বিশেষ প্রতিবেদক
সিলেটের প্রাচীনতম মৌলভীবাজার জেলার জুড়ীতে কথিত চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিত্বের পুরাকীর্তি সম্পর্কে জানার জন্য তিন দিনের অনুসন্ধানে মৌলভীবাজারে এসেছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের স্বমন্বয়ে গঠিত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ৫ সদস্যের প্রতিনিধি দল। চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিত্বের অনুসন্ধানের প্রথম দিনে কুলাউড়ার ঐতিহাসিক ভাটেরা তাম্রফলক এলাকা পরিদর্শন করে অনুসন্ধান ও মাঠ জরিপ করে পুরাকীর্তির আলামত সংগ্রহ করেন প্রতিনিধি দল।
শনিবার বিকেল ৫টা থেকে সন্ধা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক এবং প্রতিনিধি দলের প্রধান ড. মো. আতাউর রহমানের নেতৃত্বে ওই টিম ভাটেরার রাজার টিলা এলাকায় ভাটেরা তাম্রফলক পরিদর্শন করে আলামত হিসেবে ইটের টুকরো, পাথর, পাতিল সংগ্রহ করেন।
স্থানীয়দের মতে, কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা ইউনিয়নের কলিমাবাদ (সাত বাদশার টিলা/রাজার টিলা) এলাকায় অবস্থিত ঐতিহাসিক ভাটেরা তাম্রফলকের নিদর্শনের পুরাকীর্তি অনুসন্ধান ও মাঠ জরিপ শুরু হওয়ায় স্থানীয়দের মনে অনেক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। সবাই মনে করছেন এই এলাকায় প্রাচীন রাজাদের অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। এটা খনন ও অনুসন্ধান করলে হাজার বছরের পুরনো ধ্বংসাবশেষ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থানীয় এলাকার বিভিন্ন লোকদের কাছ থেকে ওই টিলা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরিদর্শন টিমে রয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ফিল্ড অফিসার মো. শাহিন আলম, সহকারী কাস্টোডিয়ান হাফিজুর রহমান, গবেষণা সহকারী ওমর ফারুক, সার্ভেয়ার চাইথোয়াই মার্মা। ভাটেরায় অনুসন্ধান শেষ ২৬ জুলাই রবিবার জুড়ী উপজেলার সাগরনাল ও রাজনগর উপজেলায় কিছু ঐতিহাসিক স্থানে চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থিত্বের অবস্থানের বিষয়ে অনুসন্ধান ও প্রাথমিক মাঠ জরিপ পরিচালনা করা হবে বলে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে।
এর আগে গত ১৫ জুলাই ‘চন্দ্র বংশীয় রাজা শ্রীচন্দ্র কর্তৃক স্থাপিত কথিত শ্রীহট্টের চন্দ্রপুর বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি সম্পর্কে সরেজমিন জরিপ ও পরিদর্শন প্রতিবেদন প্রয়োজন’ উল্লেখ করে সিলেট অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালককে চিঠি দিয়েছেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আমিরুজ্জামান।
চিঠিতে ‘কথিত বিশ্ববিদ্যালয় ও পুরাকীর্তি অ্যান্টিকস অ্যাক্ট ১৯৬৮ অনুসারে সংরক্ষিত ঘোষণা ও সংস্কার-সংরক্ষণের কোনো সুযোগ আছে কিনা এ সম্পর্কে সরেজমিন পরিদর্শন পূর্বক আলোকচিত্র ও মতামতসহ প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
প্রতিনিধি দলের প্রধান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক ড. মো. আতাউর রহমান রাত সাড়ে ৮টায় গণমাধ্যমকর্মীদের বলেন, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তিন দিনের অনুসন্ধানের প্রথম দিনে ভাটেরা তাম্রফলক এলাকা থেকে প্রাচীন রাজাদের স্থাপনার কাজে ব্যবহৃত অনেক পুরাকীর্তির আলামত সংগ্রহ করেছি।
এই টিলাটি ব্রিটিশ আমলে সংরক্ষণ করা হয় যা এখনো কালের সাক্ষি হয়ে ঐতিহাসিক নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে প্রাচীন রাজাদের বসবাসের ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। বর্তমানে অবাধে ওই এলাকায় অবস্থিত কয়েকটি টিলা কাটার কারণে পুরাকীর্তির আলামত নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এসময় তিনি আগামী শুষ্ক মৌসুমে এই তাম্রফলক এলাকা খনন কাজ করবেন বলে জানিয়েছেন।
তিনি আরো বলেন, ১৯০৪ সালের ৭ম আইন অনুসারে সংরক্ষিত এই কীর্তির কোন অনিষ্ট বা প্রাচীন সৌন্দর্য্য নষ্ট করলে তিন মাসের জেল অথবা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। প্রাচীন এই নিদর্শন সংরক্ষণে সকলকে সচেতন হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। এবং ভাটেরা তাম্রফলকের পাশ থেকে অবাধে টিলা কাটা বন্ধ করার জন্য স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে লিখিতভাবে চিঠি দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন।
সরেজমিন স্থানীয় লোকজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামলে আসামের গভর্নর হার্ডসন উনিশ শতকে সিলেট সফরে এসে বলেছিলেন “আসামের সুন্দর জায়গা যদি নদীয়া হয়, তবে সিলেটের সুন্দর স্থান হবে ভাটেরা”। মৌলভীবাজার জেলার একটি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ জনপদের নাম ভাটেরা। পরগনা ভিত্তিক শাসনামলে ভাটেরাতে বিভিন্ন জমিদার শাসন করেছেন। ভাটেরা থেকে প্রাপ্ত তাম্রফলক থেকে ধারণা করা হয় এ এলাকায় একসময় পরপর ৭ জন রাজা শাসন করেছেন। লোকমুখে জনশ্রুতি আছে যে, রাজা ঈসান দেব ছিলেন এ রাজ্যের সর্বশেষ রাজা। এবং এই ভাটেরা তাম্রফলকের পাশে রাজা ঈসান দেবের একটি পুকুর ছিল এবং সেই পুকুরে রাজা ঈসান দেবের কন্যারা নিয়মিত গোসল করতেন।
জানা যায়, প্রাচীনকালে রাজ-রাজারা তামার পাত বা প্লেটে রাজকীয় ঘোষণা, অনুশাসন ইত্যাদি খোদাই করে রাখতেন। ভাটেরা তাম্রফলক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। ১৯১২ থেকে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দ সময়ে সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার নিধনপুরে ছয় খানা তাম্রফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো সপ্তম শতাব্দীতে উৎকীর্ণ। ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরায় (রেলপথে মাইজগাঁও কুলাউড়ার মাঝামাঝি সাত রাজার টিলায়) পাওয়া গেছে দুইখানা তাম্রফলক। এগুলো একাদশ দ্বাদশ শতাব্দীর বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন।
এসব তাম্রফলক থেকে জানা যায়, সপ্তম শতাব্দীতে সিলেট কামরুপ রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত ছিল। কামরূপের মহারাজা ভাস্কর বর্মা ছিলেন সিলেটের শাসনকর্তা। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে মৌলভীবাজার রাজনগর থানার পশ্চিমভাগ গ্রামে প্রাপ্ত দশম শতাব্দীতে উৎকৃর্ণ বিক্রমপুরের মহারাজা শ্রীচন্দ্রের তাম্রশাসনের লিপি থেকে শ্রীহট্ট মন্ডলের সীমানা জানা যায়। চীন দেশীয় পর্যটক হিউয়েন সাং ৬৪০ খ্রিস্টাব্দে ভাস্কর বর্মার আক্রমণে কামরূপ ভ্রমণ করেন। তিনি সিলেটকে ‘শিলাচটলো’ বলে উল্লেখ করেছেন। শিলাচটলো ছিল সমুদ্র তীরে। এর চারিদিকে ছিল পাহাড় ও বনভূমি। মনিপুর কাছাড়, জৈন্তা, সিলেট, ময়মনসিংহ প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে প্রায় দুই হাজার বর্গমাইল এলাকায় ওই সময় কামরূপ রাজ্য বিস্তৃত ছিল।
Discussion about this post