আসিফ ইমতিয়াজ
কিছুদিন ধরে রিজেন্ট গ্রুপের সাহেদ করিম ও জেকেজির আরিফ আর ডাক্তার সাবরিনা—এই তিন মহাপ্রতারক ও তাঁদের সহপ্রতারকদের কর্মকাণ্ডে ক্ষোভে ফুঁসছে বাংলাদেশের জনগণ। ভয়াবহ মহামারি নিয়েও যে প্রতারণার জাল বিছিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়া যায়, তা অধিকাংশ মানুষেরই কল্পনার বাইরে ছিল। যদি জীবাণুদের অনুভূতি আর বোধশক্তি থাকত, সাহেদ-সাবরিনাদের দেখে করোনাভাইরাস নিজেও বোধ হয় লজ্জিত হতো। গণমাধ্যমের তৎপরতায় এর আগে বন্ধ করা গেছে স্বাস্থ্যসংক্রান্ত একটি দপ্তরের নেওয়া ১০ কোটি টাকায় মাত্র চারটি ভিডিও বানানোর তোড়জোড়। দুর্নীতির বাগানে সদ্যোজাত দুটো গোলাপ হয়ে ফুটে রয়েছে এসব ঘটনা। একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ঘরে বসে জুম মিটিংয়ে অংশ নিয়ে ৫৭ লাখ টাকার নাশতা-পানি আর ১ কোটি ৩২ লাখ টাকার স্টেশনারি আইটেম বাবদ করা খরচ এবং আরেকটি সরকারি বিভাগের ১০ হাজার টাকায় একেকটি বঁটি কেনার প্রস্তাবনা। ইতিহাস ঘেঁটে এ রকম অসংখ্য পিলে চমকে দেওয়া দুর্নীতির ঘটনা রীতিমতো মুখস্থ বলে দিতে পারবে—এ রকম মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। মহাপ্রতারক সাহেদের মতো কিছু ব্যতিক্রম বাদে এসব দুর্নীতির মূল হোতাদের যদি পর্যালোচনা করা হয়, তাহলে একটি ভয়ংকর সত্য সামনে চলে আসে। সেটি হলো এসব ব্লকবাস্টার প্রতারণা আর দুর্নীতির শ্রেষ্ঠাংশে যেসব মস্তিষ্ক কাজ করেছে, তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং বিভিন্ন পরীক্ষায় মেধার সাক্ষর রাখা দেশসেরা ‘মেধাবী’ সন্তান।
ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী ছিলেন একজন কার্ডিয়াক সার্জন, দেড় হাজার কোটি টাকা নিয়ে কানাডায় পালানো পি কে হালদার বুয়েট থেকে পাস করা একজন ইঞ্জিনিয়ার, রূপপুর বালিশকাণ্ডে প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন একজন নির্বাহী প্রকৌশলী, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেলেঙ্কারির মূল হোতাদের চারজনই হলেন চিকিৎসক। জুম মিটিংয়ের অস্বাভাবিক খরচ দেখানো আর রুপার দামে বঁটি কিনতে যাওয়া মানুষগুলো সবাই প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মেধাবী দুর্নীতিবাজ আর প্রতারকে বাংলাদেশ এখন জেরবার। দুদকের চেয়ারম্যান গত বছর বলেছিলেন বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিপ্রবণ খাতগুলোর একটি হলো শিক্ষা খাত। যাদের মেধা নিয়ে কারও কোনো সন্দেহ নেই, তাদের নীতি-নৈতিকতার এমন বেহাল অবস্থার কারণটা কী?
এর উত্তর খোঁজার জন্য আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের শুরুর দিকের দিনগুলোয়। নিজেদের চেয়ে বড় আকারের ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে ছোট্ট কোমলমতি শিশুরা যখন স্কুলে যাওয়া-আসা শুরু করে, তাদের চোখে আনন্দের চেয়ে যেন আতঙ্ক থাকে বেশি। আমাদের অভিভাবকেরা তাদের সন্তানদের রাতারাতি একই সঙ্গে পড়ালেখায় আইনস্টাইন, চিত্রাঙ্কনে পাবলো পিকাসো, খেলাধুলায় সাকিব আল হাসান, সংগীতে রুনা লায়লা অথবা কিশোর কুমার বানিয়ে ফেলতে চান। শেখার আনন্দের চেয়ে এসব বাচ্চার কাছে সাফল্যের গুরুত্বকে বড় বানিয়ে ফেলেন বাবা-মায়েরা। অথচ আনন্দ নিয়ে শিখলেই যে দীর্ঘ মেয়াদে টেকসই সাফল্য আসে, এই ক্ষুদ্র ধারণা বড় বড় মস্তিষ্কেই ঢুকতে পারে না। সর্বনাশের এই শুরু।
নষ্টের বীজটা এরপর বেড়ে উঠতে শুরু করে যখন সন্তানকে ফার্স্ট-সেকেন্ড বানানোর নেশায় অন্ধ অভিভাবকেরা মৌলিক নৈতিক শিক্ষার ব্যাপারে উদাসীনতা দেখাতে শুরু করেন। কিশোর বয়সে সন্তানদের আচরণগত ভুলত্রুটিগুলো অনেক মা-বাবা তাঁদের ছেলেমানুষি ভেবে এড়িয়ে যান, যদি সেই সন্তানদের পরীক্ষার ফল ভালো হয়। ক্লাসে ভালো ফল একধরনের সাফল্য, কিন্তু একজন ভালো মানুষ হওয়াটাই জীবনের প্রকৃত সার্থকতা। সাফল্য আর সার্থকতার এই পার্থক্য নিরূপণে বেশির ভাগ অভিভাবক আগ্রহী নন। আর এই অবহেলা থেকেই জন্ম হয় বুয়েটের আবরার ফাহাদের খুনিদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু বকরের খুনির। এই খুনিদের সবাই মেধাবী ছিল, কিন্তু হয়তো আশপাশের সবাই ওদের যেভাবে পরীক্ষায় ভালো করতে বলেছে, জীবনে ভালো মানুষ হতে সেভাবে বলেনি। অবশ্য অনেক সময় চাইলেও শেখানো যায় না। কারণ, শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। যে সন্তান জন্ম থেকে দেখে আসে তার অভিভাবকটি সীমিত আয়ের চাকরি করেও অঢেল ধনসম্পদের মালিক, তার কোমল মন এটাকেই স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে। সে যদি পরবর্তী সময়ে তার সৎ উপার্জন করা অপেক্ষাকৃত অসচ্ছল আত্মীয়টিকে সম্মান দিতে না শেখে, তবে তার এই নৈতিক মূল্যহীনতার দায়ভার কার ওপর বর্তাবে?
কাঁঠালের বীজ বপন করে ফজলি আমের আশা কতটা যৌক্তিক?
যদিও সব ধরনের শিক্ষার সূচনা পরিবারেই হয়, তবু দোষ শুধু একতরফাভাবে পরিবারের ওপরে চাপিয়ে লাভ নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নৈতিকতা আত্মস্থ করতে শিক্ষার্থীদের কতখানি সাহায্য করছে? জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পাঠদান শুরু হয় তৃতীয় শ্রেণি থেকে, শেষ হয় এসএসসি পরীক্ষার মাধ্যমে। অথচ বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গিয়েছে, শিশুদের দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যেই মানবিক গুণাবলির বিকাশ হয় এবং নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। কাজেই বাংলাদেশেও নৈতিক শিক্ষা শুরুর সময়কাল দুই বছর এগিয়ে এনে প্রথম শ্রেণিতেই ধার্য করা যায়।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত ২০১৯ সালের দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪৬ নম্বরে। বিশ্বের সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে সুইডেন আর আইসল্যান্ডের পাঠ্যসূচিতে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত নয়। বাকি দেশগুলোয় সাধারণত ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার পাঠদান শুরু হয় প্রথম শ্রেণি থেকেই, চলে জার্মানিতে দ্বাদশ আর বাদবাকি দেশে দশম শ্রেণি পর্যন্ত। তার মানে তাদের শিশুরা পরিবার থেকেই মানবিক গুণাবলি রপ্ত করে থাকে। অর্থাৎ সবচেয়ে কম দুর্নীতিপ্রবণ দেশগুলোর শিশুদের মধ্যে কেউ কেউ পরিবার থেকেই মানবিক গুণাবলি রপ্ত করে, অনেক শিশুর নৈতিক শিক্ষা পাওয়া শুরু আমাদের দেশের শিশুদের দুই বছর আগে থেকেই। তবে ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা আজকাল আর অঙ্ক-বিজ্ঞানের পাশে দাঁড়াতে পারে না। কোনো অভিভাবক তাদের বাচ্চা অঙ্ক, বিজ্ঞানে কম নম্বর পেলে যেভাবে শোকসংগীত শুরু করেন, নৈতিক শিক্ষায় তাদের বাচ্চা ভালো নম্বর না পেলে তেমন বিচলিত হন না। এখানেই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনটা দরকার। অঙ্ক-বিজ্ঞান-ইংরেজিতে শিশুদের কম নম্বর পাওয়া খুব বেশি ভয়ের ব্যাপার না, সঠিক চর্চায় এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। কিন্তু নৈতিকতা শিক্ষায় শিশুর কম নম্বর পাওয়া অবশ্যই অভিভাবকমনে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি এবং বাড়তি মনোযোগ প্রাপ্তির দাবি রাখে। প্রাথমিক শিক্ষার কয়েকটি ধাপকে অতিরিক্ত ফলাফলনির্ভর না করে আনন্দদায়ক করলে শিশুদের লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না।
কেমন হয় যদি প্রথম থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না থাকে? শিশুরা মনের আনন্দে বিদ্যালয়ে যাবে, খেলাধুলা করবে, একে অপরের সঙ্গে মিশে সমাজবদ্ধ জীবনের গুরুত্ব বুঝবে, বুদ্ধিবৃত্তিক খেলায় অংশ নিয়ে মস্তিষ্ককে ধারালো করবে। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা শিশুদের শৃঙ্খলা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ শেখাবেন, শিশুদের মনোজগতে ভালো-মন্দের পার্থক্য করার সামর্থ্যকে স্থায়ী করবেন। তবে মনে রাখা উচিত, নৈতিকতা বোধের উন্মেষ ঘটবে পাঠশালায় আর তার চর্চা হবে পারিবারিক আয়তনে।
জাতি হিসেবে আমরা অত্যন্ত শিক্ষাপিয়াসি, এটা বেশ আশার কথা। কিন্তু সেই জাতির প্রতিটি সামাজিক স্তরে নীতিহীনতার এমন নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ দেখা যাওয়া খুবই হতাশাজনক। খাদ্য আর ওষুধে ভেজাল থেকে শুরু করে পাসপোর্ট অফিস আর বিআরটিএতে এককালে থাকা দালালের দৌরাত্ম্য, তোষামোদি করে বৈধ-অবৈধ সুবিধা আদায়, টাকার বিনিময়ে টক শোতে রাজনৈতিক বিশ্লেষক সাজা থেকে শুরু করে শেয়ারবাজার, হলমার্ক, রিজেন্ট, জেকেজি, পর্দা, বালিশ, জুম, বঁটি কেলেঙ্কারি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, নীতিহীনতার আসলে কোনো বর্ণ, গোত্র, ধর্ম, শ্রেণি, পেশা নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি একটি সর্বজনীন ধারণা। করোনাভাইরাস যদি হয় বৈশ্বিক মহামারি, নীতিহীনতা হলো সামাজিক মহামারি। শরীরের অসুখের মহামারি সারতে কতখানি সময় লাগবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না, তবে মনের অসুখের এই মহামারি সারতে যে তার চেয়ে বেশিই সময় লাগবে—এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই একদম শিশু বয়স থেকেই পাঠশালায় নীতিশিক্ষার শুরু এবং পারিবারিকভাবে নৈতিকতার চর্চা শুরু করলে মোটামুটি ১০ থেকে ১৫ বছর পরে আমরা একটি সামগ্রিক সুফল দেখতে পাব বলে আশা করা যায়। নীতিহীন মেধাবীর চেয়ে গড়পড়তা মেধার নীতিমান ব্যক্তির সম্মান সমাজে অনেক উঁচুতে হওয়া উচিত। মেধাবী জাতির আগে নীতিমান জাতি গড়ার দিকে আমাদের বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। নীতিহীন মেধাবীরা দেশ আর সমাজের ক্ষতিই ডেকে আনে, মঙ্গল বয়ে আনে না। ভুলে গেলে চলবে না, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।
আসিফ ইমতিয়াজ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন বিভাগের প্রভাষক।
Discussion about this post