প্রফুল্লচন্দ্র রায় যিনি পি সি রায় নামেও পরিচিত (আগস্ট ২, ১৮৬১ – জুন ১৬, ১৯৪৪) এক জন প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, বিজ্ঞানশিক্ষক, দার্শনিক, কবি। তিনি বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কিউরাস নাইট্রাইট-এর আবিষ্কারক। দেশি শিল্পায়নের প্রবক্তা। তাঁর জন্ম অবিভক্ত বাংলার খুলনা জেলায় (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত)।
জন্ম ও বাল্যকাল
পি সি রায় বাংলাদেশের খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাডুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর মায়ের ভূবনমোহিনী দেবী এবং পিতার নাম হরিশচন্দ্র রায় যিনি স্থানীয় এক জন জমিদার ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই প্রফুল্লচন্দ্র অত্যন্ত তুখোড় এবং প্রত্যুৎপন্নমতি ছিলেন।
তাঁর পড়াশোনা শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম ই স্কুলে। ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন, কিন্তু রক্ত আমাশা রোগের কারণে তাঁর পড়ালেখায় ব্যাপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে আসেন। গ্রামে থাকার এই সময়টা তাঁর জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছে। বাবার গ্রন্থাগারে প্রচুর বই পান তিনি এবং বইপাঠ তাঁর জ্ঞানমানসের বিকাশসাধনে প্রভূত সহযোগিতা করে।
শিক্ষাজীবন
১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র আবার কলকাতায় ফিরে গিয়ে অ্যালবার্ট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এর পর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে এফ এ পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বিএ ক্লাসে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি থেকে গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বিএসসি পাশ করেন এবং ডিএসসি ডিগ্রি লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তাঁর সেই গবেষণার বিষয় ছিল কপার ম্যাগনেসিয়াম শ্রেণীর সম্মিলিত সংযুক্তি পর্যবেক্ষণ (Conjugated Sulphates of Copper Magnesium Group: A Study of Isomorphous Mixtures and Molecular Combination)। দু’ বছরের কঠোর সাধনায় তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পিএইচডি এবং ডিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। এমনকী তাঁর এই গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাঁকে হোপ প্রাইজে ভূষিত করা হয়। এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালেই ১৮৮৫ সালে ‘সিপাহি বিদ্রোহের আগে ও পরে’ এবং ভারতবিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ এবং ইংল্যান্ডে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
কর্মজীবন
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে আচার্য রায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্সি কলেজের সহকারি অধ্যাপক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় ২৪ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন। অধ্যাপনাকালে তাঁর প্রিয় বিষয় রসায়ন নিয়ে তিনি নিত্যনতুন অনেক গবেষণাও চালিয়ে যান। তাঁর উদ্যোগে তাঁর নিজস্ব গবেষণাগার থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানা সৃষ্টি হয় এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে তা কলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তরিত করা হয়। তখন এর নতুন নাম রাখা হয় বেঙ্গল কেমিক্যাল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যালস ওয়ার্কস লিমিটেড।
অবদান
নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি তাঁর গবেষণাকর্ম আরম্ভ করেন। তাঁর এই গবেষণাস্থল থেকেই পরবর্তীকালে বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার সৃষ্টি হয় যা ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। তাই বলা যায় বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৮৯৫ সালে তিনি মারকিউরাস নাইট্রাইট (HgNO2) আবিষ্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়নের সৃষ্টি করে। এটি তাঁর অন্যতম প্রধান আবিষ্কার। তিনি তাঁর সমগ্র জীবনে মোট ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।
সম্মাননা
- সি আই ই: ১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট থেকে তৃতীয় বারের মতো তিনি ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সি আই ই লাভ করেন।
- সম্মানসূচক ডক্টরেট: ১৯১১ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এই ডিগ্রি দেয়। এ ছাড়া ১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহিশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডক্টরেট পান।
- নাইট: ১৯১৯ সালে তিনি নাইট উপাধি লাভ করেন।
দেশপ্রেম
আচার্যদেবের দেশপ্রেম তাঁকে ইউরোপে থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। দেশে এসেও তিনি তাঁর সেই স্বদেশপ্রীতির পরিচয় দিয়েছেন। তিনি ক্লাসে বাংলায় লেকচার দিতেন। বাংলা ভাষা তাঁর অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে ছিল। তাঁর বাচনভঙ্গি ছিল অসাধারণ যার দ্বারা তিনি ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন খুব সহজেই। তিনি সকল ক্ষেত্রেই ছিলেন উদারপন্থী।
Discussion about this post