দেশের সার্বিক উন্নয়নের চাবিকাঠি যে শিক্ষা, এ কথা আমাদের নীতিনির্ধারকেরা প্রায়ই ভুলে যান। তাঁরা মনে করেন, শিক্ষা হলো সেকেন্ডারি বা ঐচ্ছিক বিষয়। আসল হলো রাজনীতি এবং সে রাজনীতির ভিত্তি কোনো মৌলিক দর্শন নয়; কতিপয় গৎবাঁধা স্লোগান।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত সরকার এসেছে, তারা এক বা একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু সেই কমিশনের সুপারিশ বা নীতি বাস্তবায়নের আগেই সরকার ক্ষমতা থেকে বিদায় নিয়েছে। তারা শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সময় পায়নি। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগ সরকারকে ভাগ্যবান বলতে হবে। ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণার পর ১০ বছর সময় পেয়েছে তারা। দুর্ভাগ্য হলো এই দীর্ঘ সময়ে শিক্ষানীতির মৌলিক কোনো ধারাই বাস্তবায়িত হয়নি। কাঠামোগত সংস্কার হয়নি, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন হয়নি। নীতি বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষা আইন হয়নি। সরকার নতুন করে শিক্ষানীতি সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। বলা হয়েছে শিক্ষাকে আরও যুগোপযোগী করা হবে। আসলে শিক্ষা নিয়ে কাজের চেয়ে কথাই বেশি হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি একাধিক অনুষ্ঠানে বলেছেন, এত দিন শিক্ষা সংখ্যায় বেড়েছে, এবার মানের দিকে নজর দেব। কিন্তু কেন এত দিন সংখ্যায় বাড়ল এবং মানের অবনতি ঘটল, সেই প্রশ্নের উত্তর নেই। শিক্ষার মানের অবনতির অন্যতম কারণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার প্রতি নীতিনির্ধারকদের সীমাহীন উদাসীনতা। এর সঙ্গে যোগ হয়েছিল পাসের হার বাড়িয়ে দেওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। শিক্ষার্থী উত্তরপত্রে কিছু লিখুক আর না-ই লিখুক, তাকে পাস করিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল শিক্ষকদের প্রতি। বলা হয়েছিল কাউকে ফেল করানো যাবে না। বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা কেউ ফেল করুক, তা কারও কাম্য নয়। কিন্তু পাস করতে হবে পড়াশোনা করেই। সে জন্য প্রয়োজন ছিল শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষমুখী করা। নিয়মিত পাঠদান করা। কিন্তু একের পর এক পাবলিক পরীক্ষা চাপিয়ে দিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং ও গাইড বইমুখী করা হয়েছে। বর্তমানে একজন শিক্ষার্থীকে এসএসসির চৌকাঠ পার হতেই তিনটি পাবলিক পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়। এতে শিক্ষার শ্রীবৃদ্ধি হয়নি, প্রসার ঘটেছে কোচিং ব্যবসার।
শিক্ষার্থীদের মেধা ও বুদ্ধি বিকাশের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে যে সৃজনশীল প্রশ্ন চালু করেছিল, তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ জন্য যে প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা নেওয়ার দরকার ছিল, সেটি নেওয়া হয়নি। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের নিচ থেকে তৈরি করা হয়নি। এখন বলা হচ্ছে শিক্ষকেরাই সৃজনশীল প্রশ্ন বোঝেন না। শিক্ষকেরাই যদি প্রশ্ন না বোঝেন, শিক্ষার্থীদের পড়াবেন কী?
আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রাজনীতিকরণ। এমপি মহোদয়রা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হয়ে বসার পর ভর্তি-বাণিজ্য, নিয়োগ-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছে। এমপিরা নির্বাচনী এলাকায় থাকেন খুব কমই (ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহর বাদে)। তাঁদের অনুপস্থিতিতে লাল্লু পাঞ্জুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর ছড়ি ঘোরান। এ অবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে চলবে এবং শিক্ষার মান বাড়বে, এটি আশা করা দূরাশামাত্র। সম্প্রতি হাইকোর্ট কলেজ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি পদে এমপিরা থাকতে পারবেন না বলে রায় দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজগুলোতে চিঠিও দিয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির এমপিরা আর সব বিষয়ে দ্বিমত করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ওপর কর্তৃত্ব বহাল রাখার ব্যাপারে একমত। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে তাঁরা হাইকোর্টের রায় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। যাঁরা শিক্ষার অভিভাবক হয়ে বসে আছেন, তাঁরা মৌলিক বা কাঠামোগত সংস্কারে ভয় পান। চুনকাম করে পুরোনো শিক্ষাব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতে আগ্রহী।
শিক্ষা নিয়ে যখন এই কলাম লিখছি, তখনই আমাদের হাতে এল রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবে রূপায়ণ বাংলাদেশের প্রেক্ষিত (শব্দটি হবে পরিপ্রেক্ষিত)। পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের এই পুস্তিকায় ২০২১-২০৪১ রূপকল্প তুলে ধরা হয়েছে। এতে অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, শিল্প, কৃষি, পরিবহনসহ আর্থসামাজিক সব বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ওই পরিকল্পনা নিয়ে ভবিষ্যতে লেখার ইচ্ছা আছে। এখানে শিক্ষাবিষয়ক কিছু তথ্য তুলে ধরতে চাই।
২০১০-এ ঘোষিত রূপকল্পে ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছিল। সবার জন্য শিক্ষা মানে সাক্ষরতার হার শতভাগে উন্নীত করা। এ বছর সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, বর্তমানে সাক্ষরতার হার ৭৪ শতাংশ। এর অর্থ ২৬ শতাংশ অর্থাৎ সোয়া দুই কোটি মানুষ এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। পরিকল্পনা কমিশনের তথ্যমতে, ২০১০ সালে শিক্ষার হার ছিল ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ১০ বছরে বেড়েছে ১৫ শতাংশ। বছরে দেড় শতাংশ। এই হারে সাক্ষরতার হার বাড়লেও লক্ষ্যে পৌঁছাতে ১৬-১৭ বছর লেগে যাবে। এর পাশাপাশি চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ এশিয়ার অনেক দেশই স্বল্প সময়ে শিক্ষার হার শত ভাগের কাছাকাছি নিয়ে যেতে পেরেছে। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান চলছে খরগোশ গতিতে।
পরিকল্পনা কমিশনও স্বীকার করেছে, বরাদ্দের অপ্রতুলতার জন্য শিক্ষায় কাঙ্ক্ষিত উন্নতি হচ্ছে না। যেখানে শিক্ষাবিদদের দাবি ছিল বাজেটের ৬ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হোক, সেখানে বরাদ্দ কোনোভাবেই ২ দশমিক ২-এর ওপরে উঠছে না। যদিও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) পূরণে বাংলাদেশ শিক্ষা খাতে বাজেটের ৪ শতাংশ বরাদ্দ করার অঙ্গীকার করেছিল। আর শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তার প্রায় সবটাই ব্যয় হয় অবকাঠামো নির্মাণ, সংস্কার ও শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা জোগাতে। শিক্ষার উন্নয়নে কোনো বরাদ্দ থাকছে না।
উচ্চশিক্ষার হালচাল নিয়ে যত আলোচনা, সভা, সেমিনার, বিতর্ক ইত্যাদি হয়, বনিয়াদি ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা নিয়ে তার এক-দশমাংশও হয় না। দাতাদেরও উৎসাহ উচ্চশিক্ষা নিয়ে বড় বড় প্রকল্পে। কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষায় যে ধস নেমে চলেছে, তা ঠেকানোর বাস্তবভিত্তিক কোনো কর্মসূচি নেই। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিভাগে একজন পূর্ণ মন্ত্রীও নেই। প্রতিমন্ত্রী দিয়ে চালানো হচ্ছে। অথচ তথ্যের মতো ছোট মন্ত্রণালয়েও একজন পূর্ণ ও একজন প্রতিমন্ত্রী আছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা মিলে একজন পূর্ণ ও একজন উপমন্ত্রী আছেন। মন্ত্রীর সংখ্যা ও ওজন বাড়লেই শিক্ষার মান বাড়বে, এমন কথা নেই। কিন্তু সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝা যায়।
নীতিনির্ধারকদের বলব, আগে শিক্ষার বনিয়াদটি ঠিক করুন। তখন উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে বেশি না ভাবলেও চলবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
Discussion about this post