রণজিৎ সরকার
রাফির নানা গল্প জানেন, সেদিন রাফিদের বাসায় নানা এলেন। নানার সামনে বসল রাফি। গল্প শুনতে। রাফি মন খারাপ করে বলল,
‘নানা, আজ অন্য কোনো গল্প শুনবো না।’
নানা গালে হাত দিয়ে বললেন, ‘কেন?’
‘অজানা গল্পটা শুনবো।’
‘অজানা গল্প বলবো না। অন্যদিন। আজ মজার একটা গল্প বলবো।
‘গল্পটা শোনাবেন বলেছিলেন। অনেক দিন হলো। আজ পর্যন্ত শুনতে পারলাম না। এখন তো আমার শোনার বয়স হয়েছে।’
নানা মাথাটা নাড়াতে লাগলেন। বললেন, ‘মনে পড়ছে না তো। কোন অজানা গল্পটা?’
নানার দিকে চোখ বড় করে তাকায় রাফি। বলে,
‘নানা, ভুলে গেছেন। মনে করে দেখেন। মাঝে মাঝে বলতেন ‘তোমার বয়স হোক। সময় হলে অজানা গল্পটা বলবো।’
নানা এবার দুহাত মাথায় রেখে বললেন, ‘ও, বুঝেছি। মুক্তিযুদ্ধের সেই অজানা গল্পটা। আজ বলবো।
নানা গল্প বলতে শুরু করলেন, ‘যুদ্ধে গিয়েছি। কাশীপুর বাজার। পাশে কয়েকটা বাসা। একটা বাসাতে ঢুকলাম। ঢোকার পর যা দেখলাম।’
রাফি মুখটা সামনের দিকে বাড়ায়। তার চোখে জানার প্রবল আগ্রহ। বলে, ‘কী দেখেছেন নানা?’
‘ভয় পাবে না তো। যদি ভয় পাও। তাহলে বলবো না।’
‘ভয় পাবো না। আমার সাহস আছে। আপনি বলেন?’
‘বাসায় ঢুকলাম। বাসাটা শ্মশানের মতো নীরব। কোনো সাড়াশব্দ নেই।’
রাফি চোখ বড় বড় করলো। তারপর বলল, ‘নানা, বাসার লোকজন কোথায় ছিল? ভারতে পালিয়ে গিয়েছিল?’
‘গেট পার হয়ে দক্ষিণ পাশের রুমে ঢুকলাম। দেখি রক্ত! লাল রক্ত। কালো রক্ত। সামনে এগিয়ে যাই। এবার দেখি পা। অনেকগুলো পা। ছোট পা। বড় পা। মানুষের মৃতদেহ। একটা ওপর আরেকটা পড়ে আছে। আমি কেঁদে ফেললাম। পেছন থেকে আমার সহযোদ্ধা রাকিব। আমার পিঠে বাঁ হাত রাখল।
বলল, ‘কাঁদলে চলবে না। আবেগে ভেঙে পড়লে চলবে না। জয়ী আমাদের হতেই হবে।’
রাকিব আমার হাত ধরল। সেই বাসা থেকে বের করে নিয়ে এলো। আমরা উত্তরপাড়া গেলাম। গিয়ে দেখি মানুষ পালাচ্ছে। পাকিস্তানি মিলিটারিরা গুলি করছে। বাচ্চাদের কান্না। চিৎকার। মানুষের আর্তনাদ। চারিদিকে শুধু লাশ আর লাশ!
হঠাৎ রাকিবের বুকে গুলি লাগল। রাকিব পড়ে গেল মাটিতে। আমি কাছে গেলাম। রাকিব শুধু আমার হাতটা ধরল। বলল, ‘তুই বেঁচে থাক বন্ধু। দেশটাকে রক্ষা কর। আমার পরিবারটাকে দেখিস। আমার আদরের ছোট মেয়ে রাশেদাকে দেখে রাখিস।’ রাকিব মারা গেল। আমার কোলের ভেতর। সেই রাশেদা তোমার মা। রাকিব তোমার আসল নানা।
রাফির মা কখন পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কেউ টের পায়নি। রাফি ঘাড় ঘুরিয়ে মাকে দেখে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। সে মায়ের কোলে মুখ গুজে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগল। মায়ের চোখেও পানি। নানাও পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের পানি মুছতে লাগলেন।
Discussion about this post