মুহাম্মদ সাইদুজ্জামান আহাদ
সুপারহিরোরা কি সবসময় কস্টিউম পরেই চলাফেরা করেন? নাহ, বাস্তব জীবনে কখনও কখনও এমন সব সুপারহিরোর দেখা মেলে, যারা নিজেদের কর্মের গুণে চারপাশ উদ্ভাসিত করেন। অথচ তারাও সাধারণ মানুষ, অতি সাধারণ তাদের জীবন যাপন। তারাও নয়টা-পাঁচটা অফিস করেন। সরকারী চাকুরী করেন, বেতনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাজার করতে গিয়ে মাছ বিক্রেতার সঙ্গে দামাদামি করেন। এই মানুষগুলোর বুকভর্তি সাহস, রক্তের গ্রুপ যাই হোক, এইচ পজিটিভ নামের আলাদা একটা রক্তস্রোত এদের ধমনীতে বহমান থাকে সর্বক্ষণ। এরা অন্যায় মেনে নিতে জানেন না, অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করতে জানেন না। এই মানুষগুলোর কীর্তির কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে, চোখের সামনে ওদের দেখলে একটাবার ছুঁয়ে দেয়ার খুব ইচ্ছে হয়। আজ এমনই একজন সাহসী মানুষের গল্প শোনাবো।
মানুষটা ছোটখাটো, কিন্ত সাহসের অন্ত নেই তার। প্রজাতন্ত্রের সামান্য কর্মচারী হয়ে তিনি আটকে দেন প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের মালিকানাধীন লঞ্চ! চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে তিনি নদী দূষণকারী আর ভূমি দখলকারীদের কাছে ত্রাসে পরিণত হন, যে কাজ বছরের পর বছর ধরে কোন ম্যাজিস্ট্রেট, কোন পুলিশ করতে পারেনি, সেটাই তিনি কয়েক ঘন্টায় করে ফেলেন! দীর্ঘদিন ধরে লোকসান গুনতে থাকা মিল্কভিটা আর ডিপিডিসি’র মতো সরকারী প্রতিষ্ঠানকে লাভের মুখ দেখানোর মতো অসম্ভব কাজও করে ফেলেন তিনি। মানুষটার নাম মুনীর চৌধুরী, বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশনের মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি।
মুনীর চৌধুরী প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে সরকারী চাকুরী শুরু করেন ১৯৯২ সালে। তিনি প্রথম পত্র-পত্রিকায় আর চায়ের টেবিলের আলোচনায় এসেছিলেন সম্ভবত আরাফাত রহমান কোকো’র মালিকানাধীন একটা লঞ্চ আটক করে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট তখন ক্ষমতায়। প্রধানমন্ত্রীর পুত্রের নামে লঞ্চের নাম, সেই লঞ্চের লাইসেন্স বাতিল করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছিলেন মেরিন ম্যাজিস্টেট হিসেবে কর্মরত থাকার সময়টায়।
এর আগে চট্টগ্রাম বন্দরে ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করেছেন কয়েক বছর, স্থানীয় প্রভাবশালীদের কাছে বিভীষিকার মতো ছিল তার নামটা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির সাজা পাওয়া সালাউদ্দীন কাদের চৌধুরী তখন সরকারদলীয় এমপি, চট্টগ্রামে ভীষণ প্রভাব প্রতিপত্তি তার। সেই সাকা চৌধুরীর জাহাজকেও মুনীর চৌধুরী আটক করেছিলেন আইন ভঙ্গের দায়ে! কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে নিয়মিত অভিযান চালাতেন তিনি, প্রায় পঞ্চাশটা ডক ইয়ার্ড আর সিমেন্ট কারখানা উচ্ছেদ করা হয়েছিল তার সময়ে, আইন ভঙ্গ করায় দুইশোর বেশি নৌযান আটক করেছিলেন তিনি। এগুলোর প্রায় সবগুলোর মালিক ছিলেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
এদের চাপেই ২০০৩ সালে তাকে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের মেরিন ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলী করা হয়। কিন্ত মুনীর চৌধুরী তো অন্য ধাতুতে গড়া মানুষ, তিনি এসব বদলীতে বদলে যাওয়ার মানুষ নন। জিয়া পরিবারের মালিকানাধীন কোকো নামের লঞ্চটাকে তিনি আটক করেন ২০০৩ সালের আগস্টে। ঈদের মৌসুম, রমজান মাসে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযান চলছে। এরমধ্যেই আইন ভঙ্গের দায়ে আটক করলেন কোকো-১ লঞ্চটাকে। লঞ্চে ঢুকতে গিয়েও বাধা পেলেন, এই লঞ্চের মালিক হাওয়া ভবন, এখানে নাকি কোন ম্যাজিস্ট্রেট ঢুকতে পারে না! সেই বাধা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন তিনি, পারমিট বাতিল করলেন লঞ্চের। সাড়া পড়ে গেল চারদিকে।
তখন তার অপসারণের দাবীতে তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিয়াসউদ্দীন মামুনের নেতৃত্বে সারাদেশে লঞ্চ মালিকেরা সপ্তাহব্যাপী ধর্মঘট পালন করেছিলেন। কিন্ত এসবসব ধর্মঘট বা হুমকিতে মুনীর চৌধুরীকে টলানো যায়নি, তার সততার ভিতটাকে নড়বড়ে করে দিতে পারেনি কেউ। দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে মাত্র আট মাসে নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বরিশাল আর ঢাকা থেকে প্রায় চার কোটি টাকা জরিমানা আর রাজস্ব আদায় করেছিলেন। কিন্ত কোকো-১ আটকের পরে চাপের কাছে নতি স্বীকার করে মন্ত্রণালয় থেকেই তাকে বদলী করে আবার চট্টগ্রাম বন্দরে পাঠানো হলো। টানা কয়েকটা বছর ধরে চট্টগ্রাম বন্দর দেখলো মুনীর চৌধুরীর অন্যরকম দুঃসাহস। সেখানকার ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে শুরু হয় তার লড়াই। বন্দরের সরকারী জায়গা দখল করে ঘরবাড়ি বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়ে বসে ছিলেন অনেক প্রভাবশালী। সেগুলো উদ্ধারে মাঠে নামলেন তিনি।
পঞ্চাশ বছর ধরে বন্দরের ১৫৪ একরেরও বেশী জায়গা বেদখল হয়ে ছিল। কারো কোন খবর ছিল না এগুলো উদ্ধার করার ব্যাপারে। এই জমিগুলোর মোট বাজারমূল্য ছিল প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। যারা এগুলো জোরপূর্বক দখল করে বসেছিল, স্থানীয় আর রাজনৈতিকভাবে তারা ছিল দারুণ প্রভাবশালী। মুনীর চৌধুরী তাদের প্রভাবের তোয়াক্কা করেননি কখনও। পুলিশ যেতে ভয় পায় এমন জায়গায় সশরীরে হাজির হয়েছেন তিনি, হাজার মানুষের সামনে কয়েকজন আনসার সদস্যকে নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন। বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দিয়েছেন দখলকৃত জমিতে নির্মিত অবৈধ স্থাপনাগুলো। ডক শ্রমিক নেতা সিরাজের দখল করে রাখা বিশাল জমি তিনি উদ্ধার করেছেন, ভেঙে দিয়েছেন আরেক শ্রমিক নেতা জাহাঙ্গীরের মাদক চোরাচালানের সাম্রাজ্য।
মাত্র কয়েক ঘন্টার অভিযানে তিনি উদ্ধার করেছিলেন চট্টগ্রামের নিউমুরিং থানায় বন্দরের মালিকানায় থাকা চৌদ্দ একর সরকারী জায়গা। দুই হাজারের বেশী ঘরবাড়ি আর দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছিল সেদিন। বারবার নোটিশ দেয়ার পরেও অবৈধ দখলদারেরা সরে যায়নি, তাই সর্বশেষ পদক্ষেপ হিসেবে কঠোর হতে বাধ্য হয়েছিলেন ম্যাজিস্ট্রেট মুনীর চৌধুরী। যে কাজটা পঞ্চাশ বছর ধরে কেউ করেনি, করার দরকারও মনে করেনি, সেই কাজটা মুনীর চৌধুরী করেছেন মাত্র কয়েকটা ঘন্টায়। সেই জায়গাটায় এখন নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল গড়ে তোলা হয়েছে। কর্ণফুলীর মোহনায় লালদিয়ার চর নামের একটা জায়গায় এরকমই বেদখল হয়ে থাকা একশো একর দখলকারী জমি তিনি উদ্ধার করেছিলেন সেবছরই। এই জায়গাটা জলদস্যুদের আখড়া ছিল, সেখানেও এখন কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মিত হয়েছে।
পুরো কর্মজীবনে মুনীর চৌধুরী যেখানেই কাজ করেছেন, সর্বোচ্চ সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের হয়ে যখন ভেজালবিরোধী অভিযানে নেমেছেন, তখন অসাধু ব্যবসায়ীদের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছেন মুনীর চৌধুরী। ২০০৯ সালে আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দূষণবিরোধী অভিযানে যোগ দেন তিনি। যে পরিবেশ আইনে তখন পর্যন্ত এক টাকাও জরিমানা আদায় হয়নি প্রায় একযুগ ধরে, সেখানে মুনীর চৌধুরী দায়িত্ব নেয়ার পরে নদী দূষণ, অবৈধভাবে ইটভাটা নির্মাণ কিংবা জলাশয় ভরাট অথবা পাহাড় কাটার মতো অপরাধের দায়ে জরিমানা আদায় করে আনেন কোটি কোটি টাকা। উদ্ধার করেছেন বেদখল হয়ে থাকা সরকারী জমিও। জরিমানা করার সময় একবারও ভাবেননি এটা কার প্রতিষ্ঠান, মালিক কে; যেখানে অনিয়ম বা অন্যায় দেখেছেন, সঙ্গে সঙ্গে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছেন।
লড়াইটা শেষ হয়নি তার। এরপরে তিনি গেলেন মিল্ক ভিটায়। সরকারী নিয়ন্ত্রণে থাকা এই দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর বিশাল অঙ্কের টাকা লোকসান দিচ্ছিল। মুনীর চৌধুরী দায়িত্ব নিয়েই সেই অচলাবস্থা ভাঙার মিশনে নামলেন। মিল্ক ভিটা থেকে তিনি যখন বিদায় নিচ্ছেন, সেটা তখন লাভজনক একটা প্রতিষ্ঠান! ২০১২-১৩ অর্থবছরে মিল্ক ভিটার মুনাফা হয়েছিল সতেরো কোটি টাকা! অথচ এই মিল্ক ভিটা থেকে তাকে সরানোর জন্যে কত ষড়যন্ত্র হয়েছে! অন্যায় প্রভাব আর অবৈধ সুবিধা নেয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার আমলে, সেকারণে একটা চক্র চেষ্টায় ছিল তাকে সরিয়ে দেয়ার। অকারণে বারবার শ্রমিক ধর্মঘট ডাকা হয়েছে, উৎপাদন কম দেখিয়ে তাকে ব্যর্থ প্রমাণের জোর চেষ্টা চলেছে। তিনি চাপের কাছে মাথা নত করেননি। মুনীর চৌধুরী দেখিয়ে দিয়েছেন, দক্ষ প্রশাসনিক ব্যাবস্থা কিভাবে একটা প্রতিষ্ঠানের চেহারাই বদলে দিতে পারে! ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যানার স্থাপন করে অফিসে সবার উপস্থিতি নিশ্চিত করেছেন শুরুতেই। দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা চাকুরী স্থায়ীকরণ আর পদোন্নতির ফাইলগুলোতে সই করে জট ছাড়িয়েছেন।
২০১৩ সালে কুচক্রীরা সফল হয়েছিল, মিল্ক ভিটা থেকে তাকে সরিয়ে নেয়া হয়েছিল ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানী(ডিপিডিসি) তে। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে; মুনীর চৌধুরী যেখানে যাবেন, সেখানে তো অন্যায় আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান করবেনই! ডিপিডিসির স্পেশাল টাস্কফোর্সের প্রধান হিসেবে ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জে প্রায় দুই কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ চুরির ঘটনা ধরতে সক্ষম হন তিনি। প্রায় ১১০০ কোটি টাকা আদায় করেছিলেন তিনি সেবার! সরকারের রাজস্ব বিভাগ এই মানুষটার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে নিঃসন্দেহে। রাষ্ট্রপতি নিজে হাজির থেকে তাকে সততার জন্যে পুরস্কৃত করেছেন। এমন দৃষ্টান্ত তো বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল!
অমিতাভ বচ্চনের শোলে সিনেমায় গব্বর সিং-এর ভয় দেখিয়ে নাকি মায়েরা বাচ্চাদের ঘুম পাড়াতেন। বলতেন, ঘুমিয়ে যাও, নইলে গব্বর চলে আসবে। দুর্নীতিবাজ অসাধু লোকজনের কাছে মুনীর চৌধুরী নামটাও এরকমই ভয়ানক ছিল, এখনও আছে। তিনি যখন চট্টগ্রামে ছিলেন, তখন তো লোকজন বলাবলি করতো, ভালো হয়ে যাও, নইলে মুনীর চৌধুরী আসবেন!
২০১৬ সাল থেকে মুনীর চৌধুরী মহাপরিচালক হিসেবে কর্মরত আছেন দুর্নীতি দমন কমিশনে। মানুষের শরীরে কলিজা থাকে, এই মানুষটার শরীরের পুরোটাই বোধহয় কলিজা দিয়ে গড়া। সেই কলিজাভর্তি শুধু সাহস আর সততার মেলা যেন। সরকারী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কতবার বাধার মুখে পড়েছেন, জীবনের ওপর হুমকি এসেছে, তাতে গা করেননি মুনীর চৌধুরী। এমপি-মন্ত্রীর ফোন এসেছে, তাতেও পাত্তা দেননি। অল্প কয়টা হাজার টাকা বেতনে সংসার ঠিকঠাক চলেও না হয়তো, তবুও ঘুষ হিসেবে আসা কোটি টাকার নোটের তোড়াগুলো ছুঁড়ে ফেলেছেন ঘৃণা আর অবহেলার সঙ্গে। মুনীর চৌধুরীরা তো সততা বিক্রি করতে শেখেননি! রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালন করে গিয়েছেন, হুমকি-ধামকি তাকে টলাতে পারেনি কখনও। পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছে তার, বারবার বদলী করা হয়েছে, সেগুলোকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ভেবেই কাজ করেছেন মুনীর চৌধুরী।
আমাদের দেশে হাজার হাজার কোটিপতি আছেন, লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত মানুষ আছেন, কিন্ত মুনীর চৌধুরীর মতো মানুষের সংখ্যা খুব কম। অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের একটা কথা আমার খুব প্রিয়- “একজন ভালো মানুষ দিয়ে কি হয়? কিছুই না। কিন্ত একশোজন ভালো মানুষ একটা সমাজ, একটা দেশ বদলে দিতে পারেন।” একজন মুনীর চৌধুরী সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে সীমিত সামর্থ্যের মধ্যে থেকে যা করেছেন, এরকম একশো জন, বা এক হাজার জন মুনীর চৌধুরী আমাদের থাকলে, এই দেশটার চেহারাই বদলে যেতো হয়তো!
Discussion about this post