নিউজ ডেস্ক
দ্বিতল পাকা ভবনটি যখন তৈরি করা হয় তখন নদী ছিল অনেক দূরে। টিনের ঘরে পড়ালেখা চালিয়ে আসা শিশুরা বিদ্যালয়ের পাকা ভবন পেয়ে খুব খুশি হয়েছিল। ২০১৭ সালে এমন খুশির মধ্যে কেউ অনিষ্টের কথা ভাবেনি। কিন্তু তিন বছর পর এসে তা-ই ঘটল, নদীতে বিলীন হয়ে গেছে ভবনটি। বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলার শ্রীপুর ইউনিয়নের চরবগী চৌধুরীপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনটি গত বুধবার কালাবদর নদীর গ্রাসে চলে গেছে। দুই বছর ধরেই চলছিল নদীভাঙন।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, শরীয়তপুরের নড়িয়ায় বসাকের চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ একাধিক বিদ্যালয় ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া অনেক বিদ্যালয় ভবন নদীভাঙনের হুমকির মধ্যে রয়েছে।
কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলায় দুই বছর আগে তিস্তা নদী থেকে মাত্র আড়াই শ ফুট দূরে নির্মাণ করা হয় চরবজরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন। এবারের বন্যায় তিস্তার প্রবল ভাঙনে পাকা এই স্থাপনা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। একই উপজেলার থেতরাই ইউনিয়নের চরজুয়ান সতরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, খারিজা লাটশালা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, হাতিয়া ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত নয়াডারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ও বিলীন হয়ে গেছে।
এভাবে দেশের অনেক এলাকায় যেখানে নদীর কাছে বিদ্যালয় ভবন তৈরি করা হচ্ছে, সেখানে কোনো কোনো সময় ভাঙনের ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে স্থাপনা। বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম এমন ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বন্দরখোলা ইউনিয়নের নুরুদ্দিন মাদবরকান্দি এসইএসডিপি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়টি এবারের বন্যায় পদ্মাগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ভবনটি ২০০৯ সালে নির্মাণ করা হয়। তখন তিন কিলোমিটারের বেশি দূরে নদীর অবস্থান ছিল বলে জানা গেছে।
চলতি বছর চারটি বিদ্যালয় ভবনসহ ১২ বছরে ২৫টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে গেছে শিবচর এলাকায়।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নদীভাঙন এলাকার কত কিলোমিটার বা কতদূরে বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করা যাবে—এই ব্যাপারে সরকারের যথাযথ নীতিমালা নেই। শুধু ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু নদী ভাঙার প্রবণতা ঠিকমতো বিচার-বিশ্লেষণ না করেই বিদ্যালয়ের জন্য বানানো হচ্ছে পাকা ভবন। ফলে প্রতিবছরই সরকারের গচ্চা যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তিন হাজার ৯১৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এর মধ্যে ৫০টি বিদ্যালয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে ১০টির মতো বিদ্যালয় ভবন। ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়গুলোর মধ্যে কোনোটি পানিবন্দি অবস্থায় আছে, কোনোটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কোনোটি আবার নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
ঢাকা বিভাগে এক হাজার ৪৬০টি, রাজশাহী বিভাগে ৭৫০টি, রংপুর বিভাগে ৬৬৫টি, সিলেট বিভাগে ৫৮২টি, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৬৮টি এবং চট্টগ্রাম বিভাগে ৫২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৫০০টি। এবার ইতিমধ্যেই প্রায় দ্বিগুণ প্রতিষ্ঠান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ডিপিইর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের উপপরিচালক মো. নুরুল আমিন বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ের তালিকা প্রতিনিয়ত হালনাগাদ হচ্ছে। এখনো বন্যার পানি আছে। পানি নেমে গেলে প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। যেসব বিদ্যালয় ভবন নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে, সেসবের জন্য জায়গা পাওয়া সাপেক্ষে অস্থায়ী ঘর নির্মাণ করে দিচ্ছি। আর যেগুলো পানিতে ডুবে গেছে সেগুলো মেরামত করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যদি চরের মধ্যে বিদ্যালয় করতে হয়, তাহলে তো আগে কোনো বিকল্প ছিল না। তবে এখন আমরা স্থানান্তর করা যায় এমন ডিজাইনেই স্থাপনা নির্মাণ করছি। এলজিইডি নানা ধরনের যাচাই-বাছাই করে বিদ্যালয় ভবনগুলো নির্মাণ করে। প্রয়োজনে তারা পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও পরামর্শ নেয়। ভাঙনের আশঙ্কা যদি না থাকে তাহলে নদীর এক কিলোমিটারের মধ্যেও বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ করলে সমস্যা নেই। আর যদি ভাঙনপ্রবণ হয় তাহলে দুই কিলোমিটারের মধ্যেও পাকা ভবন করা উচিত নয়।’
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। অধিপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) রূপক রায় বলেন, ‘বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা জানতে আমরা উপজেলা পর্যায়ে চিঠি দিয়েছি। কিছু কিছু এসেছে। সব উপজেলা থেকে তথ্য আসতে আরো কিছুদিন সময় লাগবে।’
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী বুলবুল আখতার বলেন, ‘বন্যা শুরুর পরপরই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ে এই ব্যাপারে উপজেলা ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারদের সঙ্গে আমাদের স্থানীয় প্রকৌশলীরা কাজ করছেন। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত স্কুল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মেরামত করা হবে। সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড়ে যেসব স্কুল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেগুলোর কাজও আমরা প্রায় শেষ করেছি।’
Discussion about this post