মুফতি ইবরাহিম সুলতান
নবীজির প্রিয় হারেসা বিন নোমান (রা.) ছিলেন একজন বিশিষ্ট আনসারি সাহাবি। মদিনার প্রসিদ্ধ আনসার গোত্র ‘বনু নাজ্জারে’ তাঁর জন্ম। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে বদর, ওহুদ, খন্দকসহ সব যুদ্ধেই তিনি সমানভাবে অংশগ্রহণ করেছেন।
নবীজির বিশেষ সাহচর্য ছাড়াও অনেক গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। বিশেষ করে সর্বদা মায়ের সেবায় নিবেদিত থাকতেন হারেসা (রা.)। যার ফলে আল্লাহ তাআলা তাঁকে এমন অনন্য সম্মান ও মর্যাদা দান করেছেন, যা অন্য সাধারণ সাহাবিরা তার পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।
মর্যাদাবান এ সাহাবিকে স্বপ্নযোগে রাসুল (সা.) জান্নাতে দেখেছিলেন। আম্মাজান আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) এক রাতের স্বপ্নের কথা আমাদের কাছে এভাবে বর্ণনা করেন, ‘আমি ঘুমিয়ে ছিলাম। স্বপ্নে দেখলাম, জান্নাতে প্রবেশ করেছি। সেখানে কোনো পাঠকের পড়ার আওয়াজ শুনতে পেলাম। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি কে? তারা (ফেরেশতা) বলেন, তিনি হারেসা বিন নোমান। তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এমনই হয় সেবা ও সদাচারের প্রতিদান, এমনই হয় সেবা ও সদাচারের বিনিময়। তিনি ছিলেন তাঁর মায়ের প্রতি সর্বাধিক সদ্ব্যবহারকারী।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৫১৮২)
আল্লামা শরফুদ্দিন তিবি (রহ.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) এই স্বপ্ন দেখার পর সাহাবায়ে কেরামের সামনে তা বর্ণনা করলেন। যখন তিনি হারেসা বিন নোমানের নাম উল্লেখ করলেন, তখন তাঁর সেই অনন্য গুণের প্রতি সবার মনোযোগ আকর্ষণ করলেন, যার দ্বারা তিনি এই মর্যাদার অধিকারী হয়েছেন। ‘এমনই হয় তোমাদের সেবা ও সদাচারের প্রতিদান’ কথাটি পুনরুক্তির মাধ্যমে তাদেরকে উৎসাহিত করলেন যে তোমরাও তাঁর মতো মর্যাদার অধিকারী হতে পারবে মাতা-পিতার সঙ্গে সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে। (শরহুত তিবি : ৯/১৫৮)
সৌভাগ্যবান এই সাহাবির সালাম জিবরাঈল (আ.) গ্রহণ করেছিলেন। তাঁরই বর্ণিত হাদিসে রয়েছে, তিনি বলেন, ‘আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছ দিয়ে যাচ্ছিলাম। তখন তাঁর কাছে একজন ব্যক্তি উপবিষ্ট ছিলেন। আমি তাকে সালাম দিলাম। যখন আমি ফিরে আসছি তখন রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, আমার সঙ্গে যিনি বসা ছিলেন, তাকে কি তুমি দেখেছ? আমি বললাম, জি হ্যাঁ। তিনি বলেন, তিনি হলেন জিবরাঈল (আ.)। তিনি তোমার সালামের জবাব দিয়েছেন।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২৩৬৭৭)
সালাম নিয়ে জিবরাঈল (আ.)-এর সঙ্গে তাঁর আরো একটি ঘটনা হাদিসে এভাবে এসেছে, একবার হারেসা বিন নোমান (রা.) নবী করিম (সা.) এর দরবারে এলেন। তিনি তখন এক ব্যক্তির সঙ্গে খুব গোপনে কথা বলেছিলেন। তাই হারেসা (রা.) সালাম না দিয়ে বসে গেলেন। জিবরাঈল (আ.) তখন বলেন, তিনি সালাম দিলে আমি তাঁর সালামের জবাব দিতাম। রাসুলুল্লাহ (সা.) জিবরাঈল (আ.)-কে বলেন, আপনি কি তাকে চেনেন? তিনি বলেন, হ্যাঁ, হুনাইনের যুদ্ধে পরম ধৈর্যের সঙ্গে যে ৮০ জন যুদ্ধক্ষেত্রে অবিচল ছিলেন, তিনি তাঁদের একজন। তাঁদের ও তাঁদের সন্তানদের জান্নাতের রিজিক প্রদান করা হবে। (আল ইসাবা : ১/৩৪০)
নবীজির মেয়ে ফাতেমা (রা.) ও আলী (রা.)-এর পবিত্র বাসর হয়েছিল সাহাবি হারেসা (রা.)-এর ঘরেই। ইবনে সাআদের বর্ণনায় এসেছে, আবু জাফর (রা.) বর্ণনা করেন, নবী করিম (সা.) সাহাবি আবু আইয়ুব আনসারি (রা.)-এর ঘরে অতিথি হলেন। যখন আলী (রা.)-এর সঙ্গে ফাতেমা (রা.)-কে বিবাহ দিলেন, তখন তিনি আলী (রা.)-কে বলেন, একটি ঘর তালাশ করো, সেখানেই তোমাদের বাসর করো। তারপর তিনি ফাতেমা (রা.)-এর কাছে এলেন। তিনি তাকে বলেন, আপনি এ ব্যাপারে হারেসা ইবনে নোমানের সঙ্গে কথা বলুন।
প্রত্যুত্তরে আলী (রা.) বলেন, সে তো অন্য রকম হয়ে গেছে, এ কারণে তার সঙ্গে কথা বলতে লজ্জাবোধ করছি। এ সংবাদ হারেসা ইবনে নোমানের কানে পৌঁছলে, তিনি রাসুলের দরবারে এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আল্লাহর কসম, ফাতেমা (রা.) যে ঘর গ্রহণ করবেন তা আমার কাছে অধিক প্রিয়। তিনি বলেন, তুমি সত্য বলেছ। আল্লাহ তাআলা তোমার মধ্যে বরকত দান করুন। অতঃপর হারেসা ইবনে নোমান তাঁর একটি ঘর ছেড়ে দিলেন। সেখানেই আলী (রা.) ফাতেমা (রা.)-কে নিয়ে বাসর করেন এবং পরে সেখানেই বসবাস করেন।
অনন্য মর্যাদার অধিকারী এ বিখ্যাত সাহাবি শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন, তাই ঘরের দরজা থেকে মসজিদ পর্যন্ত একটা রশি বেঁধে রাখতেন, যার সাহায্যে মসজিদে যাতায়াত করতেন। কোনো গরিব, মিসকিন এলে তিনি তাঁর থলে থেকে কিছু বের করতেন। তারপর রশি ধরে ধরে গিয়ে তার হাতে দিয়ে আসতেন। পরিবারের লোকজন বলত এই কাজ তো আমরাই করতে পারি, আপনি কেন এত কষ্ট করেন। তিনি বলতেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, মিসকিনকে হাত বাড়িয়ে কোনো কিছু দান করা খারাপ মৃত্যু থেকে মানুষকে রক্ষা করে। (তাবারানি : ৩/২৫৮)
মায়ের সেবায় নিবেদিতপ্রাণ এ মর্যাদাশীল সাহাবি মুয়াবিয়া (রা.)-এর শাসনামলে আল্লাহর ডাকে পরপারে পাড়ি জমান। আল্লাহ আমাদের মায়ের সেবাযত্ন করার তাওফিক দান করুন।
Discussion about this post