আমাদের মধ্যে কমবেশি সকলেরই স্বপ্ন থাকে উন্নত কোনো দেশ থেকে নিজের গ্র্যাজুয়েশন বা পোস্টগ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করার। কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর যোগ্যতা থাকা সত্তে¡ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে বিদেশে উচ্চশিক্ষার এই স্বপ্ন অধরা থেকে যায়।বিদেশে উচ্চশিক্ষার কথা শুনলে প্রথমেই যে প্রশ্নটি আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায়, সেটি হলো কোন দেশে সাধ্যের ভেতর উচ্চশিক্ষা লাভ করা সম্ভব? তাই যে দেশগুলোতে কম খরচেই উচ্চশিক্ষা লাভ করা যায়, তা তুলে ধরা হলো।বিশ্বজুড়ে হাজারও বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজারও বিষয়ে পড়ানো হয়। অনেকেরই স্বপ্ন থাকে কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে জানার, সেটা নিয়ে পড়ার। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আসন-সংকট ও বিদেশযাত্রায় কড়াকড়ি ও মোটা অংক ব্যয়ের কথা ভেবে অনেকেরই উচ্চশিক্ষার সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দেওয়া সম্ভব হয় না। কিন্তু আসলেই কি দেশের বাইরে পড়তে যাওয়া মানে মোটা অংকের অর্থ ব্যয়? নাকি মেধাবীদের জন্য আছে আশার আলো? শিক্ষা ও অন্যান্য দিক দিয়ে যেসব দেশ উন্নত সেসব দেশে অবশ্যই সুযোগ আছে স্বল্প খরচে এমনকি বিনাম‚ল্যে পড়ার সুযোগ। আজ জানা যাক বিদেশে বিনা খরচে পড়ার সুযোগ সম্পর্কে।
১. জার্মানি
এক সময়ে বিশ্বের অন্যতম ম‚ল পরাশক্তি ছিলো দেশটি। তবে এর জৌলুস এখন কম বললে ভুল হবে। সামরিক, অর্থনৈতিক ও অন্যান্য খাতের মতো শিক্ষাখাতকেও জার্মানরা যথেষ্ট গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। সা¤প্রতিক বছরগুলোতে জার্মানে পড়তে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। এর প্রধান কারণ, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রয়েছে বিনা বেতনে পড়বার সুযোগ। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের পরেই শিক্ষার দিক দিয়ে সেরা এই ইউরোপীয় দেশটি।
সম্প‚র্ণ বিনা বেতনে না হলেও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আছে নামমাত্র টিউশন ও এডমিশন ফি’তে পড়বার সুযোগ। বছরে ৩৫০০ ডলার খরচে করে ফেলা যাবে ৪ বছরে স্নাতক কোর্স। আর সরকারী বা বেসরকারী যেকোন একটা বৃত্তি জোগাড় করতে পারলে তো কথাই নেই। জার্মানীতে থাকা খাওয়ার খরচও পেতে পারেন, উপরন্তু হাতখরচের টাকাও পাবেন। গড়পড়তা দশ থেকে বারো হাজার ডলার বার্ষিক খরচে জার্মানির যেকোন নামকরা শহরে থেকে পড়ালেখা করতে। এই দেশটিতে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টের সংখ্যা ক্রমে বেড়েই চলেছে। কারণ হিসাবে ধরা হয়, বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটিগুলোতে স্বল্প ব্যয়ে অধ্যয়নের সুযোগ। আরও একটি কারণ হলো পর্যাপ্ত পরিমাণ স্কলারশিপের সুবিধা। জার্মান সরকার তাদের বাজেটের একটি বিরাট অংশ ব্যয় করে থাকে শিক্ষার পেছনে। তাই এখানে তুলনাম‚লক কম খরচে অনেক ভালো মানের শিক্ষা লাভ করা যায়। এখানে থাকা খাওয়ার জন্য বছরে প্রায় ৯ হাজার ৫০০ থেকে ১০ হাজার ৪৮০ মার্কিন ডলার খরচ হয়।
২. ফ্রান্স
জার্মানির মতো বিদ্যার্থীদের আরেক পছন্দের দেশ ফ্রান্স। কাঠখোট্টা বিজ্ঞান কিংবা বাণিজ্যের উচ্চতর ডিগ্রির চেয়ে ফরাসিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নামডাক শিল্পকলা বিষয়ক জ্ঞানের তীর্থ হিসেবে। আর তাই বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে শিল্পী ও শিল্পসংক্রান্ত বিষয়ের শিক্ষার্থীরা পাড়ি জমায় ফ্রান্সে।
জার্মানির মতো ফ্রান্সেও টিউশন ফি নামমাত্র ও কতকক্ষেত্রে অবৈতনিক।২০১৫-১৬ সালের জরিপ অনুযায়ী ফ্রান্সে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করতে প্রতিবছর প্রায় ২০০ ইউএস ডলার, মাস্টার্সের জন্য ২৫৬ ইউএস ডলার এবং ডক্টরাল প্রোগ্রামের জন্য ৪২৫ ইউএস ডলার ব্যয় হয়ে থাকে। তবে সেক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে ফরাসী ভাষায় দক্ষতা। ফ্রেঞ্চ ভাষা জানা থাকলে যেমন সে ভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ মিলবে, তেমনি বিদেশী শিক্ষার্থীরা পেতে পারেন বিশেষ বৃত্তি। রাজধানী প্যারিস ছাড়া অন্য সব শহরে থাকা-খাওয়ার খরচ কম। বার্ষিক ৮ হাজার ডলারের মধ্যেই পড়াশুনা ছাড়াও ঘুরে দেখতে পারবেন ফ্রান্সের বহু বছরের ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোও।
৩. স্ক্যান্ডেনেভিয়ান দেশ
উত্তর প‚র্ব ইউরোপের পাঁচটি দেশ (ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড, আইসল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন) জীবনযাত্রার উন্নত মান ও অপরূপ প্রকৃতির জন্যই শুধু নয়, বিখ্যাত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্যও এসব দেশে প্রতি বছর ভিড় জমায় হাজারো মানুষ। কোপেনহেগেন, অসলো, হেলসিংকি, স্টকহোমের বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদা বর্তমানে ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
স্ক্যান্ডিনেভিয়ান প্রতিটি দেশেই সেদেশের ভাষার দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। নরওয়েতে বিশ্বমানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বল্প খরচে পড়াশোনা করা সম্ভব, সেক্ষেত্রে নরওয়েজিয়ান ভাষায় দক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ডেনমার্ক ও ফিনল্যান্ডেও বিভিন্ন বৃত্তির ব্যবস্থা রয়েছে যার মাধ্যমে বিনাম‚ল্যে পড়ালেখার পাশাপাশি থাকা-খাওয়ার সহায়তা পাওয়া যায়। তবে এসব সুবিধা স্নাতকোত্তর কিংবা পিএইচডি ডিগ্রীর জন্য দেওয়া হয়।
নরওয়েতে ব্যাচেলর, মাস্টার্স ও পিএইচডি স্তরে উচ্চশিক্ষা একদম ফ্রি। তবে ব্যাচেলর পর্যায়ে বেশিরভাগ প্রোগ্রাম স্থানীয় অর্থাৎ নরওয়েজিয়ান ভাষায় করানো হয়। এজন্য বিদেশি শিক্ষার্থীদের স্থানীয় ভাষায় দক্ষতার প্রমাণ দেখাতে হবে। তবে মাস্টার্স ও পিএইচডি স্তরের পড়াশোনা সাধারণত ইংরেজিতে হয়। স্টুডেট রেসিডেন্ট পারমিট নিয়ে নরওয়েতে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা খÐকালীন কাজ করতে পারে বিদেশি শিক্ষার্থীরা।
৪. ইতালি
সভ্যতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় রোমানদের হাতে লেখা। সেই রোমানদের দেশ ইতালি শিক্ষার জন্য বেশ জনপ্রিয়। তবে এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর টিউশন ফি তুলনাম‚লকভাবে বেশি। সেক্ষেত্রে একাডেমিক সাফল্যের সাথে বিভিন্ন যোগ্যতাকেও প্রাধান্য দিয়ে ছাত্রবৃত্তি, লোন, বেতন হ্রাসের ব্যবস্থা করে তারা। থাকা-খাওয়ার জন্য খরচটাও অন্য ইউরোপীয় দেশের তুলনায় বেশি, বছরে ১৪ হাজার ডলারের মত। রাজধানী রোম, বিখ্যাত শহর মিলান ছাড়াও আরো বেশ কিছু শহর শিক্ষার্থীদের জন্য পছন্দের জায়গা।
৫. অস্ট্রিয়া
অস্ট্রিয়ায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য শিক্ষা ব্যয় সামান্য। তবে অন্য মহাদেশের যে কেউ যেকোনো ডিগ্রীর জন্য পড়াশোনা করতে পারবে অপেক্ষাকৃত কম খরচে। ইউরোপীয়দের জন্য যেখানে সেমিস্টার ফি ৪৫০ ডলার, সেক্ষেত্রে অন্যদের জন্য ৭০০ ডলারের মতো, যা উন্নত অনেক দেশের তুলনায় কম। খোদ আইনস্টাইন যে শহরে পড়ালেখা করেছেন অস্ট্রিয়ার রাজধানী সেই ভিয়েনা বিশ্বের অন্যতম শিক্ষার্থীবান্ধব শহর বলে বিবেচিত।
৬. ভারত
এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে স্বল্প ব্যয়ে মানসম্মত শিক্ষার ব্যবস্থা বোধহয় ভারতেই। ভারতীয় সরকার থেকে বিদেশী শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ যে বৃত্তির ব্যবস্থা আছে, সেটি পড়ালেখার খরচ ছাড়াও মাসকাবারির জন্য মোটা অংকের অর্থ দেয়। এছাড়া বেসরকারী পর্যায়ের বিশশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তির ব্যবস্থা কম থাকলেও আছে ভাল ফলাফল সাপেক্ষে বেতন হ্রাসের ব্যবস্থা।তবে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ ইউরোপ কিংবা আমেরিকার তুলনায় অনেক কম। ইউরোপে যেখানে বাৎসরিক টিউশন আর একাডেমিক ফি ১০ হাজারের ঊর্ধ্বে, সেখানে ভারতে মাত্র সাত হাজার ডলার। তাছাড়া থাকা খাওয়ার খরচও অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক সস্তা।
৭. তাইওয়ান
অবাক হলেন? অবাক হলেও এটাই সত্য যে তাইওয়ান বিদেশে কম খরচে পড়াশোনা করার জন্য অন্যতম একটি দেশ। ন্যাশনাল তাইওয়ান ইউনিভার্সিটি কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি-২০০৬ তালিকায় ৬৮তম স্থান অধিকার করে। দেশটিতে লিবারেল আর্টসের যেকোনো বিষয়ে পোস্টগ্র্যাজুয়েট করতে গড়ে ৩ হাজার ১৮০ থেকে ৩ হাজার ৯০০ ইউএস ডলার লাগে। তা ছাড়া জীবনযাত্রার খরচও তুলনাম‚লকভাবে অনেক কম। প্রতিবছর আবাসনের পেছনে গড়ে ২ হাজার ৩৩০ ইউএস ডলার ব্যয় হয় এই দেশটিতে।এশিয়ার দ্বীপরাষ্ট্র তাইওয়ানও শিক্ষার দিক দিয়ে বেশ অগ্রসর। শুধু তাই নয়, বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উপরের দিকে রয়েছে দেশটির কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীবান্ধব শহরের মধ্যে শীর্ষ ২০ এর একটি তাইওয়ানের রাজধানী তাইপে।তাইওয়ানে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডির পাশাপাশি স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থঈদের জন্যেও স্বল্প খরচে পড়াশুনার ব্যবস্থা আছে। বাৎসরিক মাত্র ৩৫০০ ডলারে যেকোন বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া সম্ভব। এছাড়া তো আছেই সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নামমাত্র খরচে পড়ার সুযোগ ও বিভিন্ন বৃত্তিম‚লক ব্যবস্থা।
৮. গ্রিস
গ্রিসে সরকারী ইউনিভার্সিটিতে বিনা টিউশন ফিতে বা অল্প খরচে উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে, তবে সেটা ব্যাচেলর লেভেলে, মাস্টার্সে নয়। তবে ব্যাচেলর প্রোগ্রামের বেশিরভাগই গ্রীক ভাষায় পাঠদান দেওয়া হয়। উল্লেখ্য, ব্যাচেলর ও মাস্টার্স পর্যায়ে ইংরজিতেও উচ্চশিক্ষার সুযোগ রয়েছে। বলে রাখা ভালো, টিউশন ফি প্রোগ্রাম ও ইউনিভার্সিটির উপর নির্ভর করে, কিছু ইউনিভার্সিটি টিউশন ফি নিতেও পারে। তাই বিস্তারিত ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইট থেকে দেখে নিতে হবে।
৯ .বেলজিয়াম
বেলজিয়ামের নাম শুনে অনেকের চোখ উপরে উঠে গিয়েছে নিশ্চয়ই, ভাবছেন স্বপ্ন দেখছিনা তো। না বন্ধুরা একদম ই না, আপনি ঠিকই শুনছেন। সাধারণ নিয়মে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বেলজিয়ামে প্রতি বছর টিউশন ফি ৪১৭৫ ইউরো। কিন্তু যেসব দেশ টঘঙ’ং খবধংঃ উবাবষড়ঢ়বফ ঈড়ঁহঃৎরবং ষরংঃ এর অন্তর্ভুক্ত সেসব দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি বছরে টিউশন ফি দিতে হবে মাত্র ৯০৬.১ ইউরো (২০১৭-২০১৮ সেশনে), তবে কিছু বিষয়ে/ইউনিভার্সিটিতে এর চেয়ে বেশি হয়ে থাকে। আর ভাগ্যক্রমে আমরা এই তালিকার অন্তর্ভুক্ত।
১০. পোল্যান্ড
এর পরেই যে দেশটির নাম আসে সেটি হলো পোল্যান্ড। আপনি যদি পোলিশ ভাষায় পারদর্শী হন এবং পোলিশ ভাষায় আপনার কোর্সগুলিতে এনরোল করেন, তাহলে অন্য সকল পোলিশ শিক্ষার্থীর মতো আপনি ও সম্প‚র্ণ বিনাম‚ল্যে অধ্যায়ন করতে পারবেন। ইংরেজিতেও আপনার ডিগ্রি অর্জনের সুযোগ আছে এই দেশটিতে। সেক্ষেত্রে আপনার প্রতি বছরে প্রায় ২ হাজার ১৮৫ থেকে ৩ হাজার ২৮০ ইউএস ডলার ব্যয় হবে। তা ছাড়া এদেশের সমৃদ্ধ সাহিত্য ও সংস্কৃতি আপনাকে সব সময় আকর্ষণ করবে।
১১. মালয়েশিয়া
মালয়েশিয়া সন্দেহাতীতভাবে স্বল্প খরচে থাকা ও পড়াশোনার জন্য অন্যতম একটি জায়গা। মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুর কিউএস বেস্ট স্টুডেন্ট সিটিজ ২০১৬ অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের জন্য সবচেয়ে সাশ্রয়ী শহরের মর্যাদা লাভ করেছে। স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জন্য প্রতি বছর প্রায় ২ হাজার ৮৬০ থেকে ৪ হাজার ২৯০ ইউএস ডলার খরচ হয়। আর প্রতিবছর আপনাকে প্রায় ৪ হাজার ৫০ মার্কিন ডলার খরচ করতে হবে টিউশন ফির জন্য।
Discussion about this post