রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালি লেখকদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি সমালোচিত এবং সবচেয়ে বেশি প্রশংসিত লেখক। জীবিতাবস্থায় রবীন্দ্রনাথ নানা তর্কের কেন্দ্রে ছিলেন, মৃত্যুর পরেও বহুবিধ সমালোচনা হয়েছে তাঁকে নিয়ে। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ পাকিস্তানের জন্য প্রয়োজনীয় নাকি অপ্রয়োজনীয়, তাঁকে রাখা হবে নাকি বর্জন করা হবে এমন বিতর্কের শেষ ছিল না। বঙ্গবন্ধু কিন্তু সব সময় রবীন্দ্রনাথকে বাঙালির জন্য অবশ্য স্মরণীয় বলে মনে করেছেন এবং তিনি তাঁর কোনো লেখায় রবীন্দ্রনাথকে ‘কবিগুরু’ ছাড়া সম্বোধন করেননি। যেমন- ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র চার জায়গায় বঙ্গবন্ধুর প্রসঙ্গ লিখেছেন। অবাক করা ব্যাপার চার জায়গাতেই আছে ‘কবিগুরু’ সম্বোধন:
* ‘কবিগুরুও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন।’
* ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দু’একটার কয়েক লাইন শুনালাম।’
* ‘কবিগুরুর কবিতার ইংরেজি তরজমা দু’একজন পড়েছেন বললেন।’
* ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ার অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি।’
‘কারাগারের রোজনামচা’য়ও রবীন্দ্রনাথের নাম উল্লেখ না করেই শুধু ‘কবিগুরু’ লিখে বঙ্গবন্ধু কবির কবিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরেছেন। বক্তৃতাতেও উল্লেখ করেছেন ‘কবিগুরু’— ‘রবীন্দ্রনাথ’ নয়। এ থেকেই বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথের জন্য কী অপরিসীম শ্রদ্ধা ছিল বঙ্গবন্ধুর মনে। তাঁর বইগুলোর মধ্যেও রবীন্দ্ররচনাবলি ছিল। যে সব বই বঙ্গবন্ধু ক্লাসিক মর্যাদায় পাঠ করতেন এবং সাধারণত অন্যত্র দান করতেন না। বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনা তাঁর ‘শেখ মুজিব আমার পিতা’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘জেলখানার বই বেশির ভাগই [বঙ্গবন্ধু] জেল লাইব্রেরিতে দান করে দিতেন কিন্তু আমার মার অনুরোধে এই বই কয়টা আব্বা কখনও দিতেন না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন। তার মধ্যে রবীন্দ্র রচনাবলি, শরৎচন্দ্র, নজরুলের রচনা, বার্নাড শ-র কয়েকটা বইতে সেন্সর করার সিল দেওয়া ছিল। জেলে কিছু পাঠালে সেন্সর করা হয়, অনুসন্ধান করা হয়, তারপর পাস হয়ে গেলে সিল মারা হয়। পরপর আব্বা কতবার জেলে গেলেন তার সিল এই বইগুলিতে ছিল। মা এই কয়টা বই খুব যত্ন করে রাখতেন।’ (হাসিনা, ২০১৫ : ৫৯) জাতির দুর্ভাগ্য, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি পাকিস্তানিরা লুট করে এবং অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে এই মূল্যবান বই ও ঐতিহাসিক দলিলপত্র নষ্ট করে ফেলে।
বঙ্গবন্ধুতনয়া শেখ হাসিনার এই উল্লেখ থেকেই বোঝা যায়, রবীন্দ্র রচনাকে কতোটা গুরুত্ব দিতেন বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার মধ্যেও রবীন্দ্রনাথের প্রতি দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়। বিশেষ করে তাঁর লেখায় এ প্রসঙ্গটি প্রকাশ পেয়েছে। শেখ হাসিনা তাঁর ‘সহে না মানবতার অবমাননা’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র-২) গ্রন্থের নামকরণে রবীন্দ্রসঙ্গীতের মিষ্টি কথাছায়ার অবলম্বন নিয়েছেন। তাঁর ‘সাদা কালো’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র-২) গ্রন্থের একটি লেখার শিরোনাম করেছেন রবীন্দ্রবচন থেকে: ‘নয়ন জলে ভাসি’; ‘সবুজ মাঠ পেরিয়ে’ (শেখ হাসিনা রচনাসমগ্র-২) গ্রন্থের দুটি লেখার শিরোনাম করেছেন একইভাবে: ‘তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ’ ও ‘কণ্ঠ আজিকে রুদ্ধ আমার’। এ সবই রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে ধারণ করা ও সম্মান জানানোরই দৃষ্টান্তমাত্র।
বঙ্গবন্ধুর জীবনে ‘প্রথম হিরো’ ছিলেন তাঁর পিতা শেখ লুৎফর রহমান। শৈশবে পিতার গলা জড়িয়ে তিনি শুধু ঘুমোতেনই না, তাঁর বই ও আনা পত্রপত্রিকাগুলো পাঠ করে নিজের মানসগঠনও করেছিলেন। পত্রিকাগুলোর নাম দেখলেই বোঝা যায়, ভারত জুড়ে চলমান সাম্প্রদায়িককালেও একটি অসাম্প্রদায়িক বাতাবরণ ছিল তাঁদের বাড়িতে। আর তাই ‘আজাদ’, ‘মোহাম্মদী’, ‘সওগাত’ যেমন রাখতেন বঙ্গবন্ধুর পিতা, তেমনি রাখতেন ‘আনন্দবাজার’, ‘বসুমতী’ও। এই অসাম্প্রদায়িকতা বঙ্গবন্ধু তরুণ বয়স থেকেই অন্তরে লালন করেছেন। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে ভারতে সাম্প্রদায়িকতা ও এ নিয়ে রাজনীতির বিষবৃক্ষ জলহাওয়া পাওয়ার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করেছেন। পাশাপাশি এও লিখেছেন, কোন কোন ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ার কাজে ব্যাপৃত ছিলেন। রাজনীতিবিদদের বাইরে লেখকদের মধ্যে তিনি এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করেছেন।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, হিন্দু জমিদার ও মহাজনেরা মুসলিম প্রজাদের ওপর অত্যাচার করতো; মুসলিম জমিদারেরাও হিন্দু প্রজাদের ওপর অত্যাচার করতো। এসময় তোষামোদ করে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের কারণে হিন্দুরা এগিয়ে যায়, ব্রিটিশবিরোধিতার জন্য মুসলিমরা পিছিয়ে পড়ে। আবার হিন্দুরা যখন ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে, তখন তারা ফাঁসিকাষ্ঠেও ঝোলে। বঙ্গবন্ধুর আক্ষেপ, ব্রিটিশ বিরোধী এই হিন্দু ও মুসলিম শক্তির ধারা দুটোকে এক করার জন্য সকলে এগিয়ে আসেননি, এলে ভারতের রাজনীতি অন্য রকমের হতো।
তিনি অবশ্য লিখেছেন, ‘হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটা বুঝেছিলেন, তাই তাঁরা অনেক সময় হিন্দুদের হুঁশিয়ার করেছিলেন। কবিগুরুও তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে হিন্দুদের সাবধান করেছেন।’ (রহমান, ২০১২ : ২৪) লেখক হিসেবে এখানে তিনি শুধু রবীন্দ্রনাথের কথা উল্লেখ করতে পেরেছিলেন। কারণ, সাম্প্রদায়িকতামুক্ত এই ধারার লেখক সত্যি সে সময় ছিলেন না। বিবৃতিটি ছোট কিন্তু এর মর্মার্থটি প্রবহমান বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী রাজনৈতিক জীবনে। শিক্ষা তিনি এখান থেকেও নিয়েছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারতের রাজনীতিতে একদিকে হিন্দুদের ব্রিটিশবিরোধিতা, অন্যদিকে মুসলিমদের ব্রিটিশবিরোধিতা মূলত সাম্প্রদায়িকতা মুক্ত ছিল না। কিন্তু অসাম্প্রদায়িকভাবে যাঁরা ব্রিটিশবিরোধিতার জন্য কাজ করেছিলেন তাঁরা সংখ্যায় কম থাকলেও সাম্প্রদায়িকদের বিরুদ্ধে তাঁরা উচ্চারণ করেছিলেন সাবধানবাণী। বঙ্গবন্ধু কিন্তু তাঁর উত্তরকালে সম্প্রীতিময় এই সমন্বিত রাজনীতিই প্রতিষ্ঠা করেন।
পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা কেন বাংলা হওয়া উচিত নয়, এ নিয়ে অনেক মিথ্যে তথ্য পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পকিস্তানের জনগণের মধ্যে ছড়িয়েছিল। বিশেষ করে, পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ হিন্দুদের ও ভারতীয়দের প্ররোচনায় বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা চাইছে এবং রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন মূলত হিন্দুদের আন্দোলন— এমন কথা পশ্চিম পাকিস্তানে বহুল প্রচারিত ও বিশ্বাসযোগ্য ছিল। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে লিখিত সমর্থন আদার জন্য হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দির কাছে গেলেন। শহিদ সোহরাওয়ার্দি তখন পশ্চিম পাকিস্তানে ‘পিন্ডি ষড়যন্ত্র’ মামলার আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের লিয়াকত আলি খান সরকারকে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রকে ‘পিন্ডি (রাওয়ালপিন্ডি) ষড়যন্ত্র’ বলা হয়। প্রচার চালানো হয় বামপন্থিরা এই ষড়যন্ত্র করেছিল। এর বিচারও হয়েছে গোপন আদালতে, হায়দ্রাবাদ জেলের ভেতরে।
সিন্ধু প্রদেশের হায়দ্রাবাদ থেকে করাচির দূরত্ব ১৪০ কিলোমিটার। হায়দ্রাবাদ থেকে করাচি যাবার জন্য এই দীর্ঘ পথ গাড়ি চালান শহিদ সোহরাওয়ার্দি। সেই গাড়িতে ছিলেন বঙ্গবন্ধুসহ পাকিস্তানি কয়েকজন আইনজীবী। পাকিস্তানি আইনজীবীরা বঙ্গবন্ধুর কাছে জানতে চান, বাংলাকে কেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করতে হবে, এটি ভারতীয় ও হিন্দুদের আন্দোলন কিনা। এর উত্তর বঙ্গবন্ধু তাঁদের দিয়েছিলেন; শহিদ সোহরাওয়ার্দিও বলেন প্রকৃত কারণ। কিন্তু এর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু যে কাজটি করেছিলেন সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, শহিদ সোহরাওয়ার্দি এর ইংরেজি অনুবাদ বলেছিলেন গাড়ি চালাতে চালাতে। দৃশ্যটি কল্পনা করা যাক: একটি জিপ গাড়ি; হোসেন শহিদ সোহরাওয়ার্দি গাড়ির চালাচ্ছেন; দ্রুত বেগে হাইওয়েতে গাড়ি চলছে; চারদিকে কয়েকজন পাকিস্তানি আইনজীবী আর তার মধ্যে বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কবিতা উচ্চকণ্ঠে আবৃত্তি করছেন; এর পর পরই ইংরেজিতে অনুবাদ করছেন সোহরাওয়ার্দি! বাংলা ও বাঙালির বিজয় কেতন তো রবীন্দ্র-নজরুলের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের মাটিতে সেদিনই ওড়ানো হয়ে গেল। পাকিস্তানি আইনজীবীগণ সে দিন অবশ্য বলেছিলেন, ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতা তাঁদের আগেই পড়া আছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই কবিদের মনোগত দিক থেকে ধারণ এবং কবিতা মুখস্থ ও আত্মস্থ না করলে তাঁর দ্বারা এভাবে পাকিস্তানি আইনজীবীদের মুগ্ধ করা সম্ভবপর হতো না। রবীন্দ্রনাথ-প্রসঙ্গে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কবিতাও দুএকটার কয়েক লাইন শুনালাম। শহীদ সাহেব তাঁদের ইংরেজি করে বুঝিয়ে দিলেন। কবিগুরুর কবিতার ইংরেজি তরজমা দুএকজন পড়েছেন বললেন।’ পাকিস্তানি আইনজীবীগণ নিশ্চয়ই সেদিন বুঝেছিলেন, বাঙালি মনীষীদের কীভাবে অন্তরে ধারণ করে আছেন বাঙালির হৃদয়ের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। (রহমান, ২০১২ : ২১৭)
পাকিস্তানের এই আইনজীবীরা রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদের মাধ্যমে আগেই যে চিনেছিলেন এটি বঙ্গবন্ধুর আত্মবল বৃদ্ধি করেছে। তিনি জানতেন, রবীন্দ্রনাথের পরিচিতি বিশ্বজোড়া— তিনি বিশ্বকবি। বঙ্গবন্ধুও রবীন্দ্রনাথকে ‘বিশ্বকবি’ হিসেবে বলতেই ভালোবাসতেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দেই বঙ্গবন্ধু চিন দেশে অনুষ্ঠিত ‘শান্তি সম্মেলনে’ যোগদান করার জন্য আমন্ত্রিত হয়ে সে দেশে যান। সেখানে বঙ্গবন্ধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা করেন। আন্তর্জাতিক এই সম্মেলনে যেখানে সাঁইত্রিশটি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বক্তৃতা দেবার একটি সাহসের জায়গা ও একটি কারণ বর্তমান ছিল। সাহসের জায়গা ছিল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বিশ্ববাসী চেনেন; তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বক্তৃতা করছেন। কারণের জায়গাটি ছিল, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা হলো বাংলা; তিনি পাকিস্তানের প্রধান ভাষায় বক্তৃতা করছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে প্রসঙ্গটি বঙ্গবন্ধু উল্লেখ করেছেন এভাবে: ‘আমি বাংলায় বক্তৃতা করলাম। আতাউর রহমান সাহেব ইংরেজি করে দিলেন। ইংরেজি চীনা, রুশ ও স্পেনিশ ভাষায় প্রতিনিধিরা শুনবেন। কেন বাংলায় বক্তৃতা করব না? ভারত থেকে মনোজ বসু বাংলায় বক্তৃতা করেছেন। পূর্ব বাংলার ছাত্ররা জীবন দিয়েছে মাতৃভাষার জন্য। বাংলা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু লোকের ভাষা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে না জানে এমন শিক্ষিত লোক চীন কেন দুনিয়ায় অন্যান্য দেশেও আমি খুব কম দেখেছি। আমি ইংরেজিতে বক্তৃতা করতে পারি। তবু আমার মাতৃভাষায় বলা কর্তব্য।’ (রহমান, ২০১২ : ২২৮) বঙ্গবন্ধুর এই কর্তব্যবোধ পালনে রবীন্দ্রনাথ সহায় হয়েছেন নিশ্চয়।
রবীন্দ্রনাথকে এভাবে ‘সহায়’ হিসেবে বঙ্গবন্ধু পেয়েছেন তাঁর জীবনের নানা পর্যায়ে। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ জুলাই, যখন তিনি কারান্তরালে- তখন এক আবেগঘন পরিবেশে, নিজের মনে যখন তিনি অসহায়ত্ববোধ করছিলেন, তখনই রবীন্দ্রনাথের বাণী তাঁকে মনোবল জুগিয়েছে। উল্লিখিত দিনে পিতা লুৎফর রহমানের লেখা একটি চিঠি পাঠ করে তিনি আবেগায়িত হয়ে পড়েন। চিঠিতে পিতার ‘বাবা খোকা’ সম্বোধন নিয়ে একজন কয়েদির জিজ্ঞাসার উত্তরে স্নেহপ্রবণ ও বিপদে অবিচলিত পিতার মুখমণ্ডল কল্পনা করে বঙ্গবন্ধুর মনে হয়েছে, এই কারাজীবন কবে শেষ হবে? মা-র মুখ তিনি আবার কবে দেখতে পাবেন? এই ভাবনা থেকে পরিত্রাণের জন্য বঙ্গবন্ধু পত্রিকা ও বই নিয়ে বসেন। কিন্তু মন তাঁর শান্ত হয় না। পরে তিনি ফুলের বাগানে কাজ করলেন, মন ভালো করার জন্য। তাতেও শান্তি এলো না। অবশেষে তিনি শান্তি পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’র ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো / এ নহে মোর প্রার্থনা’ স্মরণ করে। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘বারবার আব্বা ও মার কথা মনে পড়তে থাকে। মায়ের সাথে কি আবার দেখা হবে? অনেকক্ষণ খবরের কাগজ ও বই নিয়ে থাকলাম কিন্তু মন থেকে কিছুতেই মুছতে পারি না, ভালও লাগছে না। অনেকক্ষণ ফুলের বাগানেও কাজ করেছি আজ। মনে মনে কবিগুরুর কথাগুলি স্মরণ করে একটু শান্তি পেলাম।
বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
দিনের আলো নিভে গেল, আমিও আমার সেই অতি পরিচিত আস্তানায় চলে গেলাম।’ (রহমান, ২০১৭ : ১৭৯) বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে যেন অভয়মন্ত্র হিসেবে স্মরণ রাখতেন। একই গ্রন্থের অন্যত্র তিনি নিজের ওপর পাকিস্তানিদের চাপিয়ে দেওয়া মামলাগুলো মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন: পাকিস্তান সরকার তাঁকে একের পর মামলায় জড়িয়ে ফেলেছেন। কথিত ‘দেশরক্ষা আইন’-এ তাঁকে ১৫ মাস কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, আবার বিভিন্ন জনসভায় বক্তৃতা দেবার ‘অপরাধে’ মামলা দেয়া হয়েছে— এই মামলাজাল থেকে বঙ্গবন্ধু কবে মুক্তি পাবেন, এটি তিনিও জানতেন না। কিন্তু হতাশও তিনি হয়ে পড়েননি। তাঁর হতাশা দূর করেছে রবীন্দ্রনাথের সেই ‘অভয়মন্ত্র’— ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো / এ নহে মোর প্রার্থনা’। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘আর একটা মামলায়ও আমার জেল আছে আড়াই বৎসর। সেটাও বক্তৃতা মামলা, হাইকোর্টে পড়ে আছে। কনফার্ম করেছে এক বৎসর। সেটাও বক্তৃতা মামলা, হাইকোর্ট থেকে মুক্তি না পাই। বুঝতে পারলাম আরও যে ছয়-সাতটা বক্তৃতার মামলা আছে সব মামলাই নিচের কোর্টে আমাকে সাজা দিবে। শুধু মনে মনে বললাম:
বিপদে মোরে রক্ষা করো
এ নহে মোর প্রার্থনা,
বিপদে আমি না যেন করি ভয়।
কবিগুরুর এই কথাটা আমার মনে পড়ল।’ (রহমান, ২০১৭ : ২৩১) বঙ্গবন্ধু এভাবেই রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’র এই গান বা কবিতাটি ‘অভয়মন্ত্র’ হিসেবে মনে রাখতেন এবং সেখান থেকে শক্তি ও সাহস সঞ্চয় করতেন। যে কারণে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টত ঘোষণা করেছেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অকল্পনীয়। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের ২৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে প্রদত্ত এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুলকে বাদ দিয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কথা কল্পনা করা যায় না।’ রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালির অবিচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে জানুয়ারি এক সংবর্ধনা সভায় বঙ্গবন্ধু বলেন, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতো ‘বিপ্লবী গান’ গাইতে হবে। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন সেই ৪০জন ব্যক্তির বিরুদ্ধে, যারা পাকিস্তানে রবীন্দ্রচর্চার বিপক্ষে অবস্থানজ্ঞাপন করে বিবৃতি দিয়েছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে জুন পাকিস্তানের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শামসুদ্দীন জাতীয় পরিষদে ঘোষণা করেন যে, রবীন্দ্রসঙ্গীত পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক মর্যাদার বিরোধী, তাই বেতারে এগুলো প্রচার করা হবে না। ২৯শে জুন ৪০জন বাঙালি একে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেন। তাঁরা হলেন: মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অধ্যক্ষ ইব্রাহীম খাঁ, বিচারপতি আবদুল ওদুদ, মজিবুর রহমান খাঁ, মোহাম্মদ মোদাব্বের, কবি আহসান হাবীব, ফররুখ আহমদ, ড. কাজী দীন মোহাম্মদ, ড. হাসান জামান, ড. গোলাম সাকলায়েন, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, কবি বেনজীর আহমদ, কবি মইনুদ্দীন, অধ্যক্ষ শরফুদ্দীন, আ কা মু আদম উদ্দিন, কবি তালিম হোসেন, শাহেদ আলী, আ ন ম বজলুর রশীদ, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, সানাউল্লাহ নুরী, কবি আবদুস সাত্তার, কাজী আবুল কাশেম, মুফাখখারুল ইসলাম, শামসুল হক, ওসমান গনি, মফিজ উদ্দিন আহমদ, আনিসুল হক চৌধুরী, মোস্তফা কামাল, অধ্যাপক মোহাম্মদ মতিউর রহমান, জহুরুল হক, ফারুক মাহমুদ, মোহাম্মদ নাসির আলী, এ কে এম নুরুল ইসলাম, কবি জাহানারা আরজু, বেগম হোসনে আরা, বেগম মাফরুহা চৌধুরী, কাজী আবদুল ওয়াদুদ ও আখতারুল আলম। এই ৪০জন বাঙালি যে চলমান আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করে সাধারণ বাঙালির মধ্যে সন্দেহের বীজ বপন করতে পারে, এ কারণেই বঙ্গবন্ধু এই ৪০জনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। বঙ্গবন্ধু জানতেন, রবীন্দ্রনাথের বিরোধিতা করার অর্থই হলো বাঙালির চলমান আন্দোলনের বিরোধিতা করা। বঙ্গবন্ধু এসব বিরোধিতাকে নস্যাৎ করে বরং পাকিস্তান সরকারের মুখের ওপর ঘোষণা করেন যে, বাঙালি রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়বেই।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে সামরিক কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে এক বিরাট জনসভায় ভাষণদানের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রসংগীত প্রসঙ্গে যে বক্তৃতা দেন তা পত্রিকায় প্রকাশ পায়। তিনি বলেন, ‘আমরা মির্জা গালিব, সক্রেটিস, শেক্সপিয়র, এরিস্টটল, দান্তে, লেনিন, মাও সেতুং পড়ি জ্ঞান আহরণের জন্য আর দেউলিয়া সরকার আমাদের পাঠ নিষিদ্ধ করিয়া দিয়াছেন রবীন্দ্রনাথের লেখা, যিনি একজন বাঙালি কবি এবং বাংলায় কবিতা লিখিয়া যিনি বিশ্বকবি হইয়াছেন। আমরা এই ব্যবস্থা মানি না— আমরা রবীন্দ্রনাথের বই পড়িবই, আমরা রবীন্দ্রসঙ্গীত গাহিবই এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত এই দেশে গীত হইবেই।’ (‘ইত্তেফাক’, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯)
বঙ্গবন্ধু যে সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজব্যবস্থা স্বাধীন বাংলাদেশে প্রয়োগ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তার শিক্ষা তিনি রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমেও পেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩১) বইটির কথা উল্লেখ করা যায়। এটি রবীন্দ্রনাথের একটি পত্র-প্রবন্ধ সংকলনগ্রন্থ। সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের ভ্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা, সমাজ, রাষ্ট্র, মানবমন ইত্যাদি ব্যাখ্যা ও সমালোচনা আছে এতে। সমালোচনা যতোটুকু আছে তার চেয়ে রবীন্দ্রনাথের মুগ্ধতাই বেশি প্রকাশিত হয়েছে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক শিক্ষা-সমাজ-রাষ্ট্র-মানবমন নিয়ে। একটি পিছিয়ে থাকা সামন্তবাদী সমাজ থেকে কী করে সোভিয়েত ইউনিয়ন উন্নত সমাজ গঠন করল, সে ব্যাপারটি রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে ‘রাশিয়ার চিঠি’তে তুলে ধরেছেন। বঙ্গবন্ধুও বইটি পড়েছিলেন এবং আরও পড়ার আগ্রহ ছিল তাঁর। এই বইটিতে যে ‘রাজনীতি’র কথা আছে সেটি জেনেই বঙ্গবন্ধু ‘রাশিয়ার চিঠি’ পড়তে আগ্রহী হন। জেল কর্তৃপক্ষ বইটি তুলে নিয়ে ‘স্থগিত’ করে রেখে ‘প্রেমে’র গল্প-উপন্যাস পড়তে দেওয়ায় ক্ষুব্ধ হন তিনি।
বঙ্গবন্ধু প্রাসঙ্গিকভাবে লিখেছেন, ‘আমার [বঙ্গবন্ধু] কতগুলি বইপত্র আই বি Withheld করেছে। আমাকে খবর দিয়েছে Reader’s Digest, নিউজ উইক এবং রাশিয়ার চিঠি, কোনো বইই পড়তে দিবে না। পূর্বেও দেয় নাই। নভেল পড়তে দেয়। প্রেমের গল্প যত পার পড়ো। একজন রাজনীতিক এগুলি পড়ে সময় নষ্ট করে কি করে! কত অধঃপতন হয়েছে আমাদের কিছুসংখ্যক সরকারি কর্মচারীর। রাজনীতির গন্ধ যে বইতে আছে তার কোনো বই-ই জেলে আসতে দিবে না।’ (রহমান, ২০১৭ : ১৬৭) ফলে, বলাই যায়, বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বৃদ্ধিতে রবীন্দ্রনাথের ছায়াও ছিল।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে দেশের সংবিধানের প্রথম ভাগে চতুর্থ অনুচ্ছেদে বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে রবীন্দ্রনাথের গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়। সংবিধানের ভাষাটি এমন: ‘প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সঙ্গীত আমার সোনার বাংলার প্রথম দশ চরণ’। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই ফেব্রুয়ারি ভারতের কলকাতায় বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বাংলাদেশের রূপৈশ্বর্যের কথা উল্লেখ করে স্পষ্ট ভাষায় বলেন, ‘আমার সোনার বাংলা সত্যি সোনার বাংলা তাই আমরা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত করেছি- আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’ কী অসীম আস্থা রবীন্দ্রনাথে, বোঝা যায়। এর আগে পাকিস্তানি কারাগার থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন (১০ই জানুয়ারি, ১৯৭২) করে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানেও জাতীয় সঙ্গীতের আবহ তিনি উচ্চারণ করেন। অথচ, সংসদে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবিধান গৃহীত হয়েছে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা নভেম্বর। বোঝাই যায়, বঙ্গবন্ধুর একান্ত আগ্রহেই রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসার শক্তি দিয়ে বঙ্গবন্ধু কখনো ‘চ্যালেঞ্জ’ও করেছেন। এটি ভালোবাসার দ্বৈরথ। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের আক্ষেপ বাঙালি স্বাধীন হয়ে মোচন করেছে। রাজনৈতিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু চমৎকার করে রবীন্দ্রনাথকে উপস্থিত করেন এবং রবীন্দ্র-পঙ্ক্তি আবৃত্তি করে বাঙালির বিজয়ের গৌরবপতাকা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন। বঙ্গবন্ধু সেই ভাষণে (১০ই জানুয়ারি, ১৯৭২) বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সকল রাষ্ট্রকে আমি অনুরোধ করেছি— বাংলাকে স্বীকৃতি দিন। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় অত্যন্ত ভালোবাসি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন— সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, / রেখেছ বাঙালি করে মানুষ কর নি। কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে, এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই।’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘চৈতালি’ কাব্যগ্রন্থের ‘বঙ্গমাতা’ কবিতায় গৃহকাতরতাকে ‘বাঙালিত্ব’ বলে তুলে ধরে এর সমালোচনা করে বাঙালির দেশ-দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ার জন্য আহ্বান করেছেন। ভর্ৎসনা করে তিনি এও বলেছেন: এই বঙ্গমাতা তার সন্তানদের ‘বাঙালি’ করেই রাখলেন, ‘মানুষ’ করলেন না। বঙ্গবন্ধুই প্রথম রবীন্দ্রনাথের এই ধারণাকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করলেন এবং এই চ্যালেঞ্জ রবীন্দ্রনাথকে ভালোবাসা থেকেই জন্ম নেয়া।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানিদের ‘নাগিনী’ বলে ইঙ্গিত করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি যখন বিশ্বজনমতের চাপে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন-দিল্লিপথে ঢাকা আসেন, তখন বলেছিলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলি ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেছিলেন, ‘দুই অংশের মধ্যে বাঁধন সামান্য হলেও রাখা যায় কিনা’। এটি যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে মেনে না-নেয়া, বঙ্গবন্ধু তা বুঝেছিলেন। এরপর তিনি জানতে পারেন যে, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে পৃথিবীর কোনো কোনো রাষ্ট্রে গিয়ে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ তাদেরই অংশ। বঙ্গবন্ধু দৃঢ়কণ্ঠে এর প্রতিবাদ করেছেন এবং এ প্রসঙ্গেই পাকিস্তানিদের ‘নাগিনী’র সঙ্গে তুলনা করে রবীন্দ্রনাথকে ‘আমার কবিগুরু’ বলে সম্বোধন করে শরণ করেছেন রবীন্দ্রনাথের ‘প্রান্তিক’ কাব্যগ্রন্থের একটি কবিতা। একেবারে মুখস্থ বলেছেন তিনি। রবীন্দ্রকবিতায় কতোটা অধিকার থাকলে এমন মুখস্থ বলা যায়! বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যটি ছিল এমন: আমরা ঘোষণা করেছি আমার দেশ স্বাধীন। তুমি কোন জাগার মাতবর হয়ে পড়লা, তুমি বলছ বাংলাদেশ তোমাদের অংশ। ভুলে যাও বন্ধু, সুখে থাক বন্ধু, বাংলাদেশ স্বাধীন, বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র, বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। তোমার ক্ষমতা নাই বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে পার। বিনা অস্ত্রে যদি আমরা বাংলার মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা নিয়ে থাকতে পারে, আজ বাংলাদেশকে নিয়ে যদি ষড়যন্ত্র করতে চাও, আর কোন খেলা খেলতে চাও মনে রেখো সাত কোটি বাঙালির একটা প্রাণ বেঁচে থাকতে বাংলার মাটিতে ঢুকবার ক্ষমতা তোমাদের নাই। সেজন্য আমার কবিগুরুর একটা কবিতা পড়তে হয় যে—
নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,
শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস
বিদায় নেবার আগে তাই
ডাক দিয়ে যাই
দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে
প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।
আমার বাঙালি প্রস্তুত আছে। নাগিনীদের আমরা চিনি। ভয় নাই।’ (সালাউদ্দিন, ২০১১ : ১৬১) পাকিস্তানিদের এভাবে প্রকাশ্যে ‘নাগিনী’ বলে সম্বোধন করার ক্ষমতা বঙ্গবন্ধু রাখতেন এবং এ ক্ষেত্রে তিনি রবীন্দ্রনাথকে সহায় করেছেন। রবীন্দ্রনাথের পঙ্ক্তিকে এভাবে অবলম্বন করতে আরো দেখা গেছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৬শে মার্চ যখন দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা করেন, তখনও তিনি রবীন্দ্রনাথকে শরণ করেন। তিনি বলেন, বিশ্বের ধনী দেশগুলো আমাদের পাট, চা ইত্যাদির উপযুক্ত মূল্য দেয় না কিন্তু তাদের দেশ থেকে কিছু কিনতে গেলে দাম বাড়িয়ে নেয়, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধি করে চায়। এটা অমানবিকতা। বঙ্গবন্ধু বলেন, এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও অমানবিকতা পরিহার করতে হবে। তা না হলে এমন একদিন আসবে যেদিন সেই ধনী দেশগুলোকে এর মাশুল দিতে হবে। এ প্রসঙ্গেই বঙ্গবন্ধু রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ থেকে উল্লেখ করেন ‘হে মোর দুর্ভাগা দেশ’— এভাবে: ‘তোমরা অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করো। ওই সম্পদ দুনিয়ার দুঃখী মানুষকে বাঁচাবার জন্য ব্যয় করো। তাহলে দুনিয়ায় শান্তি ফিরে আসবে।
হে মোর দুর্ভাগা দেশ যাদের
করেছো অপমান,
অপমান হতে হবে তাদের
সবার সমান।
তোমরা মনে করেছো আমরা গরিব, যে দামই হোক আমাকে বিক্রি করতে হবে। এইদিন থাকবে না।’ (হোসেন, ২০১২ : ৪৫৬) ধনী ও সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে রবীন্দ্রপঙ্ক্তি উদ্ধৃত করে সেই যে হুঁশিয়ারি বঙ্গবন্ধু উচ্চারণ করেছিলেন, প্রায় পাঁচ দশক পরে তাঁর কথাই সত্য হতে চলেছে।
তথ্যসূত্র:
* শেখ মুজিবুর রহমান (২০১২) \ অসমাপ্ত আত্মজীবনী
* শেখ মুজিবুর রহমান (২০১৭) \ কারাগারের রোজনামচা
* শেখ হাসিনা (২০১৫) \ শেখ মুজিব আমার পিতা
* মোহাম্মদ সালাউদ্দিন (সম্পাদক) ( ২০১১) \ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও বিবৃতি
লেখক: ড. সৌমিত্র শেখর : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় : scpcdu@gmail.com
Discussion about this post