সমকাল প্রতিবেদক ও নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি
করোনাকালে মালয়েশিয়ায় প্রবাসী কর্মীদের ওপর নীপিড়নের কথা জানিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরায় সাক্ষাৎকার দেওয়ায় গ্রেপ্তারের পর মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে ফেরা তরুণ রায়হান কবির বলেছেন, তিনি প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করেন বলেই তাদের স্বার্থে কথা বলেছেন।
শুক্রবার সকালে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাধীন শাহী মসজিদ এলাকায় নিজ বাসায় সাংবাদিকদের এ কথা বলেন তিনি।
এ সময় রায়হান কবির বলেন, ‘মালয়েশিয়াতে স্টুডেন্ট লিডার ছিলাম আমি। সেখানে স্টুডেন্টদের যেসব সংগঠন সেগুলোর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আমি। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে বাঙ্গালি কমিউনিটিতে আমি পরিচিত মুখ। যে এলাকায় ঘটনাটি ঘটে, আমি সেই এলাকাতেই থাকতাম। মূলত রেইড নিয়ে ঘটনাটা। সেজন্য বিভিন্ন এনজিও’র মাধ্যমে আল জাজিরা আমাকে খুঁজে বের করে ও আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলে। আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু সে রেইডে গ্রেপ্তার হয়েছিল। আমি বিভিন্ন জায়গায় ওর জন্য অনেক তদবির করছিলাম, যেটা সবাই জানে। সেটি আমার উইক পয়েন্ট ছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল তুমি তোমার ফ্রেন্ডের জন্য বা তোমার কমিউনিটির জন্য লিডার হিসেবে কিছু বলতে চাও কি-না। সেই হিসেবে আমি আমার বিবৃতি দিয়েছি। আল জাজিরা আমাকে বলেছিল, ক্যামেরার সামনে মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে। আমি তো সত্য বলব, তো আমি কেন মাস্ক ব্যবহার করব। আমি মুখ ঢাকতে কোনোকিছু ব্যবহার করিনি। কারণ এটি আমার পার্সোনালিটির বাইরে।’
আল জাজিরায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার প্রসঙ্গে রায়হান কবির বলেন, ‘ধীরে ধীরে অনেক বিষয়ে অনেক ক্ষোভ ভেতরে জন্মায়। মালয়েশিয়ায় রিফিউজি অ্যাক্টের ৫১ বি’তে বলা হয়েছে, আনডকুমেন্টেট কাউকে যদি পাওয়া যায় আর তার সে দেশে থাকার বৈধতা শেষ হয় তাহলে তাকে এক সপ্তাহের মধ্যে দেশে পাঠাতে হবে। তাকে কোনো হ্যান্ডকাফ পরানো কিংবা নির্যাতন করা যাবে না। অথচ মালয়েশিয়া এয়ারপোর্টেও হ্যান্ডহাফ পরা ছিলাম আমি। মূলত হ্যান্ডকাফ নয়, শিকল পড়ানো হয়েছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেখানকার পুলিশ, ৯টা সংস্থা ও আইজিপি আমার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছেন এবং জানতে পেরেছেন কোনো কিছুর প্ররোচনায় নয়, মূলত আমি প্রবাসীদের নিয়ে কাজ করি বলেই তাদের স্বার্থে কথা বলেছি। আমি প্রবাসীদের জন্য কাজ করেছি, করছি। প্রবাসীদের জন্য প্রয়োজনে আমি একাই লড়ব।’
রায়হান বলেন, ‘আমি দেশে ফেরার আগে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনের ডিজি আমার সঙ্গে দেখা করেন এবং দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তুমি কি কিছু চাও আমাদের দেশের কাছে? তখন আমি বলি, আমার বাংলাদেশের অনেক প্রবাসী মালয়েশিয়ায় জেলে আটক আছে। তারা ভিসা জটিলতা, আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে দেশে যেতে পারছে না। তাদের দেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করে দেন। তখন তিনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তোমার জন্য কি চাও বলো। আমি আমার উত্তরটিই রিপিট করি। তখন তিনি হেসে দেন।’
এর আগে শুক্রবার রাত একটার দিকে দেশে ফেরেন রায়হান। এ সময় বিমানবন্দরে রায়হান কবিরের স্বজনরা ও ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান তাকে রিসিভ করেন।
তার বাবা শাহ আলম সমকালকে জানান, বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাত দুইটার দিকে তারা রায়হানকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন। রায়হান বর্তমানে বাড়িতে রয়েছেন।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান সমকালকে জানান, শুক্রবার স্থানীয় সময় রাত ৯টার দিকে মালয়েশিয়ার অভিবাসন কর্তৃপক্ষ রায়হানকে বিমানবন্দরে পাঠায়। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে মালয়েশিয়ান এয়ারলাইন্সের এমএইচ-১৯৬ ফ্লাইটে বাংলাদেশ সময় রাত ১টায় তিনি দেশে পৌঁছান।
করোনাকালে মালয়েশিয়া সরকার ‘মুভমেন্ট কন্ট্রোল অর্ডার’ (এমসিও) জারি করে। গত ৩ জুলাই আল-জাজিরায় প্রচারিত ‘লকড আপ ইন মালয়েশিয়াস লকডাউন’ তথ্যচিত্রে বলা হয়, এ আদেশের ফলে অভিবাসী কর্মীরা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। এতে রায়হান কবিরের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। তিনি অভিবাসীদের ওপর নিপীড়নের তথ্য তুলে ধরেন। তার এ বক্তব্যে মালয় জাতীয়তাবাদীরা ক্ষুব্ধ হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রায়হান ‘বুলিং’র শিকার হন। তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা বলেছেন, রায়হান সাক্ষাৎকারে মিথ্যা বলেননি। অভিবাসীদের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরেছেন। তিনি সত্য বলার মূল্য দিয়েছেন।
গত ৮ জুলাই ওয়ার্ক পারমিট বাতিলের পর ২৬ জুলাই গ্রেপ্তার করা হন রায়হান কবির। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও মালয়েশিয়ার মানবাধিকার সংগঠনগুলোও তাকে গ্রেপ্তারের নিন্দা করে মুক্তির দাবি জানায়। ২৫ জুলাই রায়হানকে ১৪ দিনের এবং পরে আবার ১৩ দিনের রিমান্ডে নেয় মালয় পুলিশ। আল-জাজিরার কার্যালয়েও তল্লাশি চলে। গত বুধবার তার আইনজীবী সুমিথা শান্তিনি কিশনার বরাতে ‘ফ্রি মালয়েশিয়া টুডে’ জানিয়েছিল, রায়হানের বিরুদ্ধে আদালতে কোনো অভিযোগ দায়ের করেনি অভিবাসন কর্তৃপক্ষ।
রায়হানের আটক হওয়া ও মুক্তি নিয়ে কর্মকর্তাদের এক দফা সাক্ষাৎ ছাড়া মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা ছিল না। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণণালয় সূত্র জানিয়েছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়ানো ঘৃণার কারণে মালয় জনমত রায়হানের বিপক্ষে ছিল। তার মুক্তির জন্য সরকার প্রকাশ্য চাপ দিলে দেশটিতে থাকা লাখ লাখ বাংলাদেশি সমস্যার মুখে পড়তে পারত। এ কারণেই আগাগোড়াই রায়হান ইস্যুতে নিরব ছিল তারা। তবে অপ্রকাশ্য তৎপরতা চালানো হয়েছে।
Discussion about this post