নিউজ ডেস্ক
২০১৯ সালের ১৫ মার্চ মুহুর্মুহু গুলির শব্দে কেঁপে উঠেছিল নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদ ও লিনউড ইসলামিক সেন্টার। ব্রেন্টন ট্যারান্ট নামের এক অস্ত্রধারী কেড়ে নেয় ৫১ মানুষের জীবন। আর একটু হলেই সর্বনাশ হতে পারতো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদেরও। মৃত্যুর মুখ থেকে কোনোমতে বেঁচে ফিরেছিলেন মুশফিক-তামিমরা।
দীর্ঘ এক বছর সাড়ে চার মাস পর মুসল্লিদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি চালানো সেই ব্রেন্টনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দিয়েছেন ক্রাইস্টচার্চ হাইকোর্ট। ব্রেন্টন নিউজিল্যান্ডের প্রথম ব্যক্তি, যাকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়ার সুযোগ না রেখে আজ বৃহস্পতিবার যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়।
সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানিয়েছিল, ব্রেন্টন স্বীকার করেছে, দুটি নয়, তিনটি মসজিদে সে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। তার ইচ্ছে ছিল, গুলি করে মানুষ মেরে মসজিদগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার। সে কাজ করতে পারেনি বলে পুলিশের সামনে রীতিমতো আফসোস করেছে ব্রেন্টন ট্যারান্ট। পুলিশকে ব্রেন্টন জানিয়েছে এবং আদালতের কাছেও স্বীকার করেছে, নুর ও লিনউডের পর অ্যাশবার্টন মসজিদে হামলার পরিকল্পনা ছিল তার।
সেদিন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের ঐচ্ছিক অনুশীলন হয় ক্রাইস্টচার্চ স্টেডিয়ামে। অনুশীলন শেষে মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে ফুটবল খেলায় মেতেছিলেন তাইজুল। যার কারণে মসজিদে যেতে দেরি হয়ে যায় বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের। তাতেই হামলার হাত থেকে রক্ষা পান ক্রিকেটাররা।
নিউজিল্যান্ডের আল নুর মসজিদে যাওয়া দলের সঙ্গে ছিলেন তামিম ইকবাল। নিউজিল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে মৃত্যুকে কাছ থেকে দেখা সেই ঘটনার বিবরণ ক্রিকইনফোকে দিয়েছিলেন দেশসেরা ওপেনার। তামিমের চোখে দেখা ক্রাইস্টচার্চের সেই ঘটনা বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলো :
‘বাসে ওঠার আগে কী হয়েছিল, সেটাই আগে বলি, তাহলে বুঝতে পারবেন। মাত্র দু-তিন মিনিট সময় কীভাবে আমাদের জীবন-মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য তৈরি করেছিল।
জুমার নামাজে মুশফিক ও রিয়াদ ভাই খুতবার সময় মসজিদে হাজির হতে চান। সে জন্য আমরা ওই দিন আগেই নামাজে যেতে চেয়েছিলাম। দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে মাঠ থেকে আমাদের বাস ছাড়ার কথা ছিল। কিন্তু রিয়াদ ভাই ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে যান। সেখানে কিছুটা সময় দেরি করে ফেলেন। সংবাদ সম্মেলন শেষ করে রিয়াদ ভাই ড্রেসিংরুমে ফেরেন।
ড্রেসিংরুমে আমরা সবাই তখন ফুটবল খেলায় ব্যস্ত ছিলাম। সেই খেলায় তাইজুল হারতে চাইছিল না। কিন্তু বাকি সবাই তাকে খেলায় হারানোর জন্য উঠেপড়ে লাগে। তাইজুল ও মুশফিক ওয়ান টু ওয়ান খেলছিল। আমরা সবাই সেটা দেখছিলাম। সেখানে আমাদের আরো কিছুটা সময় দেরি হয়ে যায়। এই সামান্য দেরিটাই যে আমাদের জীবন বাঁচিয়ে দিল!
ফুটবল খেলা শেষ করে আমরা বাসে উঠে বসলাম। উদ্দেশ্যে ছিল, মসজিদ থেকে বেরিয়েই আমরা একই বাসে টিম হোটেলে ফিরে যাব। তাই আমাদের সঙ্গে সৌম্য সরকার ও টিম অ্যানালিস্ট শ্রীনিবাসন চন্দ্রশেখরও বাসে উঠে আসে। যেহেতু ম্যাচের আগের দিনের এই অনুশীলন ছিল ঐচ্ছিক সেশন, তাই যাদের অনুশীলন ছিল না, তারা হোটেলে থাকবে আর যাদের অনুশীলন ছিল , তারা মাঠে আসবে। এটাই ছিল পরিকল্পনা।
টিম বাসে আমি সব সময় বাঁ দিকের ছয় নম্বর সিটে বসি। আমাদের বাস মসজিদের কাছাকাছি যেতেই বাসের সবাই ডানদিকে বাইরের তাকাতে শুরু করে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে আমিও দেখলাম, একজন লোক মাটিতে পড়ে আছে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, প্রথমে সেই চিন্তাই আমরা করলাম, ভাবলাম হয়তো মাতাল বা অজ্ঞান হয়ে কেউ মাটিতে পড়ে আছে!
বাস আরেকটু সামনে বাড়ল। সামনেই মসজিদ চত্বর। কিন্তু তখনো সবার মনোযোগ সেই পেছনের মাটিতে পড়ে থাকা অজানা লোকের দিকেই। তখনই আমি দেখলাম, সামনে আরেকজন লোক পড়ে আছে, রক্তাক্ত! উপুড় হয়ে! তখনই উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার শুরু!
মসজিদ চত্বরের কাছে একটি গাড়ির সামনে এসে আমাদের বাস থামল। দেখলাম, আমাদের বাসচালক জানালার কাচ নামিয়ে গাড়ির পাশে থাকা এক নারীর সঙ্গে কথা বলছে। সেই নারী চরম আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় কাঁপছিল! চোখেমুখে তার ভয়ের ছাপ স্পষ্ট। কথা বলছিল সে কান্নার ভঙ্গিতে, ফুপিয়ে ফুপিয়ে! শুনতে পেলাম সেই নারী বলছে, ‘সামনে কিছু হয়েছে, যেও না, যেও না!’
আমাদের বাস ড্রাইভার সেই নারীকে বলল, বাসের এরা সবাই মসজিদে যাবে। তখন সঙ্গে সঙ্গে সেই নারী চিৎকারের ভঙ্গিতে জানালো, ‘না, না, না, মসজিদে যেও না!! ওখানেই তো ভয়াবহ কিছু হয়েছে।’
এটুকু বলেই সেই মহিলা কাঁদতে শুরু করল! বাসের মধ্যে আমরা সবাই সেটা দেখলাম। ড্রাইভারের সঙ্গে তার কী কথা হচ্ছিল, সেটাও শুনলাম। তখনই আমাদের চিন্তা আরো বেড়ে গেল। মসজিদ থেকে আমরা তখন মাত্র ২০ গজ দূরে দাঁড়িয়ে। এক অর্থে এতই কাছে যে, বাস থেকে নেমে মসজিদে একদম প্রবেশের মুখেই তখন আমরা!
তখনই আমরা আরো ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম; মসজিদের চারপাশে রক্তে ভেসে যাওয়া অনেক মানুষ পড়ে আছে। হঠাৎ করে চারপাশে এত মৃত মানুষ দেখে আমরা ঠিক বুঝে উঠতেই পারছিলাম না, কী করব? কোথায় যাব? মাথায় নামাজের টুপি পরা আমাদের কয়েকজন ভয়ে আতঙ্কে মাথা থেকে টুপি খুলে ফেলে! পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, এখানে ভয়াবহ কিছু হয়েছে। যারা পাঞ্জাবি পরে ছিল, তারা সেই পাঞ্জাবির ওপর জ্যাকেট পরতে শুরু করে। যাতে পাঞ্জাবি দেখা না যায়! এ ছাড়া আর কী করতাম আমরা?
চারপাশে এ পরিস্থিতিতে আমরা সবাই বাসের মধ্যে ফ্লোরে মাথা নিচু করে শুয়ে পড়ি। প্রায় সাত-আট মিনিট পর্যন্ত এমন চরম আতঙ্কের মধ্যেই কাটল। ভয়াবহ এ অবস্থার মধ্যে টেনশন, উদ্বেগে আমাদের সবার রক্ত শুকিয়ে যাওয়ার জোগাড়! তখনই দেখলাম, কয়েকজন পুলিশ এসেছে। সাধারণ কোনো পুলিশ নয়, বিশেষায়িত পুলিশ। তারা এসেই মসজিদে ঢুকে পড়ে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে। আমরা পাথরের মূর্তির মতো হয়ে গেলাম যেন। নড়তেই ভুলে যাই সবাই। কারো মুখে কোনো কথা নেই। দেখলাম আমার পুরো শরীর ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মসজিদ থেকে তখন রক্তভেজা শরীর নিয়ে আরো লোকজন বেরিয়ে আসছে।
এমন পরিস্থিতিতে আমরা নিজেদের আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। বেশ কয়েকজন চিৎকার শুরু করল। একজন চিৎকার করে বলল, ‘চলো বাস থেকে বেরিয়ে যাই!’
সঙ্গে সঙ্গে আরেকজন বলল, ‘বাইরে বের হলে যদি অস্ত্রধারীরা আমাদের গুলি করতে শুরু করে, তখন কী হবে?’ পাশ থেকে একজন বলল, ‘বাসের মধ্যে এভাবে আটক হয়ে বসে থাকলেও তো আমরা বড় বিপদে পড়ব!’
আমিও ভাবলাম, বাস থেকে নেমে গেলে হয়তো আমাদের বাঁচার একটা সম্ভাবনা আছে। বরং বাসের মধ্যে থাকলেই হয়তো বা সহজ টার্গেট হয়ে পড়ব। কিন্তু যাব কীভাবে? বাসের সামনের এবং মাঝের দুটো দরজাই যে বন্ধ!
ঠিক তখনই বাসের চালক ঠিক কেন জানি না, আরো ১০ মিটারের মতো সামনে বাড়ল। আমি ঠিক জানি না, কেন সে এটা করল, আমরা তখন তার ওপর ভয়ানক ক্ষেপে গেলাম। তেড়েও গেলাম। সবাই তখন দিশেহারা! বাসের মাঝখানের দরজায় আমরা কয়েকজন লাথি মারতে শুরু করলাম। বাসচালক তখন দরজাটা খুলে দিল। আমি তখন ক্রিকইনফোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি মোহাম্মদ ইসাম ভাইকে ফোন করলাম। ইসাম ভাই প্রথমে মনে করল, আমি তাঁর সঙ্গে কৌতুক করছি! পরে যখন বললাম, ইসাম ভাই আমরা এখন মজা করার মতো অবস্থায় নেই। আপনি কি আমাদের অবস্থা বুঝতে পারছেন না? তখনই দেখলাম আরেক সাংবাদিক মাজহারউদ্দিন আমাকে ফোন করছে। আমার তখন মাথাও ঠিকমতো কাজ করছে না। কী করব কোনো কিছুই ভেবে পাচ্ছি না।
অবশেষে আট মিনিট পরে আমরা বাস থেকে নেমে পড়লাম। সবাই বলল, পার্কের ভেতর দিয়ে দৌড়ে চলে যাই। কয়েকজন বলল, খোলা পার্কের মধ্যে আমরা আরো সহজ টার্গেট হয়ে পড়ব। যদি বন্দুকধারী গুলি করতে শুরু করে, তবে খোলা জায়গায় সবাই মারা যাব। হাতে ধরে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে শুরু করলে পুলিশ আবার কী ভেবে বসে, সেই চিন্তায়ও মাথা খারাপ হওয়ার জোগাড় আমাদের। ঠিক তখনই দেখলাম, আমাদের তিনজন সাংবাদিক এদিকে এগিয়ে আসছেন। আমি আসলে তখন বুঝতে পারিনি, তবে পরে বুঝতে পারছি, আপনাদের তখন ডেকে বিপদেই ফেলে দিয়েছিলাম।
দুনিয়ায় খুব কম লোক আছে এমন বিপদের দিনে পাশে এসে ছুটে দাঁড়ায়। আমার তো মনে হয়, খুব কাছের কোনো মানুষও এমন বিপদের সময় ছুটে আসত না। যেমনটা সাংবাদিকরা এসেছেন। একসঙ্গে পরিচিত সাংবাদিকদের দেখে আমি সত্যিকার অর্থে স্বস্তি পেলাম। তখন আমরা সবাই একসঙ্গে হাঁটতে শুরু করলাম। খানিক বাদে মসজিদ থেকে দূরত্ব একটু বাড়তেই কয়েকজন দৌড়াতে শুরু করল, যাতে দ্রুত মাঠে যাওয়া যায়।
আমরা হোটেলে ফিরে সোজা রিয়াদ ভাইয়ের কামরায় চলে যাই। বন্দুকধারীর ভিডিও দেখি। খেলোয়াড়রা কাঁদতে শুরু করে। ড্রেসিংরুমে আমরা সবাই কেঁদেছি।
আমরা সেদিন মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে নিজ চোখে দেখেছিলাম! পুরো শরীর শীতল হয়ে গিয়েছিল। সেই ভয়াবহ সময় কখনো ভোলার নয়। আমরা সেখান থেকে ফিরে আসার পর প্রতি ঘণ্টায় সেই দুঃস্মৃতি আমাদের তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে! হয়তো এখন আমরা হাসছি। কিন্তু ভেতরে ভেতরে আমরা পুরোই ভেঙে পড়েছি। উফ! যে নৃশংসতা দেখেছি!
Discussion about this post