অনলাইন ডেস্ক
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে টিকা তৈরির দৌড়ে নেমেছে বিশ্বের বড় বড় জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান। কার্যকর টিকা পেতে তৃতীয় ধাপ বা চূড়ান্ত ধাপের পরীক্ষায় পৌঁছে গেছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে গবেষণার স্বচ্ছতা নিয়ে।
এ পরিস্থিতিতে টিকা গবেষণার সম্পূর্ণ তথ্য সামনে আনার জন্য চাপ বাড়ছে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি।
কোভিড-১৯ টিকা পরীক্ষার চূড়ান্ত ধাপে থাকা নয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবার আগে যুক্তরাষ্ট্রের জৈবপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান মডার্না তাদের গবেষণার সম্পূর্ণ নীলনকশা (ব্লুপ্রিন্ট) প্রকাশ করেছে।
বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে জানানো হয়, টিকা পরীক্ষা নিয়ে স্বচ্ছতার দাবিতে মডার্না যাবতীয় তথ্য প্রকাশের যে পথে হেঁটেছে, তাদের অনুসরণ করতে পারে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো। আরেক মার্কিন কোম্পানি ফাইজারও মডার্নার পথে হেঁটে টিকা পরীক্ষার নীলনকশা প্রকাশ করেছে। এখন অন্য টিকা প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রেও তথ্য প্রকাশের জন্য চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
টিকা অনুমোদন পাওয়ার আগে চূড়ান্ত ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয় তৃতীয় ধাপকে। এ পর্যায়ে হাজারো স্বেচ্ছাসেবীর ওপর টিকাটি পরীক্ষা করে তা কার্যকর ও নিরাপদ কি না, এটি যাচাই করা হয়।
এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে ইতিমধ্যে টিকা-রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। নভেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ঘিরে টিকা নিয়ে গভীর রাজনীতি চলছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনের আগেই দ্রুত টিকা আনার ঘোষণা দিয়েছেন। করোনা মহামারি মোকাবিলায় ট্রাম্পের সমালোচনার জবাবে তিনি এ পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
গত বুধবারও ট্রাম্প আবার বলেন, অক্টোবর মাসেই প্রথম করোনার টিকা অনুমোদন দেওয়া হবে। তাঁর এ ঘোষণায় রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ ছড়িয়েছে। অনেকেই ধারণা করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের টিকা অনুমোদনদাতা সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনকে (এফডিএ) হোয়াইট হাউস চাপ দিয়ে টিকার অনুমোদন করাতে বাধ্য করতে পারে।
বুধবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জো বাইডেন বলেছেন, ‘আমি ট্রাম্পকে বিশ্বাস করি না।’
টিকা বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি রিপাবলিকানরাও একমত যে পরীক্ষাধীন টিকাগুলোর ফল অনুমান করা সম্ভব নয়। এ ছাড়া ২০২০ সাল শেষ হওয়ার আগে শক্তিশালী তথ্য হাতে পাওয়ার সম্ভাবনাও কম।
যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের মতে, শুরুতে যেসব টিকার ডোজ পাওয়া যাবে, তা হবে খুব সীমিত।
মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনবিসিকে গতকাল বৃহস্পতিবার মডার্নার প্রধান নির্বাহী স্টেফান ব্যানসেল বলেছেন, তাঁদের টিকা কার্যকর কি না, তার ফলাফল নভেম্বরের মধ্যেই জানা যাবে। হয়তো অক্টোবরেই জানা যেতে পারে; তবে এতে কিছুটা সংশয় রয়েছে।
মডার্নার টিকার ট্রায়াল প্রটোকল গতকাল প্রকাশ করা হয়েছে। ১৩৫ পাতার ওই তথ্য গোপনীয় হিসেবে চিহ্নিত। এতে পরীক্ষার পরিমিতিগুলো ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, এটি কীভাবে ফলাফল নির্ধারণযোগ্য কি না, তা বিচার করবে।
মডার্নার প্রধান নির্বাহী বলেন, টিকা পরীক্ষার বাস্তবতা হচ্ছে টিকা পাওয়া গ্রুপের সঙ্গে প্লেসেবো বা অন্য ওষুধ পাওয়া গ্রুপের ফল তুলনা করার জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক স্বেচ্ছাসেবকের প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমিত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা প্রয়োজন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে সংক্রমণের হার কমতে থাকায় তাত্ত্বিকভাবে টিকা পরীক্ষার ফল পেতে ডিসেম্বর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।
গতকাল পর্যন্ত মডার্না ২৫ হাজার ২৯৬ জনকে টিকা পরীক্ষার জন্য ঠিক করেছে। এর মধ্যে ১০ হাজার ২৫ জন টিকার দ্বিতীয় ডোজ গ্রহণ করেছেন। প্রথম ডোজ টিকা নেওয়ার ২৮ দিন পর দ্বিতীয় ডোজ দেওয়া হয়। ৩০ হাজার ব্যক্তির মধ্যে টিকা পরীক্ষা সম্পন্ন করতে আরও কয়েক হাজার কর্মী স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ ও পরীক্ষা শেষ করতে কয়েক সপ্তাহ লেগে যাবে।
টিকার কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে দ্বিতীয় ডোজ দেওয়ার পর কোভিড-১৯ সংক্রমণ ঘটছে কি না, তা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত দেখা হয়।
টিকা পরীক্ষার মধ্যবর্তী পর্যায়ে স্বতন্ত্র বিশেষজ্ঞদের কমিটির পর্যালোচনার বিষয়টিও পরিকল্পনায় রয়েছে। স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক দল টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কার্যকারিতার তথ্য খতিয়ে দেখবে।
এফডিএর পক্ষ থেকে বলা হয়, কোনো টিকা যদি কোভিড-১৯–এর ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের কম সুরক্ষা দিতে সক্ষম হয়, তবে তার অনুমোদন দেওয়া হবে না।
মডার্নার পরীক্ষার প্রটোকলে টিকা পরীক্ষা বন্ধ করার নিয়ম, মধ্যবর্তী বিশ্লেষণ ও কার্যকারিতার ধারণার মতো বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। তাদের স্বচ্ছতার প্রশংসা করেছেন স্ক্রিপস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ এরিক টপল।
মডার্না জানিয়েছে, তাদের টিকা পরীক্ষায় যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁদের ২৮ শতাংশ জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী।
মার্কিন সরকারের কাছ থেকে ২৫০ কোটি ডলার সাহায্য পাওয়া মডার্নার পথে হেঁটেছে ফাইজারও। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী একাধিকবার বলেছেন, অক্টোবর শেষ হওয়ার আগেই তাঁর প্রতিষ্ঠান টিকার ফল জেনে যাবে, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইচ্ছার সঙ্গে মিলে যায়।
ফাইজারের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ফাইজার সাধারণত তাদের গবেষণা প্রটোকল সম্পূর্ণ জানায় না। তবে কোভিড-১৯ মহামারি একটি অন্য রকম পরিস্থিতি। তাই এ ক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকার বিষয়টি জরুরি। এ কারণেই ফাইজার স্বচ্ছতার পথে হেঁটেছে।
টিকা তৈরির দৌড়ে এগিয়ে থাকা আরেকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। তারা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একটি টিকা তৈরি করছে। সম্প্রতি তাদের টিকা নিয়ে এক স্বেচ্ছাসেবী অসুস্থ হয়ে পড়লে টিকার পরীক্ষা সাময়িক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল।
তবে গতকাল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, অসুস্থতা টিকাজনিত নয়। ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্য, ব্রাজিল ও দক্ষিণ আফ্রিকায় আবার টিকাটির পরীক্ষা শুরু হয়েছে। এখনো যুক্তরাষ্ট্রে কেন টিকাটির পরীক্ষা শুরু হয়নি, এর কারণ অজানা।
Discussion about this post