নিউজ ডেস্ক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার যাত্রা কখনোই সুখকর হয়নি! ১৯৭৫ সালে ১৪ আগস্ট একান্ত সচিবের সঙ্গে খুনসুটিতে ব্যস্ত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মন্তব্য এটি। পরদিন ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম ও স্বাধীন বাংলাদেশে বিদ্যায়তনটির প্রথম সমাবর্তন ছিল। ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের (একান্ত সচিব) ভাষ্য, ‘যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বঙ্গবন্ধু বহিষ্কৃত হয়েছিলেন, সেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই তাঁকে ‘সম্মানসূচক ডক্টর অব ল’ ডিগ্রী দিতে যাচ্ছে, সেটি কতটা সুখের হবে; সম্ভবত সেই সংশয় থেকেই বঙ্গবন্ধু ওই মন্তব্য করেছিলেন।’
১৫ আগস্ট ‘সবে ভোর হওয়া’ ক্ষণে বঙ্গবন্ধুর সংশয় সত্যি হয় বিপথগামী সৈন্যদলের নৃশংস এক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। যে সংবাদ শুনে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নয়, গোটা জাতির জীবনে নেমে আসে শোকের ছায়া। পড়ে থাকে বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেওয়ার সব আয়োজন, সমাবর্তন অনুষ্ঠান। যারা সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল, তারাও সেদিন আত্মগোপন করেন। সবমিলিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিণত হয় ‘ছাত্রশূন্য’ এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু ও ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সম্পর্ক এমনই বিয়োগান্তক।
১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কেমন আগ্রহ ছিল-দৈনিক ইত্তেফাকের উদাহরণই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট। এদিন দৈনিকটির প্রধান শিরোনাম ছিলো, ‘বঙ্গবন্ধু আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করবেন।’ পাশের শিরোনাম ছিলো- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণের সাড়া।’ শেষের পাতায় বঙ্গবন্ধুর হাস্যজ্জ্বল ছবি সম্বলিত একটা বক্সের মধ্যে শিরোনাম ছিলো, ‘বঙ্গবন্ধুকে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাগত জানাবে।’ সেদিন সকালে পত্রিকায় এমন হেডলাইন দেখে কেউ বিশ্বাসই করেননি- কয়েক ঘন্টা আগে সপরিবারের নিহত হয়েছেন জাতির জনক শেখ মুজিব।
১৯৭৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন ড. আবদুল মতিন চৌধুরী। তার স্ত্রী রাজিয়া মতিন ১৫ আগস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন ও তাতে বঙ্গবন্ধুর আগমন নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাসস সংবাদদাতাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু সংবাদে কোন ঘোষণা ছাড়াই থেমে গিয়েছিল সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সব আয়োজন। স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আকাশ-বাতাস- সব কিছু। সেদিন একটি পাখিও আর ডেকে ওঠেনি। অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে তিনি বলেন, যে বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বাংলাদেশ হতো না। তিনি চলে গেছেন, সব শূন্য করে গেছেন!’
অধ্যক্ষ রাজিয়া বলেন, ‘কথা ছিল বঙ্গবন্ধু প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে আসবেন। সেখানে রুপোর থালায় সাজানো ফুলের পাপড়ি দিয়ে তার পায়ে শ্রদ্ধা জানাবে শেখ রাসেলসহ তিন শিশু। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সাথে সাথে নিষ্পাপ শিশু রাসেলকেও হত্যা করে সেদিন।’
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামাল ও পুত্র বধু সুলতানা কামাল তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর পরীক্ষা দিয়েছেন। ওরা ১৪ আগস্ট অনেক রাত পর্যন্ত সমাবর্তন অনুষ্ঠানের আয়োজন শেষ করে ৩২ নম্বরের বাসায় যায়। বঙ্গবন্ধু গণভবনে না থাকলেও শেখ কামাল ও সুলতানা কামাল গণভবনে থাকতেন। কিন্তু ১৪ আগস্ট তারা বাসায় ফেরে। আর সেই ফেরাই তাদেরকে মৃত্যুর দেশে নিয়ে যায়!
রাজিয়া মতিন বলেন, ‘কয়েকদিন ধরে ঘর-দুয়ার পরিস্কার করেছিলাম। সবকিছু পরিপাটি করে সাজিয়েছিলাম। রূপোর থালায় তাঁকে আপ্যায়ন করবো বলে সাজিয়ে রেখেছিলাম। বঙ্গবন্ধু পিঠা পছন্দ করতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য পিঠা এবং সিঙ্গারা তৈরি করেছিলাম। কিন্তু থেমে গেল সব আয়োজন।’
বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতের খবর উপাচার্য ভবনে কীভাবে পৌঁছে, সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে রাজিয়া বলেন, মাত্র ভোর হয়েছে। বেড টি খাচ্ছিলেন ড. মতিন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, লোকজন এখনও আসছে না কেন? হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠলো। মতিন সাহেব ফোন ধরলেন। ফোনে কথা শেষ করে আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি টেলিভিশনটা অন করো। টেলিভিশন অন করেই শুনতে পেলাম, ‘আমি মেজর ডালিম বলছি’। আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, সেখানেই বসে পড়লাম। মতিন স্তব্ধ, হতবিহ্বল! বললেন, আমি এখন কি করব?
জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে সমাবর্তন অনুষ্ঠান ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় বিশেষ আয়োজন রাখা হয়েছিল। সমাবর্তন অনুষ্ঠান শেষে শিক্ষকদের নিয়ে উপাচার্যের বাসভবনে কেক কাটার কথা ছিল। আয়োজন ছিল চা-নাস্তারও। সেখানে সবার জন্য হোটেল পূর্বাণীতে নাস্তার অর্ডার দেয়া হয়েছিলো। কিন্তু রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তার কথা ভেবে বঙ্গবন্ধুকে উপাচার্যের বাসায় তৈরি খাবারে আপ্যায়ন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
একটি তথ্যে দেখা গেছে, বঙ্গবন্ধু মিতব্যয়ী হওয়ার কারণে সমাবর্তনের মত অনুষ্ঠানেও তোরণ নির্মান করতে না করেছিলেন। আয়োজন ছিল না রাশি রাশি ফুলেরও। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকারকে দেওয়ার মত ‘বুকভরা ভালোবাসা’ তো নিশ্চয়ই ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মনে। কিন্তু ঘাতকদের যে সেটিও সহ্য হলো না।
লিখেও যে মানপত্র পাঠ হয়নি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪০তম ও বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম সমাবর্তনে আচার্য হিসেবে প্রথম ভাষণ দেয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। এজন্য ঢাবির তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরীর মানপত্র পাঠ করার কথা ছিল। কিন্তু সেই মানপত্র আর পাঠ করা হয়নি। যা ছিল ১৫আগস্ট বঙ্গবন্ধুর জন্য তৈরি মানপত্রে-
মাননীয় চ্যান্সেলর,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় চ্যান্সেলর হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে আপনার এই প্রথম শুভাগমনে আমরা আনন্দিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৪ বছরের ইতিহাসে আপনিই প্রথম চ্যান্সেলর যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে এসেছেন, সেজন্য আমরা বিশেষভাবে গৌরবান্বিত। আপনাকে সর্বান্তঃকরণে স্বাগত জানাই। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান ঐতিহ্য, ছাত্র-গণ-সংগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান আপনার জানা আছে। স্বাধীনতা সংগ্রামসহ অন্যান্য সকল সংগ্রামে যে সকল শিক্ষক, কর্মচারী, ছাত্ররা আত্মাহুতি দিয়েছেন, আজকের এই মহতী অনিষ্ঠানে তাদেরকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আপনার পূর্বাপর কৃপার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।
মাননীয় চ্যান্সেলর,
আজ আপনার আহ্বানে সমগ্র দেশে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় বিপ্লবের শুভ কর্ম-উদ্দীপনা। এই যুগান্তকারী দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণের জন্য আপনাকে অভিনন্দন জানাই। এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বিপ্লবেরমত এবারও আপনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দ্বিতীয় বিপ্লবের সকল কর্মসূচি সফল ও সার্থক করে তুলবে। আজ দেশের এই বৈপ্লবিক চেতনা বিকাশের নতুন পটভূমিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার শুভাগমন তাই এক স্মরণীয় মহামুহূর্ত।
মাননীয় চ্যান্সেলর,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাসমূহ আপনার জানা আছে। যা আপনাকে নতুন করে বলার প্রয়োজন অনুভব করি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্যা আছে ও থাকবে এবং আমরা মনে করি সমস্যার মোকাবেলা করা এবং তা সমাধানের চেষ্টা করাই প্রগতির লক্ষণ। স্বাধীনতার আগে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭,০০০ ছাত্র ছিল, স্বাধীনতার পর জনসংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৫,০০০। সুতরাং ছাত্রদের আবাসিক সংকট, ক্লাশরুমের স্থানাভাব, ল্যাবরেটরিতে সরঞ্জামের অপ্রতুলতা, লাইব্রেরি ও সেমিনার লাইব্রেরিতে নতুন নতুন বইয়ের সংখ্যাল্পতা ইত্যাদি সমস্যা আমাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে। শিক্ষকদের ও কর্মচারীদের নানাবিধ সমস্যা আছে। আমরা জানি সব সমস্যার রাতারাতি সমাধান করা যাবে না। দেশের বাস্তব অবস্থার সাথে সামঞ্জস্য রেখেই সমস্যার সমাধানের কর্মসূচি নিতে হবে। তবুও আমাদের মনে রাখা দরকার যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো, সবচেয়ে বড় এবং লোকে বলে, সবচেয়ে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়। এর সমস্যা নিয়ে আমার আপনার সাথে অনেক আলোচনা হয়েছে। আপনি বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় করতে চান। এক্ষেত্রে আমরা আপনার সুদৃষ্টি, সহানুভূতি ও শুভাশীষ চাই।
মাননীয় চ্যান্সেলর,
কোন ব্যক্তি বা ইনস্টিটিউশন অবিনশ্বর নয়। কিন্তু বাংলাদেশ থাকবে, এই বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে। এবং আমাদের মতে, আমাদের ভবিষ্যৎ কি হবে, এদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনধারা কিভাবে গড়ে উঠবে তা অতিতের মত ভবিষ্যতেও বহুলাংশে নির্গীত হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়েই। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি আপনার, আপনার সরকারের এবং বাংলাদেশের জনগণের সুদৃষ্টি এবং সহানুভূতি আমরা আশা করছি।
মাননীয় চ্যান্সেলর,
আপনার বহু কর্মব্যস্ততার মধ্যেও আপনি যে আজ আমাদের মধ্যে এসেছেন সে জন্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, প্রশাসন এবং কর্মচারীদের পক্ষ থেকে আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এই বিশ্ববিদ্যালয় আপনার, আমার এবং আমাদের। আপনাকে আজ এই আশ্বাস দিতে চাই যে আপনার ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লবকে স্বার্থক করে তুলার জন্য আমরা কাজ করে যাব। দ্বিতীয় বিপ্লব সার্থক হোক সর্বশক্তিমান আল্লাহর দরবারে এই কামনা করি। কারণ এর কোন বিকল্প নাই। দ্বিতীয় বিপ্লবই বাংলাদেশের শোষীত জনগণের মুক্তির পথ।
আমরা আপনাকে আমাদের অনুগত্য এবং কৃতজ্ঞতা জানাই। আর পরম করুণাময়ের নিকট দোয়া করি তিনি যেন আপনাকে সুস্থ রাখেন ও দীর্ঘায়ু করেন।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মচারী ও ছাত্রছাত্রীদের পক্ষ থেকে অধ্যাপক আব্দুল মতিন চৌধুরী।
উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হয়েও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষে আন্দোলন করার ‘অপরাধে’ অনেকের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও সাজাপ্রাপ্ত হন। অন্যরা দণ্ডমূলক জরিমানা পরিশোধ করে ছাত্রত্ব বহাল রাখলেও শেখ মুজিব অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেয়া জরিমানা দিতে অস্বীকার করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কৃত হন। তারপর দুবার তিনি ঢাবি ক্যাম্পাস গেলেও কোনটিই আনুষ্ঠানিক সফর ছিল না।
Discussion about this post