মনে করেন বন্ধুদের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছেন সন্ধ্যায় কোন পার্কে বা খোলা চায়ের দোকানে অথবা মাঠে। কিন্তু বাগড়া দিল বেরসিক মশা। আর সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হল মশাগুলি আপনাকেই বেছে নিয়েছে কামড়াতে। বাকি বন্ধুদের বাদ দিয়ে ড্রাকুলার মত চুষে নিচ্ছে শুধু আপনারই রক্ত। চিন্তা করছেন-
কেন? কেন এমন হয়? আপনিই কি একমাত্র হতভাগা?
আসলে নিজেকে একা ভাবার কোন কারন নাই। আপনার মত পৃথিবীর ২০% মানুষকে মশারা একটু বেশি সুস্বাদু মনে করে। কি কি কারন এখানে কাজ করতে পারে সেগুলো এখানে বলে দিচ্ছি-
১) রক্তের গ্রুপ-
মশা কামড় দেয় আমাদের রক্ত থেকে প্রোটিন খাবার জন্য। কারো কারো যেমন গরুর মাংসের চাইতে মুরগীর মাংস বেশি ভাল লাগে, তেমনি কিছু কিছু রক্তের টাইপকে মশা অন্য টাইপের চেয়ে বেশি পছন্দ করে। একখানি পরীক্ষায় দেখা গেছে ‘O গ্রুপ’ এর মানুষজনকে মশা ‘A গ্রুপ’ এর মানুষের চেয়ে দুইগুন বেশি পছন্দ করে। ‘B গ্রুপ’ এর মানুষদেরকে মাঝামাঝি পছন্দ করে মশা সম্প্রদায়।
কিন্তু ব্যাপার হল- মশা কিভাবে বোঝে কোন মানুষের কি রক্ত টাইপ? একজন কামড়িয়ে কি আরেকজনকে খবর দেয় যে-’ওই ব্যাটা জটিল জিনিস, খায়া আয়!’?
হে!হে!, ব্যাপারটা মোটেই তেমন না। ৮৫ শতাংশ মানুষ তাদের ত্বক দিয়ে এমন রাসায়নিক নিঃসরণ করে যেটা দিয়ে বোঝা যায় রক্তের টাইপ টা কি। মশাও সেই অনুযায়ী বুঝে নেয়। আবার যেই ১৫ শতাংশ মানুষ কোন রাসায়নিক নিঃসরণ করেনা তাদের চেয়ে নিঃসরণ যারা করে তাদের কে মশা বেশি পছন্দ করে।
২) কার্বন ডাই অক্সাইড-
আমরা যে নাক-মুখ দিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়ি সেটা তো জানেনই। কাহিনি হল, মশারা ১৬৭ ফুট দূরত্ব থেকেও এই কার্বন ডাই অক্সাইডের গন্ধ বুঝতে পারে। এই কাজে তারা ম্যাক্সিলারি পাম্প নামক একটি অঙ্গ ব্যবহার করে। সেইজন্য, যেইসব মানুষ বেশি পরিমান এই গ্যাস নিঃসরণ ঘটায় তারা বেশি মশা দিয়ে আকৃষ্ট হবেন। বিশেষ করে মোটা এবং আকারে বিশাল ব্যক্তিরা সাধারনের চেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড ছাড়েন। এইজন্যই বাচ্চাদের চেয়ে বড়দেরকে মশা বেশি কামড়ায়। ছোটদের জন্য সুখবরই বটে!
৩) ব্যায়াম এবং পরিপাক-
ঠিক কার্বন ডাই অক্সাইডের মতই মশা দেহের কাছাকাছি আসলে ল্যাকটিক এসিড, ইউরিক এসিড, এমোনিয়া এবং আর কিছু রাসায়নিকের গন্ধ নিতে পারে যেগুলি মানুষের ঘামগ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয়। মশারা এসব যৌগের গন্ধে আকৃষ্ট হয়। জেনেটিকভাবেই আপনি বেশি নিঃসরণ করতে পারেন এসব যৌগ। আবার তপ্ত দেহও (!!) মশাকে আকৃষ্ট করে। যেহেতু ব্যায়াম ল্যাকটিক এসিড নিঃসরণ ঘটায় এবং শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি করে সেহেতু যে ব্যায়াম করবে তাকে মশা অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করবে। ব্যায়াম করলেও কত সমস্যা দেখেছেন?
আপনার দেহ থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে। মশাদের কাছেও।
৪) ত্বকের ব্যাকটেরিয়া-
আশ্চর্যজনক হলেও ত্বকের উপর যেই ব্যাকটেরিয়ার ধরন আছে সেটার উপরও নির্ভর করে আপনার প্রতি ব্যাকটেরিয়া আকৃষ্ট হবে কি হবেনা। ২০১১ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, মশা কোন কোন নির্দিষ্ট ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে অন্যদের চেয়ে বেশি পছন্দ করে। আশ্চর্যের বিষয় হল, যদি আপনার ত্বকে অনেক বেশি ব্যাকটেরিয়া কিন্তু কম রকমের থাকে, মানে সংখ্যায় বেশি থাকে কিন্তু বিচিত্রতা কম থাকে, তবে মশা আপনাকে কম কামড়াবে। আমাদের হাঁটু বা গোড়ালির দিকে ব্যাকটেরিয়ার বৈচিত্র বেশি বলে সেখানে দেখবেন মশা বেশি কামড়াচ্ছে। মজার না?!
ত্বকের ব্যাকটেরিয়ার ধরন এবং সংখ্যা মশাকে আপনার প্রতি আকৃষ্ট করাতে পারে
৫) গর্ভধারণ-
দূর্ভাগ্যজনকভাবে মশা গর্ভধারিনী মহিলাদের বেশি কামড়ায়। তার দুইটা কারন। গর্ভধারিনীরা সাধারনের চেয়ে ২১ শতাংশ বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করেন এবং তাদের দেহের তাপমাত্রাও সাধারনের চেয়ে ১.২৬ ডিগ্রী বেশি।
৬) বিয়ার-
একটা ছোট বোতল বিয়ার খেলেই আপনি মশাদের কাছে প্রিয় খাবার হয়ে যাবেন! মশারা কি তাহলে এলকোহল পছন্দ করে বা মাতাল হতে? সেরকম না বোধহয়। এলকোহল ঘামগ্রন্থি দিয়ে নিঃসৃত হয়, মশা সেটা শুঁকতে পারে। আবার মদ্যপানে দেহের তাপমাত্রাও বৃদ্ধি পায়। তবে এই দুইটার সঙ্গে মশা কামড়ানোর খুব একটা যোগাযোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাই বিয়ার খেলে কেন মশা বেশি কামড়াবে সেটা এখনও অজানাই আছে।
৭) জামার রঙ-
এইটা শুনতে অবাস্তব মনে হলেও সত্যি। মশা মানুষকে চেনে দৃষ্টি দিয়ে। তাই আপনি যদি কালো, গাঢ় নীল বা লাল জামা পড়ে মশাপ্রবণ এলাকায় যান তবে আপনার খবর আছে! কারণ মশা তখন ভিড়ের মধ্য থেকে আপনাকেই বেশি খুঁজে পাবে।
৮) জিনগত-
আসলে এখানের যেগুলি উল্লেখ করলাম তার অনেকগুলিরই অন্তর্নিহিত কারণ হলো জিনেটিক। প্রায় ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে জিনেটিক তথ্যই নির্ধারণ করবে আপনি মশার জন্য আকর্ষণীয় কিনা। রক্তের গ্রুপ থেকে শুরু করে আপনার পরিপাক পর্যন্ত সবই জিনেটিক কারনে নির্ধারিত হয়। দূর্ভাগ্যজনকভাবে আপানাকে পরিবর্তন করে মশার জন্য কম আকর্ষণীয় করাটা সেজন্য কঠিন ব্যাপার, কারণ জিনে পরিবর্তন আনতে হবে।
৯) প্রাকৃতিক নিরোধক-
অনেকগুলি গবেষণাই খুঁজে দেখছে কেন কিছু মানুষকে মশা প্রায় কামড়াই না। আশা করছেন তাদের দেহ থেকেই খুঁজে পাবেন কোন প্রাকৃতিক পোকা নিরোধক। কিছু রাসায়নিক খুঁজেও পাওয়া গিয়েছে যেগুলি কাছাকাছি আসলে মশা ‘ওয়াক থু’ করে। ভাবা হচ্ছে এমনকি রক্তের ‘টাইপ ও’, বা ব্যায়াম করা, বা গর্ভধারিনী মানুষকেও এইরকম রাসায়নিক দিয়ে স্প্রে করলে মশার হাত থেকে বাঁচানো যাবে।
মশার ভালবাসা পাওয়া মাত্র ২০ শতাংশ মানুষের মধ্যে আপনি একজন সৌভাগ্যবান!
Discussion about this post