নিউজ ডেস্ক
নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় বর্জ্য পানিতে নভেল করোনাভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে। বলা হচ্ছে, নিয়মিত বর্জ্য পানি পরীক্ষা করোনাভাইরাসের উপস্থিতি সম্পর্কে পূর্বাভাসের একটি ব্যবস্থা হতে পারে। সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।
গত ১০ জুলাই থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত সময়জুড়ে নোয়াখালীর একটি আইসোলেশন কেন্দ্রের আশপাশে কয়েকটি স্থানের নর্দমা থেকে বর্জ্য পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়েছে।
গবেষকদের একজন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির জিনোম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্রধান ড. মুহাম্মদ মাকসুদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ঠিক যেভাবে মানুষের শরীরের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়, তেমনই রিয়েলটাইম পিসিআরে পরীক্ষা করে আমরা সংগ্রহ করা বর্জ্য পানিতে নভেল করোনাভাইরাসের কয়েকটি জিনের অস্তিত্ব পেয়েছি।’
ড. মুহাম্মদ মাকসুদ হোসেন জানিয়েছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণে এরই মধ্যে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে, সেগুলো দিয়েই খুব কম খরচে এই পরীক্ষা করা হয়েছে।
ড. মুহাম্মদ মাকসুদ হোসেন বলেন, ‘কয়েক হাজার টাকা দামের একটি ফিল্টার, পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় রি-এজেন্ট পলিথাইলিন গ্লাইকনের জন্য আমাদের খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকার মতো। রিয়েলটাইম পিসিআর মেশিন আছে, এমন যেকোনো ল্যাবে এই পরীক্ষা করা যাবে।’
নভেল করোনাভাইরাস বৈশ্বিক মহামারি আকারে শুরুর পর থেকে প্রতিদিন এই ভাইরাস সম্পর্কে নতুন নতুন নানা ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। করোনাভাইরাস বাতাস, হাঁচি ও কাশির মাধ্যমে ছড়ায়।
ড. মুহাম্মদ মাকসুদ হোসেন বলছেন, পানি থেকে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কোনো তথ্য এখনো জানা নেই। কিন্তু বর্জ্য পানিতে করোনাভাইরাসের জিন শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে।
পূর্বাভাস ব্যবস্থা ও পরিকল্পনা
এর আগে ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যে পয়ঃনিষ্কাশন (স্যুয়ারেজ) থেকে সংগ্রহ করা পানি পরীক্ষা করে নভেল করোনাভাইরাস উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশে স্বল্প পরিসরে করা গবেষণাটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ।
যুক্তরাজ্যের সেন্টার ফর ইকোলজি অ্যান্ড হাইড্রোলজি বলছে, বর্জ্য পানি পরীক্ষা করে জানা সম্ভব, সেখানে কী পরিমাণে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি রয়েছে। অন্তত এক সপ্তাহ আগে একটি এলাকায় কী ধরনের সংক্রমণ হতে যাচ্ছে, তার সম্ভাব্য পরিস্থিতি আঁচ করা সহজ করে দিতে পারে বর্জ্য পানি গবেষণা।
ফিরোজ আহমেদ বলছেন, বর্জ্য পানি পরীক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে এর মাধ্যমে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সম্পর্কে অগ্রিম পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব।
বিষয়টি ব্যাখ্যা করে ফিরোজ আহমেদ বলছেন, ‘নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির উপসর্গ দেখা দিতে কয়েক দিন সময় লাগে। তারপর টেস্ট করতে লাগে আরো কয়েক দিন। কিন্তু শরীরে নভেল করোনাভাইরাস প্রবেশের পর মানুষের মলে ভাইরাসের উপস্থিতি থাকে এবং উপসর্গ দেখা দেওয়ার অনেক আগেই এই ভাইরাস মলের মাধ্যমে বর্জ্য ব্যবস্থায় চলে যায়।’
অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ বলছেন, ‘বিভিন্ন এলাকার বর্জ্য পানি পরীক্ষার মাধ্যমে একটি ম্যাপিং করা সম্ভব। কোন এলাকায় এর উপস্থিতি কত বেশি রয়েছে, সে অনুযায়ী সরকার আগেভাগে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থা নিতে পারবে। কোথায় লকডাউন লাগবে কিংবা কোথায় আরেকটু সহজ ব্যবস্থা নিলেই হবে, সে ব্যাপারে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব।’
অধ্যাপক ফিরোজ আহমেদ বলছেন, কিছুদিনের মধ্যেই দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণ আসছে কিনা, সেটি সম্পর্কে এই পূর্বাভাস অনেক কাজে দিতে পারে।
তবে বর্জ্য পানিতে রাসায়নিক পদার্থসহ আরো অনেক কিছু থাকে। যা ভাইরাসের উপস্থিতি শনাক্ত করা কঠিন করে তুলতে পারে।
উপসর্গহীনদের শনাক্ত করা
বাংলাদেশে অনেকেই করোনা পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে অনীহা প্রকাশ করেন। অনেকে সামাজিক হেনস্তার ভয়ে পরীক্ষা করাতে চান না।
অন্যদিকে উপসর্গহীনরা খুব স্বভাবতই নমুনা দিতে যায় না। কিন্তু তারা অন্যদের সংক্রমিত করে।
ড. মুহাম্মদ মাকসুদ হোসেন বলছেন, ‘কোনো এলাকায় বর্জ্য পানিতে করোনাভাইরাসের জিনের উপস্থিতি থাকা মানে সেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে জরিপ করে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত করা সম্ভব।’
পানি থেকে কি সংক্রমণ সম্ভব?
পাইপের মাধ্যমে যে পানি আমরা পাই, তার মাধ্যমে কি করোনাভাইরাস সংক্রমণ সম্ভব কিনা, সে বিষয়ে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম ঢাকা শহরের উদাহরণ দিয়ে বলেন, ‘ঢাকায় সার্বক্ষণিক পানি সরবরাহ করা হয় না। পাইপে যদি সব সময় পানির প্রেশার থাকে, তাহলে পাইপে ফুটো থাকলেও অন্য কিছু প্রবেশ করতে পারে না।’
‘কিন্তু যখন পানির পাম্প বন্ধ করা হয়, তখন এই প্রেশারটা থাকে না। সে ক্ষেত্রে বাইরের পানি ওই পাইপলাইনে প্রবেশ করে। ঢাকায় অনেক ক্ষেত্রে পানির লাইন ও স্যুয়ারেজ লাইন পাশাপাশি গেছে। স্যুয়ারেজ লাইনেও যদি ছিদ্র থাকে, তাহলে সেখান থেকে নোংরা পানি লাইনে ঢুকে যেতেই পারে’, যোগ করেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, পানিতে নভেল করোনাভাইরাস কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকে; এটি নির্ভর করে কোন ধরনের পানিতে তা রয়েছে।
তাই আশঙ্কা থেকেই যায় যে পানির মাধ্যমেও হয়তো সংক্রমণ সম্ভব। যদিও এ ব্যাপারে আরো অনেক গবেষণা প্রয়োজন বলে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম উল্লেখ করছেন।
হাসপাতালের বর্জ্য পানি শোধন
যেসব হাসপাতালে কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে, যেসব ল্যাবে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে এবং আইসোলেশন সেন্টারগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত নর্দমা থেকে যে বর্জ্য পানি বের হয়, তা শোধন করার কথা বলছেন অধ্যাপক নজরুল ইসলাম।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা শহরে স্যুয়ারেজ লাইনের পানিতে আপনি নভেল করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পাবেনই। কারণ, এখানে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছে। আমরা হাসপাতালের বর্জ্য পানি পরিশোধনের কথা অনেকবার বলেছি। হাসপাতাল বা আইসোলেশন সেন্টারগুলোর বর্জ্য পানিতে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি খুব বেশি থাকবে। তাই সেখানে ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বসানো দরকার।’
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘হাসপাতাল থেকে যে বর্জ্য পানি বের হয়, তা প্রধান স্যুয়ারেজ লাইনে পৌঁছানোর আগেই যেন শোধন করা যায়। এতে এসব হাসপাতাল থেকে করোনাভাইরাসের জিন শহরের প্রধান স্যুয়ারেজ ব্যবস্থায় প্রবেশ ঠেকানো যাবে। এটি ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করার একটি উপায় হতে পারে।’
Discussion about this post