্ধু রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাস এখন ‘ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চু স্মৃতি সংসদ’র পরবর্তী সভাপতি।
মঈনুল ইসলাম আরও জানান, রাজশাহীতে এ সংগঠন তৈরির পর ত্রৈমাসিক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করা হতো। পরিকল্পনা অনুযায়ী একেকটি অনুষ্ঠানে রাজশাহীর প্রত্যন্ত এলাকার একটি দলকে আমন্ত্রণ জানানো হতো। প্রতিটি অনুষ্ঠানে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব উপস্থিত থাকতেন। গান শুরুর আগে ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর জীবনের ওপর আলোচনা হতো।
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাস বলেন, ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর সুরবাণী সংগীত বিদ্যালয়ের এর ছাত্র ছিলাম আমরা দুজনই। সেখানে আমি হাওয়াইন গিটারের ছাত্র ছিলাম। যেহেতু বয়স কাছাকাছি ছিল, তাই তখন থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব। তাছাড়া পরে রাজশাহী সিটি কলেজের বাণিজ্য বিভাগে ভর্তির পর দুজনের মধ্যে সখ্যতা আরও গভীর হয়।
ড. দ্বীপকেন্দ্রনাথ দাস বলেন, সেখান থেকেই আমাদের পথচলা। তার সঙ্গে ‘তুই-তুকারি’ সম্পর্কই ছিল। কিন্তু যখন আমি শিক্ষকতায় আসি, তখন কিন্তু কিছুদিন পর সে আর আমাকে নাম ধরে ডাকতো না। বলতো, স্যার কেমন আছো? তখন ‘তুমি’ হয়ে গেলাম। পরে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কিরে, তুই আমাদের সম্পর্কে দূরত্ব সৃষ্টি করে দিলি? সে বললো, ‘না, দূরত্ব নয়। তুমি একজন প্রফেসর মানুষ, তোমার তো সমাজে একটা মূল্যায়ন আছে। আমরা যদি তোমাকে সম্মান না দেই তাহলে অন্যরা কীভাবে সম্মান দেবে?’ এই যে একটা ব্যাপার, এই জিনিসটা আমার এখন খুব মনে পড়ছে!
এন্ড্রু কিশোর সঙ্গীত জগতে এতো উচ্চতায় উঠেও নিরহংকারী ছিলেন উল্লেখ করে ড. দ্বীপকেন্দ্র নাথ বলেন, সব থেকে বড় কথা হচ্ছে, আমরা অনেক সময় দেখি, কেউ একজন বড় শিল্পী হয়ে গেলে তার মধ্যে একটা ‘অহংবোধ’ চলে আসে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতে চায় না। কিন্তু এই দিকটা আমার বন্ধু কিশোরের মধ্যে ছিল না। সে আমার সঙ্গে ক্যাম্পাসে গিয়ে রিকশাওয়ালার সাথেও ছবি তুলেছে। মানুষের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধাবোধ ছিল। জীবনের অন্তিম সময়েও বলে গেছে ‘ভালো থেকো, সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো।’ এন্ড্রুর যে শূন্যতা সৃষ্টি হলো, তা আর পূরণ হওয়ার নয়।
Discussion about this post