নিউজ ডেস্ক
ফাঁস করা প্রশ্নপত্রে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন শত শত শিক্ষার্থী। ফাঁস করা প্রশ্ন বিক্রি করে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। প্রশ্নফাঁস চক্রে জড়িত মেডিকেল কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী, নাম এসেছে শিক্ষকেরও!
গ্রেফতারের পর মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে প্রশ্নফাঁস চক্রের মূলহোতা জসিমসহ তিন আসামি রিমান্ডে। জিজ্ঞাসাবাদে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি’র কাছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে চক্রের প্রধান জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু।
সরকারি মেডিকেল, ডেন্টাল, আর্মড ফোর্স মেডিকেল কলেজের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় চক্রটির মূলহোতাসহ মোট চারজনকে গত ২০ জুলাই গ্রেফতার করে সিআইডি’র সাইবার ক্রাইম ইউনিট। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন- জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু, পারভেজ খান, জাকির হোসেন দিপু এবং সামিউল জাফর সিটু।
মূলহোতা জসিমের কাছ থেকে দুই কোটি ২৭ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র, দুই কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক এবং পারভেজের কাছ থেকে ৮৪ লাখ টাকার চেক উদ্ধার করে সিআইডি।
অভিযোগ ছিল, স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস থেকেই বারবার মেডিকেলের প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটছে। যদিও এর আগে বহুবার বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হলেও প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি রোধ করা যায়নি। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক পদ থেকে ইস্তফা দেয়া অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ প্রায়ই জোর দিয়ে বলতেন, ‘গ্যারান্টি দিচ্ছি এমবিবিএস ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁস হবে না’। তারপরও প্রশ্নফাঁস হয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে ভর্তি হয়েছেন অনেকে।
সিআইডি’র তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তদন্ত করতে গিয়ে তারা জানতে পারেন যে, মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের চেষ্টা শুরু হয় ২০১১ সাল থেকে। তবে চক্রটি প্রথম সফল হয় ২০১৩ সালে। এরপর থেকে বিগত কয়েক বছরে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে শত শত শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অধ্যয়ন করছেন। ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র পেয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী এখন তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়ন করছেন। তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের পর ভর্তি বাতিল ও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার কথাও জানিয়েছে সিআইডি।
প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িতরা
যোগাযোগ করা হলে প্রশ্নফাঁস মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির সাইবার পুলিশের অতিরিক্ত বিশেষ সুপার কামরুল আহসান জাগো নিউজকে বলেন, ২০১৩ সাল থেকে মূলত প্রশ্নফাঁসের শুরু। প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্র যে প্রতি বছরই সফল হয়েছে তা নয়। প্রশ্নফাঁস সংঘটিত হয় মূলত চারটি স্টেপে। প্রথম স্টেপে প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁস হয়। দ্বিতীয় স্টেপে চক্রের হোতাদের হাতে তা চলে যায়। এরপর তারা তাদের বিশ্বস্ত হ্যান্ডসের (সহযোগীদের) কাছে পৌঁছে দেয়। শেষ স্টেপে টাকার বিনিময়ে তা পৌঁছে যায় ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছে।
মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের প্রধান ব্যক্তি জসিম উদ্দিন। রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বিশেষ কোনো পেশা না থাকলেও ব্যবসায়ী বলে দাবি করেন। তবে বিগত ৪/৫ বছর ধরে তার মূল পেশা ছিল প্রশ্নফাঁস।
কামরুল আহসান জানান, তারা জসিমের ২৭টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টের সন্ধান পেয়েছেন। সেখানে কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে বা লেনদেন হয়েছে সেটা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা মিললে তার বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা হবে। আবেদন করা হবে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ-সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের।
এখন পর্যন্ত কত সংখ্যক শিক্ষার্থী মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তি হয়েছেন— জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘একটি গণমাধ্যমে লেখা হয়েছে চার হাজার শিক্ষার্থী, সেটা ঠিক নয়। আমাদের বিশদ তদন্ত চলছে। চক্রটি শত শত শিক্ষার্থীকে প্রশ্নফাঁসের মাধ্যমে ভর্তি করেছে। আমরা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছি। ঠিক কত সংখ্যক শিক্ষার্থী প্রশ্ন পেয়ে ভর্তি হয়েছেন, সেটা আমরা যাচাই-বাছাই করছি। শতভাগ সত্যতার ভিত্তিতে তালিকা করব এবং ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করব।’
প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বা চিকিৎসকের সংশ্লিষ্টতা আছে কি-না, জানতে চাইলে তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পাইনি। তবে আমরা বেশ কয়েকজন চিকিৎসকের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। তাদের মধ্যে কেউ কেউ বিষয়টি আন্দাজ করতে পেরে সতর্ক হয়ে গেছেন। তদন্তের স্বার্থে সংখ্যা বা তাদের নাম প্রকাশ করা যাচ্ছে না। তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে। প্রশ্নফাঁসের সময় জড়িত চিকিৎসকবৃন্দ মেডিকেল স্টুডেন্ট ছিলেন। এখন তারা শিক্ষক হয়ে গেছেন।
সিআইডির সংবাদ সম্মেলন
এ ব্যাপারে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা কামরুল আহসান বলেন, ‘এই যে প্রশ্ন ফাঁস হলো, অনেক শিক্ষার্থী প্রশ্ন পেল, ভর্তি হলো; তিন-চার বছর আগে তারা ভর্তি হন। পাশাপাশি তদন্তও চলে। ধারাবাহিক তদন্তে বিষয়টি আমরা এখন বের করতে পেরেছি। তাদের অনেককে আমরা চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছি।’
‘ফাইনালি ফাঁস হওয়া প্রশ্নে যারা ভর্তি হয়েছিলেন বলে আমরা নিশ্চিত হব, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে আমরা সেসব শিক্ষার্থীর ভর্তি বাতিলের জন্য আবেদন করব। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হচ্ছে, জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভর্তি হওয়া ওইসব শিক্ষার্থীর কোনো ক্যারিয়ার থাকবে না।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ভর্তি বাতিল করবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তবে আমরা প্রশ্নফাঁস চক্রের সঙ্গে জড়িতদের ন্যায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধেও চার্জশিট দেব। যেন আইনগতভাবে তারা শাস্তির মুখোমুখি হন। এটাই আমাদের ম্যাসেজ, যাতে আর কেউ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে বা প্রশ্ন পেলেও মেডিকেল-ডেন্টাল কলেজসহ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তির চিন্তা না করে। আমরা যাদেরই সংশ্লিষ্টতা পাব, সে যে-ই হোক, আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করব।
এর আগে সিআইডির সাইবার ক্রাইমের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার সুমন কুমার দাস বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি মেডিকেল কলেজ, ডেন্টাল কিংবা আমর্ডফোর্স মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়াটা মেধাবী শিক্ষার্থীদের একটা স্বপ্ন। কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন ব্যর্থ হয়ে যায় যখন প্রশ্নপত্র ফাঁসের মাধ্যমে কম মেধাবী শিক্ষার্থীরা ওইসব প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পান।
২০১৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর র্যাবের হাতে আটক প্রশ্নফাঁস চক্রের সদস্যরা। সিআইডির হাতে গ্রফতার জসিমও আছেন এখানে
সিআইডির এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তদন্ত শুরু করে সিআইডি। ওই মামলায় ১২৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দেয়া হয়। যার মধ্যে গ্রেফতার ছিল ৪৭ জন। তাদের মধ্যে ৪৬ জনই আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।
২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের মামলা তদন্তের সময় ২০১৮ সালে নতুন একটি চক্রের সন্ধান পায় সিআইডি। ওই মামলার তদন্তের সময় গত ১৯ জুলাই এস এম সানোয়ার হোসেন নামের একজনকে গ্রেফতার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে সানোয়ার ২০১৩, ২০১৫ ও ২০১৭ সালে মেডিকেল ও ডেন্টালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের চাঞ্চল্যকর তথ্য দেয়। তারপরই জসিম উদ্দিন ভূঁইয়া মুন্নু, পারভেজ খান, জাকির হোসেন দিপু ও সামিউল জাফর সিটুর নাম আসে এবং তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় সিআইডি— বলেন সহকারী পুলিশ সুপার সুমন কুমার দাস।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা পরবর্তীতে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছাপাখানা থেকে মেডিকেল ও ডেন্টালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র টাকার বিনিময়ে ফাঁস করত। তাদের বিরুদ্ধে মিরপুর থানায় এজাহার নামীয় ১৪ জনসহ ১৫০ থেকে ২০০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে সিআইডি।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রেস থেকেই কি প্রশ্নফাঁস হচ্ছে— এমন প্রশ্নের জবাবে সুমন কুমার দাস বলেন, বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। তবে প্রাথমিক তদন্তে আমরা জানতে পেরেছি, ১৯৮৮ সাল থেকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীনে একটি প্রেস থেকে মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়। ওই প্রেসে চাকরি করে এমন সদস্যদের পরিবারের সদস্যরা হয়তো এসব কাজে যুক্ত থাকতে পারে।
তবে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রেসের মেশিনম্যান সালাম এবং তার খালাতো ভাই জসিম মিলে দেশব্যাপী গড়ে তুলেছিলেন সক্রিয় একটি চক্র। জসিমের কাজ ছিল সারাদেশে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ছড়িয়ে দেয়া। এজন্য একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক ছিল তার। দেশব্যাপী চক্রটির প্রায় অর্ধশত সহযোগীর খোঁজ পাওয়া গেছে। রিমান্ডে থাকা তিন আসামির কাছ থেকে ৭৮ শিক্ষার্থীর দেয়া চেকের তথ্যও পাওয়া গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশ্নফাঁস চক্রের পাশাপাশি মেডিকেলের প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত এস এম সানোয়ার হোসেন ও মোহাইমিনুল। ইতোমধ্যে তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
Discussion about this post