এক্সপ্লোডিং ব্যাকটেরিয়া নামটা শুনে অবাক লাগছে হয়ত! যে ব্যাকটেরিয়া আবার কিভাবে এক্সপ্লোড করে? আজ আমরা এরকম একটি ব্যাকটেরিয়া আর তার আচরণ নিয়ে আলোচনা করব।
আমরা জানি ইতিমধ্যে অনেক ব্যাকটেরিয়া আছে যারা বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। এসব বিভিন্ন এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠা ব্যাকটেরিয়া কে সুপারবাগ বলা হয়। আমেরিকার Centers for Disease Control and Prevention (CDC) এর মতে, এসব এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা প্রতিবছর অন্তত ২ মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে যার মাঝে গড়ে ২৩০০০ মানুষ মারা ও যাচ্ছে। এন্টিবায়োটিক এর অতিরিক্ত এবং ভুল ব্যবহারকেই এর পেছনে দায়ী করা হয়।
এটি মানব সমাজের জন্য খুবই বিপদজনক। কারণ যে হারে এসব ব্যাকটেরিয়া এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে সেই হারে এদের থামানোর জন্য নতুন এন্টিবায়োটিক আবিষ্কার সম্ভব হচ্ছেনা। ধারণা করা হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে কিছু বছরের মাঝেই আমাদের সকল এন্টিবায়োটিক অকার্যকরী হয়ে পড়বে।
উপরের ছবিতে আমরা ১০ টা এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া দেখতে পাচ্ছি যারা বেশ ভালই বিপদপজনক। এর মাঝে বিজ্ঞানীগণ Pseudomonas aeruginosa (যা একটি সুপারবাগ) কে ধ্বংস করার গবেষণায় অনেকটুকু সাফল্য পেয়েছেন। সুপারবাগ সিউডোমোনাস এরুগিনোসা (Pseudomonas aeruginosa) হল একটি সুবিধাবাদী ব্যাকটেরিয়া। মানুষের খুব দুর্বল অবস্থায় এরা মানুষ কে আক্রমণ করে। বিশেষ করে হাসপাতালগুলোতে P. aeruginosa এর সংক্রমণ ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সাধারণ পর্যায়ের তাদের এই সংক্রমণ হবার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। নিজের অবস্থান তৈরি করতে পারলে এরা যে কোনো টিস্যুকেই আক্রমণ করতে পারে। বিশেষ করে ফুসফুস,মূত্রনালী,অন্ত্রে এরা মারাত্নক পর্যায়ের সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এই মাল্টিড্রাগ প্রতিরোধী সুপারবাগ বায়োফিল্ম এর মাঝেও বেঁচে থাকতে পারে।
[ বায়োফিল্মঃ নিজেদের মধ্যে এভাবে যোগাযোগ রক্ষা এবং আত্নরক্ষার ক্ষমতা P. aeruginosa একটি আস্তরণ আস্তরণ তৈরি করে যাকে বলে বায়োফিল্ম। এটি একটি Group of cell এর মত যারা একে অপরের সাথে লেগে থাকে এবং সবাই একটি তলের সাথে লেগে থাকে। বলা যায় এটি ব্যাকটেরিয়ার একটি জনবহুল শহরের মত। যেখানে অসংখ্য ব্যাকটেরিয়া দলবদ্ধভাবে একটি পাতলা আবরণ দিয়ে আবদ্ধ থাকে। যা বিভিন্ন শ্বসনযন্ত্র সম্বন্ধীয় সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে এবং এটি বিশেষভাবে সিস্টিক ফাইব্রোসিস(cystic fibrosis) রোগীদের জন্য খুব বিপদজনক।]
Pseudomonas aeruginosa এর চিকিৎসা কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে কারণ এই সুপারবাগ অনেকগুলো এন্টিবায়োটিক এর জন্য প্রতিরোধী হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। এটি তাকে ধবংসকারী যে কোনো এন্টিবায়োটিক কে অকার্যকর করে দিতে পারে। চিকিৎসকগণ বিভিন্ন ড্রাগ প্রয়োগ করে এর চিকিৎসা করা যায় কিনা পরীক্ষা করে দেখেছেন। কিন্তু তখন এটি সুপ্ত এবং সহনীয় একটি অবস্থায় নিজেকে নিয়ে যায় এবং ভালোভাবেই বেঁচে থাকে। উলটো এতে আমাদের শরীরের যেসব প্রয়োজনীয় ব্যাকটেরিয়া আছে তারা ধবংস হয়ে যায়।
সুপারবাগ P. aeruginosa কিছুটা স্বৈরাচার স্বভাবের ও বলা যায়। এরা কোনো জায়গা দখল করে নিলে সেখানে অন্য ব্যাকটেরিয়া কে ও টিকতে দেয় না। এবং অবাক করার ব্যাপার হচ্ছে এরা এক প্রকার কেমিক্যাল ত্যাগ করতে পারে যা দিয়ে এরা নিজেদের মাঝে যোগাযোগ করতে পারে। ফলে P. aeruginosa যখন বুঝতে পারে অন্য কোনো প্রজাতি তাদের জায়গা এবং পুষ্টিতে ভাগ বসাচ্ছে তারা তখন তাদের নিজের প্রজাতির অন্যদের সাথে বিভিন্ন কেমিক্যাল সিগন্যাল পাঠিয়ে যোগাযোগ করে এবং সবাই একসাথে পায়োসিন (Pyocin) নামক এক প্রকার বিষাক্ত পদার্থ ত্যাগ করে সেই প্রজাতি কে ধবংস করে দেয়।
Nanyang Technological University in Singapore এর বায়ো ইঞ্জিনিয়ার Chueh Loo Poh এবং কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার Matthew Wook Chang সিদ্ধান্ত নেন যে, E. coli ব্যাকটেরিয়া কে ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে P. aeruginosa এর এই অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধেই প্রয়োগ করবেন। তারা E. coli ব্যাকটেরিয়া কে আত্নঘাতী হিসেবে তৈরি করেন। গবেষকরা সিনথেটিক বায়োলজি এর সাহায্যে ই কোলাই(E.coli) এর একটি কোষ তৈরি করেন যেটি দলবদ্ধ অপরিচিত ব্যাকটেরিয়া কে ছড়িয়ে দিয়ে বিষ্ফোরণ ঘটায় এবং নিজের সাথে সাথে সেসব রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু ও ধবংস করে দেয়।
তারা P. aeruginosa এর যে জিনের কারণে এরা নিজেদের প্রজাতি চিনতে সক্ষম সে জিন এর সিনথেটিক জেনেটিক কোড কে E. coli এর জিনোমে সংযুক্ত করে দেন। তারা E. coli এর সাথে আরো একটি জিন সংযুক্ত করেন যেটি এক ধরনের পরিবর্তিত পায়োসিন তৈরি করে । এবং এই পরিবর্তিত পায়োসিন P. aeruginosa এর জন্য বিষাক্ত । পায়োসিন এর এই পরিবর্তিত জিন এর সাথে অন্য সেন্সিং জিন এর লিংক করার মাধ্যমে গবেষকরা এটা নিশ্চিত করেন যে, যখন E. coli, P. aeruginosa এর সান্নিধ্যে গিয়ে এটিকে সনাক্ত করবে তখন এটি নিজের ভিতরে অনেক বেশি পরিমাণে পায়োসিন উৎপন্ন করে বায়োলজিক্যাল টাইম বোম্ব হয়ে উঠবে।
কৃত্রিমভাবে গবেষনাগারে তৈরিকৃত সেই E.coli ব্যাকটেরিয়া LasR নামক একটি প্রোটিন উৎপন্ন করে। এই প্রোটিন Pseudomonas aeruginosa নিজেদের মাঝে যোগাযোগ রক্ষার জন্য যে রাসায়নিক পদার্থ ত্যাগ করে সেটিকে সনাক্ত করতে পারে। যখন LasR সেই রাসায়নিক পদার্থ সনাক্ত করে সাথে সাথে এর দুটি জিন সক্রিয় হয়ে উঠে। প্রথম টি একটি অস্ত্র বোমা কে সক্রিয় করে তোলে যেটি প্রচুর পরিমাণে পরিবর্তিত বিষাক্ত পায়োসিন উৎপন্ন করে । এই বিষাক্ত পায়োসিন P. aeruginosa এর বায়োফিল্ম এ আঘাত হানে এবং ভেতর থেকে এদের দলবদ্ধ অবস্থা কে ভেঙ্গে দেয়। অন্য জিন টি বিষাক্ত পায়োসিন সমৃদ্ধ টাইম বোম্ব টিকে বিষ্ফোরিত করে। এই বিষ্ফোরণে প্রচুর পরিমাণ সেই পরিবর্তিত বিষাক্ত পায়োসিন বের হয় যা P. aeruginosa কে ধবংস করে দেয়।
এই প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় সৌন্দর্য হচ্ছে তাদের অস্ত্র তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা। Chang এবং Poh একটি পাত্রে একসাথে P. aeruginosa এবং সেই সিনথেটিক E. coli নেন। এবং তারা লক্ষ করেন যে, সেই আত্নঘাতী বোম্বার ৯৯% P. aeruginosa কে ধবংস করতে সমর্থ হয় । এমন কি বায়োফিল্ম ভেদ করেও ৯০ ভাগ ব্যাকটেরিয়া ধবংস করা সক্ষম হচ্ছে, যদিও বায়োফিল্ম ভেদ করে এদের ধবং স করা খব সহজ ব্যাপার নয়।
সিনথেটিক জীববিজ্ঞানী Justin Gallivan একটি এ মেইলে বলেন যে, “এ গবেষণা খুব সুন্দরভাবে দেখিয়েছে যে কিভাবে সিনথেটিক ব্যাকটেরিয়া খুব জটিল একটি কাজ সম্পাদন করছে। কিন্তু তিনি এটা নিয়ে চিন্তিত যে, এই ব্যাকটেরিয়া ১০০% সফলতার সাথে কাজ করতে পারছে না। কারণ ১% সংক্রমিত ব্যাকটেরিয়া চিকিৎসার পরেও থেকে যাচ্ছে। এমনকি চার গুণ বেশি সিনথেটিক E. coli দিয়েও ১০০% ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে না।”
সিনথেটিক জীববিজ্ঞানী Richard Kitney বলেন, মানুষের উপর প্রয়োগ করার আগে এর আরো বহু পরীক্ষার দরকার আছে। E. coli পরিবর্তে অন্য কোনো ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা যায় কিনা এটাও দেখা দরকার।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রের বাহিরে বিষাক্ত হয়ে যায় সুতরাং মানুষকে E. coli এর কাছে উন্মুক্ত করে দেয়া ভাল ব্যাপার নয়। কারণ সব E. coli মানুষের জন্য ক্ষতিকর না হলেও E. coli এর কিছু প্রজাতি আছে যার কারণে মূত্রনালীর সংক্রমণ, শ্বসন সংক্রান্ত জটিলতা সহ নিউমোনিয়া,মেনিনজাইটিস এর মত রোগেও আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আর যেসব ব্যাকটেরিয়া ইতিমধ্যে বায়োফিল্ম তৈরি করে ফেলেছে তাদের পায়োসিন দিয়ে ধবংস করাটা কতটা কার্যকরী এটাও আরো ভালোভাবে নিশ্চিত হতে হবে। [Sciencemag]
Chang এবং Poh, P. aeruginosa আক্রান্ত ইঁদুরের উপর এটি পরীক্ষা করার পরিকল্পনা করছেন। তারা বলেন পায়োসিন স্তন্যপায়ীদের জন্য ক্ষতিকর কিনা এটি নিশ্চিত নয়। কারণ ফুড প্রিজারভেটিভ হিসবে কিছু প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়া টক্সিন কে সম্প্রতি অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
এই পরীক্ষার ফলাফল ১০০% সফলভাবে নিশ্চিত করার পর সেটা হয়ত অদূর ভবিষ্যতে মানুষের উপর ও প্রয়োগ করা যাবে। এবং সেটি যদি সম্ভব হয় হয়ত মানব জাতি বেঁচে যাবে এসব এন্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ধংসাত্নক সুপারবাগ এর কবল থেকে, আরো একটা নিশ্চিত বিশাল মানব বিপর্যয় থেকে। আর এক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের ও ভূমিকা পালন করতে হবে। আমাদের বুঝে শুনে রেজিস্টার্ড ডাক্তার এর প্রেসক্রিপশান মত এন্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে। নাহলে আমরা নিজেদের বিপদের মুখে ঠেলে দেয়ার পাশাপাশি আমাদের ভবিষ্যত বংশধরদের ও বিপদের মুখে ফেলে যাবো। এন্টিবায়োটিক এর সঠিক ব্যবহার আমাদের অনেকাংশে এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে।
রেফারেন্সঃ
২। Treatment of Superbug infection with the help of Exploding Bacteria
Discussion about this post